শাহ মতিন টিপু : সব দিনের সেরা দিন মহানবীর (সা.) জন্মদিন। ১২ রবিউল আউয়াল পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)। এ দিন শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কেবল জন্মদিনই নয়, ওফাত দিবসও। সঙ্গত কারণেই বিশ্বের মুসলিম সম্প্রদায়সহ শান্তিকামী সব মানুষের কাছে দিনটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
আজ থেকে ১৪’শ ৪৫ বছর আগে অর্থাৎ ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দের ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার সুবহে সাদিকের মূহুর্তে মক্কার বিখ্যাত কুরাইশ বংশে মা আমিনার গর্ভে মুহম্মদ (সা.) জন্ম গ্রহণ করেন। তার জন্মের আগেই মারা যান তার পিতা আব্দুল্লাহ। জন্মের পর মাত্র ৬ বছরে হারান জন্মদাত্রী মাতাও। মাতা-পিতাহীন মুহম্মদ (সা.) শিশু ও বাল্যকালে চরম কষ্ট সহ্য করে দাদা আব্দুল মুত্তালিবের গৃহে লালিত-পালিত হন । তার এ আশ্রয়ও দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।
দাদা আব্দুল মুত্তালিবের মৃত্যুর পর মুহম্মদ (সা.) তার চাচা আবু তালিবের তত্ত্বাবধানে বেড়ে ওঠেন। কুরাইশ বংশ তৎকালীন মক্কার সম্ভ্রান্ত বংশ হলেও মুহম্মদ (সা.) এর দাদা কিংবা চাচারা আর্থিকভাবে স্বচ্ছল ছিলেন না। বাল্যকালে চাচার তত্ত্ববধানে থাকাকালীন পারিশ্রমিকের বিনিময়ে অন্যের বকরি-ভেড়া চড়াতেন তিনি। রাখাল থাকা অবস্থাতেই মুহাম্মদ (সা.) এর মাঝে চারিত্রিক দৃঢ়তা, বিশ্বস্ততা ও বিভিন্ন গুণ প্রকাশ পেতে থাকে।
হযরত ঈসাকে (আ.) পৃথিবী থেকে তুলে নেওয়ার পর দীর্ঘকাল কোন নবী বা রাসূল না থাকায় দুনিয়াবাসী পাপের অন্ধকারে চরমভাবে নিমজ্জিত হয়। জঘন্য অপরাধে লিপ্ত হয় মানুষ। এক প্রতিকূল পরিবেশে মুহম্মদ (সা.) এর পৃথিবীতে আগমন। এমন চ্যালেঞ্জের যুগেও মুহম্মদ (সা.) উন্নত চরিত্রর জন্য আল-আমিন তথা বিশ্বাসী উপাধিতে ভূষিত হন।
যুবক বয়সে আরবের অন্যতম শীর্ষ ব্যবসায়ী হযরত খাদিজা (রা.) এর ব্যবসা দেখাশুনা করেন। মুহাম্মদ (সা.) এর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে এবং ব্যবসায়িক কৃতকর্মে খুশি হয়ে হযরত খাদিজা (রা.) মুহাম্মদ (সা.) এর প্রতি আকৃষ্ট হন এবং বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হন। এ সময় মুহাম্মদ (সা.) এর বয়স ২৫ বছর এবং খাদিজা (রা.) এর বয়স ছিল ৪০ বছর ।
মুহাম্মদ (সা.) এর বয়স যখন ৪০ বছরের কাছাকাছি তখন নবুওয়াত প্রাপ্তির লক্ষণ তার মধ্যে পরিলক্ষিত হতে শুরু করে। তিনি বিচলিত হয়ে পড়েন এবং মুক্তির পথ খুঁজতে থাকেন। এ সময় মুহম্মদ (সা.) উঁচু হেরা পর্বতের গুহায় ধ্যান আরম্ভ করেন। অবশেষে আসে সে কাঙ্খিত দিন, আল্লাহতায়ালা অবতীর্ণ করতে শুরু করেন মহাগ্রন্থ আল-কুরআন। হযরত মুহম্মদ (সাঃ) এর বয়স যখন ঠিক চল্লিশ বছর তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে তিনি রেসালাতের দায়িত্ব অর্জন করেন।
রেসালাত ও নবুওয়াতের দায়িত্ব প্রাপ্তির পর হযরত মুহম্মদ (সা.) মানুষকে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নেওয়ার জন্য আহবান করতে শুরু করেন। মহানবীর দাওয়াতে সাড়া না দিয়ে উল্টো মুহম্মদকে (সা.) তার পথ থেকে সরে আসার প্রস্তাব দেয়। শুরু হয় তার ওপর নির্যাতন। এমনকি হত্যা করা হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। আল্লাহ কাফেরদের ষড়যন্ত্রের কথা তার প্রিয় বন্ধুকে অবহিত করে তাকে মক্কা ছেড়ে মদিনায় হিজরত করার আদেশ দেন ।
নবুওয়াত প্রাপ্তির মাত্র ১২ বছর অতিবাহিত হতে না হতেই একান্ত অনুচর বন্ধুবর হযরত আবুবকরকে (রা.) নিয়ে মক্কা ছেড়ে মদিনা অভিমূখে যাত্রা করেন। পবিত্র মদিনা শরীফকে একটি কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা এবং তিনি এ রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেন।
এরপর থেকে ধীরে ধীরে ইসলাম ধর্মের বিস্তৃতি বাড়তে থাকে। দলে দলে মানুষ শান্তির স্পর্শ পেতে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে প্রবেশ করে। ধীরে ধীরে মুসলমানদের শক্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে ।
৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে ৮ হিজরিতে আল্লাহর নির্দেশে মুহম্মদ (সা.) দশ সহস্রাধিক সৈন্য নিয়ে মক্কা বিজয় করেন। যে সব মানুষ মুহম্মদ (সা.) এর ওপর অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছিল তাদেরও তিনি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। মক্কা বিজয়ের পরে মুহম্মদ (সা.) আবারও মদিনায় ফিরে যান। ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে হজ্জ পালনের উদ্দেশ্যে পুনরায় মুহম্মদ (সা.) মদিনায় গমন করেন। মদিনায় হজ্জ কালে সফরের মধ্যেই আল্লাহ তা’আলা তার প্রতি নাযিল করেন-‘আজ আমি তোমাদের দ্বীনকে তোমাদের জন্য পূর্ণ করে দিলাম, এবং আমার নেয়ামতকে তোমাদের উপর পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য ধর্ম হিসেবে মনোনীত করে দিলাম’।
এ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর সাহাবীরা অঝোর ধারায় কাঁদতে শুরু করলেন। তখন রাসূল (সা.) তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কাঁদ কেন ? সাহাবীরা বললেন আমরা বুঝতে পারছি, অচিরেই আল্লাহ আপনাকে তার মেহমান করে নিবেন। কেন না কোন জিনিস পূর্ণতা পাওয়ার পর সেটা কমতে শুরু করে । যেহেতু ইসলাম পূর্ণতা পেয়েছে তাই আপনাকে আর আমাদের মধ্যে রাখা হবে না । হজ্জ পালন শেষে হযরত মুহম্মদ (সা.) তার সঙ্গী সাথীদের নিয়ে মদিনায় চলে আসেন ।
অবশেষে আসে দুঃখের দিন, শোকের দিন । শিরঃপীড়ায় আক্রান্ত হয়ে ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দ তথা ১০ হিজরী সনের ১২ রবিউল আউয়াল মাসের সোমবার পৃথিবীর মানুষকে দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে ইহলোক ত্যাগ করেন তিনি।