আখতার-উজ-জামান : দেশের পোশাক শিল্পে সবচেয়ে বড় দূর্ঘটনা রানা প্লাজা ধসের পাঁচ বছর পূর্ণ হলো আজ। বিশ্বের রপ্তানী পোশাক শিল্পে এতো বড় অঘটন বাংলাদেশেই সর্ব প্রথম।
এখনো ঠিকমতো ক্ষতিপূরণ পাননি রানা প্লাজার সেসব ক্ষতিগ্রস্তরা। এখনও নির্ধারিত হয়নি দূর্ঘটনায় হতাহতদের পরিবারের ক্ষতিপূরণের হার। শারীরিক পঙ্গুত্ব নিয়ে দীর্ঘ মেয়াদী চিকিৎসা ছাড়াও নানা সমস্যায় নিদারুণ কষ্টে জীবনযাপন করছেন অনেকেই।
দিনটি ছিল বুধবার। প্রতিদিনের ন্যায় খেটে খাওয়া কর্মজীবি নারী-পুরুষ এসেছিল তাদের কর্মস্থল ৮তলা বিশিষ্ট রানাপ্লাজায়। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় ঐক্যজোটের হরতাল উপেক্ষা করে সঠিক সময়ে প্রবেশ করলো ভবনটিতে। এই ভবনের কয়েকটি পোশাক কারখানায় পাঁচ হাজারের বেশি শ্রমিক কাজ করতেন।
বিরোধী দলের কর্মসূচির বিভিন্ন খবরা-খবর সংগ্রহ করতে ব্যস্ত ছিল সংবাদকর্মীরাও। সকালের নাশতা সেরে অফিসে ঢুকতেই খবর এলো ভবন ধসের। বহুতল ভবন ধসে পড়েছে ঢাকার অদূরে, সাভারে। ভবনের নাম রানা প্লাজা। মুহূর্তের মধ্যে খবরটি সারাদেশে ছড়িয়ে পড়লো।
অফিসের সিদ্ধান্তে কিছু সময়ের মধ্যেই বিশেষ একটি টিম সংবাদ সংগ্রহের জন্য ঢাকা থেকে সাভারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো সংবাদ কর্মীরা। আমি নিজেও ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর কয়েক মাইল আগে থেকেই চোখে পড়ল হাজার হাজার মানুষের ভিড়। কিছু সময়ের মধ্যেই পৌঁছলাম রানা প্লাজার সামনে। দেখলাম বাঁচা আর বাঁচানোর লড়াই। ভবন ও কারখানা মালিকদের অর্থলিপ্সার নির্মম শিকার পোশাক শ্রমিকদের বাঁচানোর জন্য সরকারি উদ্যোগের অপেক্ষায় বসে থাকেনি সাধারণ মানুষ। দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে এসে খালি হাতেই অনেকে নেমে পড়েছেন উদ্ধার কাজে। প্রাণবাজি রেখে বহু পোশাক শ্রমিককে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরিয়ে আনেন তারা।
সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডে গড়ে ওঠা ভবন রানা প্লাজা ধসের কারণে রচিত হয় এক বেদনাদায়ক করুণ ইতিহাস।ভবন ধসে নিহত হয়েছিলেন ১১৩৫ জন পোশাক শ্রমিক। গুরুতর আহত হয়ে পঙ্গু হয়েছেন দুই হাজারেরও বেশি।
আজও গার্মেন্টস শ্রমিকরা সেই দিনের সেই ভয়াবহ ভবনধসের ঘটনার কথা মনে করে শিউরে ওঠে । হতাহত শ্রমিকদের সংখ্যা নিয়ে কোনো প্রশ্ন না উঠলেও নিখোঁজদের স্বজনরা প্রশ্ন তুলছেন নিখোঁজদের তালিকা নিয়ে। বিরামহীনভাবে টানা ২০ দিন উদ্ধার কার্যক্রম চালানোর পর ঐ বছরেরই ১৩ মে অভিযান শেষ করে সরকারী-বেসরকারী উদ্যোগে নিয়োজিত উদ্ধারকর্মীরা। উদ্ধারকাজ শেষ হলেও অনেক পরিবারই ফিরে পায়নি তাদের প্রিয় মানুষটিকে।
যারা এখনও বেঁচে আছেন, তাদের কেউ ঐ ভয়ঙ্কর দিনের কথা ভেবে এখনও কাঁতরাচ্ছেন। পঙ্গুত্ব জীবন নিয়ে বেঁচে আছেন অনেকেই। কোন রকম খেয়ে পরে একটি পরিবারের ছায়াতলে থাকার আশা নিয়ে বেঁচে থাকলেও এসব আহত-নিহতদের অনেকে আজও পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ পাননি। ধসের পর ক্ষতিগ্রস্থদের সহায়তায় এগিয়ে আসেন অনেকের পাশাপাশি দেশ-বিদেশী বিভিন্ন সংস্থা।
আহত ও নিহতদের ক্ষতিপূরণ দিতে ২০১৫ সালের ১৩ মার্চ আদালতের নির্দেশে রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানার ব্যক্তিগত সব সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে সরকার। রানা প্লাজা ধসের পাঁচ বছর পূর্ণ্ হল আজ। অথচ এই পাঁচ বছরেও ভবন মালিক সোহেল রানার বাজেয়াপ্ত সম্পদের ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত হয়নি, এ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
শ্রমিক নেতাদের আশঙ্কা সরকারের উদাসীনতার কারণে বিপুল অর্থের এই সম্পদ ক্ষতিগ্রস্তদের হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। এসব সম্পত্তি দ্রুত নিলামে তুলে প্রাপ্ত অর্থ হতাহতদের মধ্যে বন্টন করে দেওয়ার দাবী তুলেছেন তারা।
তবে এসব সম্পদ আবার ফিরে পাওয়ার আশা এখনও ছাড়েননি ভবন মালিক সোহেল রানার বাবা আব্দুল খালেক ওরফে কুলু খালেক। তিনি আশা করছেন, আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শিগগিরই এসব সম্পদের ভোগ দখল ফিরে পাবেন তারা।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ- এইচআরডাব্লিউ বলছে, রানা প্লাজার পোশাক কারখানাগুলোতে যদি শ্রমিক ইউনিয়ন থাকত, তাহলে হতাহতের সংখ্যা অনেক কম হতো। এই সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, রানা প্লাজার কোনো পোশাক কারখানাতেই নাকি শ্রমিক ইউনিয়ন ছিল না। তাদের কথায়, যদি ঐ সব কারখানায় শ্রমিকদের সংগঠন থাকত, তাহলে ফাটল দেখা দেয়ার পরও জোর করে পোশাক শ্রমিকদের সেখানে কাজ করানো যেত না। আর তেমনটা হলে ভবন ধসে পড়লেও শ্রমিকরা সেখানে থাকতেন না, অর্থাৎ এত প্রাণহানি ঘটত না।
লেখক : একটি বেসরকারী টিভি চ্যানেলে কর্মরত।