খান মাইনউদ্দিন, বরিশাল: আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারী থাকলেও ক্রমান্বয়ে বরিশাল নগরীতে বাড়ছে বৈচিত্রময় অপরাধ। কখনো খোদ অপরাধী আবার কখনো কখনো বিভিন্ন পেশাদারিত্বের পরিচয়ে সংঘটিত হচ্ছে অপরাধ। তেমনি র্যাব ও সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অভিযানের নামে কর্মচারীদের জিম্মি করে চাঁদাবাজির অভিযোগ পাওয়া গেছে। যদিও র্যাব ও বরিশাল পুলিশ প্রশাসন বলছে, ওই দিন তাদের কোন অভিযান পরিচালনা করা হয়নি।
প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ‘অভিযানের’ ভিডিও ফুটেজ দেখালে তারা নিশ্চিত করেছেন ‘অভিযানকারী’ কোন সদস্য পুলিশ বা র্যাবে নেই। অথচ র্যাবের বরাদ দিয়ে ওই চাঁদাবাজির ঘটনাটি প্রশাসন কর্তৃক ‘জরিমানা আদায়’ করা হয়েছে মর্মে ফলাও করে সংবাদ প্রকাশ করেছে বরিশাল থেকে প্রকাশিত একটি পত্রিকা।
সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষ মনে করছে চাঁদাবাজীর নেপথ্যে যারা জড়িত তারা খুব শিঘ্রই আইনের আওতায় আসবে। তাদের মতে এসবের সাথে সংবাদ প্রচারকারীদের সাথে গোপন সখ্যতা থাকতে পারে। যে কারণেই তারা চাঁদাবাজিকে ‘র্যাবের অভিযান’ আখ্যায়িত করে আসল ঘটনাকে আড়াল করেছে।
ঘটনাটি ঘটে চলতি বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি সোমবার। শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনের বেবীলন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে।
জানা গেছে, এক রোগী ১৮ ফেব্রুয়ারি রবিবার রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা করতে আসেন এই ডায়াগনস্টিক সেন্টারটিতে। সেখানে রক্তের গ্রুপ নির্ণয়ে ভুল হয়, যা সোমবার ধরা পরে শেবাচিম হাসপাতালে রক্ত পরিসঞ্চালন করতে গিয়ে। এই রিপোর্ট নিয়ে মঙ্গলবার ৬ জনের একদল যুবক নিজেদের র্যাব পরিচয় দিয়ে বেবীলন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যোগাযোগ করে।
ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, ওই যুবকেরা প্রায় দেড় ঘন্টাব্যাপী ডায়াগনস্টিক সেন্টারটির কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জিম্মি করে রাখেন। এসময়ে তারা বিভিন্ন ধরণের ভয়ভীতি প্রদর্শনও করেন। এক পর্যায়ে মুঠোফোনে ক্যামেরাধারী এক যুবককে ডেকে ঘটনাস্থলে নিয়ে আসেন। যিনি নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে ছবি তুলে তা পত্রিকায় ছেপে দেবেন বলে হুমকি দেন।
সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, যে যুবকেরা নিজেদের র্যাব পরিচয় দেয় তারাও কর্মচারীদের দাঁড় করিয়ে মুঠোফোনে ছবি তুলে নিচ্ছেন।
বেবীলন ডায়াগনস্টিকের কর্মচারীরা জানিয়েছেন, র্যাব পরিচয় দিয়ে ৬ জনের ওই দলটি প্রবেশ করার পর কর্মচারী কাউকেই বেবীলন ডায়াগনস্টিক সেন্টার ত্যাগ করতে বা নতুন কাউকে প্রবেশ করতে দেয়নি। পাশাপাশি নিজেদের মোবাইল ফোনে কল করতে বা রিসিভ করতে দেয়নি। এমন জিম্মিদশায় প্রায় ঘন্টাখানেক থাকার পরে রক্ত পরীক্ষাকারী ডা: হাবিবুর রহমান ডায়াগনস্টিক সেন্টারে এসে র্যাব পরিচয়দানকারীদের জেরার মুখে জরিমানা বাবদ ২০ হাজার টাকা প্রদান করেন। এর পর ৬ জনের ওই দলটি ঘটনাস্থল ত্যাগ করে।
ডায়াগনস্টিক সেন্টার জিম্মি করে চাঁদাবাজির তথ্য প্রতিবেদকের হাতে আসার পর সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে বিভিন্ন মাধ্যমে চাঁদাবাজদের সনাক্তের চেষ্টা করা হলেও সুর্নিদিষ্ট কারও পরিচয় পাওয়া যায়নি। তবে প্রশাসেনের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন, যারা র্যাব পরিচয় দিয়ে বেবীলন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চাঁদাবাজি করেছেন তারা র্যাব বা পুলিশের কেউ নয়।
অপরদিকে ২০ ফেব্রুয়ারি বরিশাল থেকে প্রকাশিত দৈনিক আজকের পরিবর্তন পত্রিকায় বেবীলন ডায়াগনস্টিক সেন্টারের এই ঘটনাটিকে র্যাবের অভিযান বলে প্রথম পৃষ্ঠায় একটি সংবাদ প্রকাশ করে। সংবাদভাষ্যে প্রতিবেদক দাবী করেন, ‘শেবাচিম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীর রক্তের গ্রুপ নির্নয়ে ব্যর্থ বেবীলন ডায়াগনস্টিক সেন্টার কর্তৃপক্ষকে দিতে হয়েছে ২০ হাজার টাকা জরিমানা। গতকাল সোমবার র্যাবের উপস্থিতিতে বেবীলন কর্তৃপক্ষ ওই জরিমানা দেয়। এদিকে ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে দৌড়ঝাপ শুরু করেছে বেবীলন কর্তৃপক্ষ। ঘটনার সময় বেবীলন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে উপস্থিত থাকা সাংবাদিকদের ম্যানেজের চেষ্টাও করে তারা।’
সংবাদ বিশ্লেষণে প্রতিয়মান, র্যাব পরিচয়দানকারীরা মোবাইল ফোনে যাকে সাংবাদিক বলে ডেকে নিয়ে আসে তিনি বরিশালে কর্মরত জাতীয় বা স্থানীয় কোন পত্রিকা বা টেলিভিশন মিডিয়ার সাথে সম্পৃক্ত নেই। তাহলে পত্রিকাটিতে প্রতিবেদক কিসের ভিত্তিতে দাবী করেছেন, তখন বেবীলন ডায়াগনস্টিক সেন্টার কর্তৃপক্ষ সাংবাদিক ম্যানেজের চেষ্টা করেন। ওদিকে র্যাব অভিযান না চালালেও তা পত্রিকায় র্যাবের অভিযান অ্যাখা দেওয়াটা উদ্দেশ্যমূলক। ধারণা করা হচ্ছে প্রতিবেদক র্যাব পরিচয়দানকারী চাঁদাবাজ ওই চক্রটির সাথে জড়িত রয়েছেন। এবিষয়ে গোয়েন্দা সংস্থা কাজ শুরু করলে প্রতিবেদনের পক্ষে কোনরুপ তথ্য সরবরাহ করতে পারেনি বলে জানা গেছে।
বেবীলন ডায়াগনস্টিকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য আলমগীর হোসেন সোহাগ জানিয়েছেন, তার বুঝতেই পারেননি যারা প্রশাসনের পরিচয় দিয়েছে তারা আসলে পুলিশ বা র্যাবের কেউ নন। আর এ বিষয়ে মুঠোফোনে তিনি বিস্তারিত কিছু বলবেন না বলে জানান। পরিচালনা পর্ষদের অপর সদস্য শামসুল হক বিষয়টি যা ঘটে গেছে তা নিয়ে তারা আর কোন ঘাঁটাঘাটি করতে চান না বলে জানান।
এ বিষয়ে র্যাব-৮’র কোম্পানি কমান্ডার মেজর সোহেল রানা প্রিন্স জানিয়েছেন, ১৯ ফেব্রুয়ারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে র্যাব কোন অভিযান পরিচালনা করেনি।
বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা শাখার উপ-কমশিনার সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ভিডিওটি আমি দেখেছি। যেহেতু সেটি সিসিটিভি ফুটেজ তাই সেটিতে কোন শব্দ শোনা যায়নি। ফলে কোন ধরনের উচ্চবাচ্য শব্দ শোনা যাবে না এটিই স্বভাবিক। তবে ভিডিওতে যাদের দেখা গেছে তারা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কেউ নন। এই কর্মকর্তা বলেন, এ ঘটনায় ভুক্তভোগী কেউ এখনো কোন অভিযোগ প্রদান করেননি। যদি কেউ অভিযোগ করেন তাহলে অবশ্যই আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করব।