বিডি মেট্রোনিউজ || গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে খসে পড়ল ২০১৫ সাল। পাওয়া-না পাওয়ার আনন্দ-বেদনা ঠাঁই নিল স্মৃতির পাতায়। শুরু হলো নতুন বছর। হ্যাপি নিউ ইয়ার ২০১৬। মধ্যরাতে নতুন এ বছরকে স্বাগত জানানোর উৎসবের বাঁশি বেজে উঠল সবার প্রাণে। শুরু হলো নতুন প্রত্যাশার বছর। কিন্তু যে বছরটি হারিয়ে গেল জীবন থেকে, ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে, তার সবই কি হারিয়ে যাবে? মুছে যাবে সব? না, সবকিছু মুঝে যায় না। ঘটনাবহুল ২০১৫ সালের ঘটনার রেশ টেনেই মানুষ এগিয়ে যাবে ২০১৬ সালের নতুন দিনে।
বিগত দিনের সব জরা পেছনে ফেলে নব নব আশা আর স্বপ্ন সঙ্গী করে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ে বছরটিকে বরণ করে নিয়েছে বাংলাদেশ। স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তিকে পুরোপুরি পরাজিত করে, রুখে দিয়ে এ বছর এগিয়ে যাওয়ার কঠিন চ্যালেঞ্জ নেবে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক অস্থিরতা অনিশ্চয়তা কাটিয়ে সংবিধান ও গণতন্ত্র রক্ষার শপথ নেবে।
খ্রিষ্টীয় নববর্ষ উপলক্ষে দেওয়া বাণীতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ খ্রিষ্টীয় নববর্ষ দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে প্রত্যাশা পূরণে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে বলে দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। রাষ্ট্রপতি সকলকে শুভ নববর্ষ এবং শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন ।
তিনি বলেন, ‘দেশব্যাপী নানা আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে নতুন বছরকে বরণ করা হয়। সকলের মাঝে জাগে প্রাণের নতুন স্পন্দন। কোনো ধরনের অপসংস্কৃতি যেন আমাদের এই আনন্দধারাকে ব্যাহত করতে না পারে, সে লক্ষ্যে সকলকে সজাগ থাকতে হবে।’
নববর্ষে জঙ্গি হামলার আশঙ্কা ইউরোপজুড়ে। বেলজিয়ামে নতুন বছর উদযাপনে আতশবাজি ও অন্যান্য অনুষ্ঠান বাতিল করেছে কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া লন্ডন, প্যারিস, বার্লিন ও মস্কোতে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। সতর্কতা তুরস্কেও। অস্ট্রিয়ান পুলিশ জানিয়েছে, একটি ‘বন্ধুভাবাপন্ন’ জঙ্গি সংগঠন তাদের থার্টি ফার্স্ট নাইটে জঙ্গি হামলার বিষয়ে সতর্ক করেছে।
বার্লিনে আতশবাজি ও ব্যাকপ্যাক নিয়ে নতুন বছরের উদযাপনের অনুষ্ঠানে আসা নিষিদ্ধ করেছে। ঐতিহাসিক ব্রান্ডেনবার্গ গেটের কাছে প্রায় ১০ দশ লাখ লোক সমাগমের কথা রয়েছে। লন্ডনে প্রায় ৩ হাজার পুলিশ নিয়োজিত থাকবে নিরাপত্তার দায়িত্বে। প্রায় ১ লাখ মানুষ শহরের মেয়র আয়োজিত আতশবাজির অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন বলে আশা করা হচ্ছে। বাংলাদেশেও গ্রহণ করা হয়েছে সতর্ক অবস্থান। অপশক্তির হাত থেকে মানুষ বাঁচানোর প্রয়াসে শান্তিকামী দেশগুলো এখন একনীতিতে। আর তা হচ্ছে জঙ্গি উৎখাতের নীতি।
আজ ভোরের নির্মল আকাশে দেখা দেবে নতুন বছরের সূর্য। প্রতিবারের মতো এবারও নতুন সূর্যালোকে সকলের মনেই নতুন আশা ও স্বপ্ন। নতুন আকাক্সক্ষায় উদ্ভাসিত নতুন বছর ২০১৬। হারিয়ে গেল ঘটনাবহুল বছর ২০১৫। যে বছরের খেরোখাতায় চোখ বুলালেই বয়ে যায় আনন্দ-বেদনার স্রোত। কেননা, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে শুরু করে সবখানেই নানা ঘটনা-দুর্ঘটনায় ২০১৫ সাল পূর্ণ ছিল।
বছরের শুরুতেই রাজনীতি উত্তাল হয়ে ওঠে। সহিংসতা ছোবল হানে। কিন্তু এর মধ্যেও বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন রোধে বাংলাদেশের ভূমিকা ও নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের কার্যক্রম এ দেশকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নতুনভাবে চিনিয়েছে। বিশ্বে মৎস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ চতুর্থ স্থান করে নিয়েছে। সবজি উৎপাদনে সুনাম করেছে। অর্থনৈতিক মেরুদ- আরো শক্ত হয়েছে দেশের। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদ- দেওয়ায় জাতির কলঙ্ক মোচন হয়েছে। যদিও সহিংসতায় অসংখ্য নিরীহ মানুষের মৃত্যু, আহতদের আর্তচিৎকার, ব্লগার হত্যা, জঙ্গিদের উত্থান, বিদেশি নাগরিক হত্যার মতো ঘটনায় বারবার আতঙ্কিত হতে হয়েছে সবাইকে। তবে বছর শেষে ২৩৪ পৌরসভায় সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে ভোট উৎসব হয়ে ওঠে ২০১৫ সালের আলোচিত ঘটনা। অবশ্য ব্লগার রাজিব হত্যা মামলার রায়ও বছরের শেষদিনে একটি মাইলফলক।
এ বছর ওয়াশিংটনভিত্তিক প্রভাবশালী ম্যাগাজিন ফরেন পলিসির ১০০ বিশিষ্ট দৃঢ়চিন্তার ব্যক্তিত্বের তালিকায় স্থান করে নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতিসংঘ সম্মেলনে পরিবেশ বিষয়ক সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক পুরস্কার `চ্যাম্পিয়ন্স অব দি আর্থ` ও বাংলাদেশে আইসিটির প্রসারে জাতিসংঘের `টেকসই উন্নয়ন পুরস্কার` লাভ করেন প্রধানমন্ত্রী। নি¤ন মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে বাংলাদেশের উত্থান আলোচিত হয়। বাংলাদেশ সফর করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনকে দেশের গণতন্ত্রের জন্য `কালো দিবস` অভিহিত করে বিএনপি ২০১৫ সালে একই তারিখে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করে। এদিন খালেদা জিয়া তার গুলশান কার্যালয়ে কার্যত `অবরুদ্ধ` হয়ে পড়েন এবং অব্যাহতভাবে অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। যদিও অজ্ঞাত স্থান থেকে গণমাধ্যমে বিবৃতি পাঠানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল বিএনপির এ কর্মসূচি। কিন্তু সারা দেশে সহিংস ঘটনা ঘটায় জনজীবন বিপন্ন হয়ে পড়ে। অবরোধকালে সারা দেশে সহিংসতায় ১৩৭ জন নিহত হন। সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময় আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না দিলেও সে অবরোধ থেমে যায়।
বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডসহ মানবতার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপরাধের বিচার, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে তিনটি দুর্নীতি মামলা, বিডিআর বিদ্রোহের মামলার আপিল, চাঞ্চল্যকর রাজন-রাকিব হত্যা এবং ঐশীর মামলা ছিল এ বছর আলোচনার কেন্দ্রে। তিনজন যুদ্ধাপরাধী- মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ এবং সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। এতে পাকিস্তান উষ্মা প্রকাশ করে গণহত্যার দায় অস্বীকার করলে দেশটির সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবি ওঠে।
এ বছর জঙ্গিদের উত্থানে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ব্লগার ও বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায়সহ বিভিন্ন ব্লগার হত্যা, বিদেশি নাগরিক সিজার তাবেলা ও হোশি কোনিও হত্যা, তাজিয়া মিছিল ও শিয়া মসজিদে হামলা, যাজকদের ওপর হামলা ইত্যাদি ঘটনায় জনমনে শঙ্কা ছড়িয়ে পড়ে। অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় ক্রিকেট দল তাদের বাংলাদেশ সফর বাতিল করে। ঢাকার বেশ কয়েকটি দূতাবাস নিজ নিজ দেশের নাগরিকদের ভ্রমণে সতর্কতা জারি করে। সিলেটে শিশু রাজন হত্যা, খুলনায় রাকিব হত্যা, মাতৃগর্ভে শিশু গুলিবিদ্ধ হওয়া থেকে ফেসবুক বন্ধ নিয়েও আলোচনা-সমালোচনা হয় ব্যাপক।
স্থল সীমান্ত চুক্তি হওয়ায় দীর্ঘ ৬৮ বছর পর এ বছর বাংলাদেশ ও ভারতের মূল ভূখ-ের অংশ হয়ে গেছে ছিটমহলগুলো। দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প পদ্মা সেতুর আনুষ্ঠানিক শুভ সূচনা হয় এ বছরের ১২ ডিসেম্বর।
২০১৫ সালের আলোচিত-সমালোচিত ঘটনাগুলোর মধ্যে অন্যতম বিষয় ছিল বিশিষ্ট নাগরিকদের হত্যার হুমকি। সারা বছরই আলোচনায় ছিল সাগরপথে মালয়েশিয়ায় মানব পাচার। গণকবর, নিখোঁজ স্বজনদের আর্তনাদ, সাগর থেকে ভাসমান মানুষ উদ্ধার এ বছরের আলোচিত ঘটনা। বছরের মাঝপথে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ ও কলেজে ভ্যাট আরোপের প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামেন। বছরজুড়ে আলোচনা ছিল নতুন পে স্কেল নিয়ে।
ক্রিকেটে এ বছর বাংলাদেশ দল একদিনের সব আন্তর্জাতিক সিরিজেই জয় পেয়েছে। পরাজিতের তালিকায় রয়েছে ভারত, পাকিস্তান ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দল। স্বাগতিক নেপালকে হারিয়ে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জয় করে বাংলাদেশের মেয়েরা, যা বাংলাদেশের নারী ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অর্জন।
২০১৫ সালে আমরা হারিয়েছি বেশ কয়েকজন প্রিয় ব্যক্তিত্বকে। তাদের মধ্যে রয়েছেন- কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের অন্যতম রূপকার ভাস্কর নভেরা আহমেদ, গীতিকার গোবিন্দ হালদার, প্রাক্তন স্পিকার শেখ রাজ্জাক আলী, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমদ, প্রবীণ সাংবাদিক হাসানউজ্জামান খান ও সিরাজুর রহমান, সঙ্গীতশিল্পী ফরিদা ইয়াসমিন, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়ার স্ত্রী চিত্রশিল্পী আসমা কিবরিয়া, সমাজকল্যাণমন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলী, চলচ্চিত্র নির্মাতা চাষী নজরুল ইসলাম প্রমুখ। তাদের জন্য গভীর শোক। নতুন বছরের নতুন দিনগুলো হোক পরম শান্তি ও অপার সুখের।