সোশাল মিডিয়ার ক্ষতিকর কন্টেন্ট থেকে শিশুদের রক্ষা করবেন যেভাবে

বিডিমেট্রোনিউজ ডেস্ক ॥ সোশাল মিডিয়া সাইটগুলোতে তার পাঠকদের জন্য নানা ধরনের রেকমেনডেশন পাঠানোর জন্য যেসব প্রোগ্রাম দেয়া থাকে তা শিশুদের ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দেয়। মানসিক অবসাদ কিংবা আত্মহত্যার জন্য তথ্য খুঁজছে যে টিনএজার তার কাছে এসব রেকমেনডেশন ইঞ্জিনগুলো আরও বেশি করে তথ্য পাঠায়।

সোফি পার্কিনসন যখন আত্মহত্যা করে তখন তার বয়স মাত্র ১৩। সে মানসিক অবসাদে ভুগছিল এবং আত্মহত্যার চিন্তা করছিল। তার মা রুথ মস-এর বিশ্বাস সোফি অনলাইনে যেসব ভিডিও দেখেছে সেগুলো থেকে সে আত্মহত্যায় প্ররোচনা পেয়েছ। অনেক তরুণের মতোই সোফিকেও ১২ বছর বয়সে মোবাইল ফোন কিনে দেয়া হয়েছিল। কিছুদিন পরেই তার মা টের পান যে সে ঐ ফোন ব্যবহার করে অনলাইনে এমন সব কন্টেন্ট দেখছে যা তার জন্য মোটেও উপযুক্ত নয়।

তিনি বলেন, আমার পরিবারের জন্য সবচেয়ে কষ্টের ব্যাপার হলো যখন মৃত্যুর পর আমরা জানতে পারলাম যে সে এমন কিছু ছবি আর গাইড দেখেছে যেখানে কীভাবে আত্মহত্যা করতে হয় তার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে ।

ব্রিটেনের টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ অফকম-এর হিসেব অনুযায়ী, ১২-১৫ বছর বয়সীদের শতকরা ৯০ জনের হাতে মোবাইল ফোন রয়েছে। এদের মধ্যে প্রতি চার জনের তিনজনের এখন সোশাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টও রয়েছে।

আইন অনুযায়ী জনপ্রিয় অ্যাপগুলোতে ১৩ বছর বয়সের নীচে কাউকে অ্যাকাউন্ট খুলতে দেয়ার কথা না। কিন্তু তা সত্ত্বেও শিশুরা এসব অ্যাকাউন্ট তৈরি করছে এবং তাদের ঠেকাতে সোশাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলো কিছুই করছে না।

ব্রিটেনের শিশু রক্ষা চ্যারিটি ন্যাশনাল সোসাইটি ফর দা প্রিভেনশন অফ ক্রুয়েল্টি টু চিল্ড্রেন্স (এনএসপিসিসি) বিশ্বাস করে, শিশুরা এসব কন্টেন্ট দেখে যে ঝুঁকির মুখে পড়ছে তা বিবেচনা করার জন্য আইন তৈরি করে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলিকে বাধ্য করা উচিত।

এনএসপিসিসি শিশু-রক্ষা নীতি বিভাগের প্রধান অ্যান্ডি বারোজ বলেন, এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলি তাদের ব্যবসার মূল বিষয় হিসেবে শিশুদের নিরাপত্তার দিকটা নিয়ে মোটেও চিন্তা করছে না। এই সাইটগুলো এমনভাবে তৈরি হয়েছে যা দুর্বল টিনএজার, যারা নিজের ক্ষতি করার কথা ভাবছে, তাদের কাছে এই ধরনের কন্টেন্ট বেশি বেশি পাঠিয়ে তাদের আরও বেশি ঝুঁকির মুখে ফেলে দিচ্ছে।

নজর রাখুন, মুছে ফেলুন

সম্প্রতি আত্মহত্যা করছেন এমন এক তরুণের ভিডিও ফেসবুকে পোস্ট করা হয়েছে। ভিডিও ফুটেজটি পরে অন্যান্য প্ল্যাটফর্মে ছড়িয়ে পড়ে। জনপ্রিয় ভিডিও প্ল্যাটফর্ম টিকটক-এ এই ক্লিপটি বেশ কিছুদিন ধরে ছিল।

টিকটক কর্তৃপক্ষ স্বীকার করছে, সোশাল মিডিয়া কোম্পানিগুলো যদি একসাথে কাজ করে তাহলে তাদের ব্যবহারকারীদের নিরাপত্তা আরও ভালভাবে রক্ষা করা সম্ভব হবে।

সোফির মা রুথ মস এখানে এনএসপিসসি’র সাথে একমত। তিনি মনে করেন এসব বিষয়ে নজরদারির দায়িত্ব সোশাল মিডিয়া কোম্পানিগুলির হাতে রাখা উচিত না। তিনি জানান, তার মেয়ে ছয় বছর আগে অনলাইনে যেসব কন্টেন্ট দেখেছিল তার অনেক কিছু এখনও দেখা যায়। ফেসবুক কিংবা ইনস্টাগ্রামে নির্দিষ্ট কিছু শব্দ টাইপ করলে সেই সব ছবি এখনও দেখতে পাওয়া যায়।

ফেসবুক ঘোষণা করেছে, আত্মহত্যা ও ক্ষতিকর কন্টেন্ট খুঁজে বের করতে এবং দূর করতে তারা ইনস্টাগ্রামে তাদের অটোমেটেড টুল-এর পরিধি আরও বাড়িয়ে দেবে। কিন্তু ফেসবুক বলছে, ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষার ওপর ইউরোপের আইন এতই কঠোর যে এক্ষেত্রে তাদের খুব বেশি কিছু করার থাকে না। অন্যান্য ছোট স্টার্ট-আপগুলো এখন এই সমস্যার সমাধানে প্রযুক্তি ব্যবহার শুরু করেছে।

‘সেফটুওয়াচ’ নামে একটি কোম্পানি এক সফটওয়্যার তৈরি করছে যা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স প্রযুক্তি ব্যবহার করে সহিংসতা কিংবা নগ্নতার ছবি তাৎক্ষণিকভাবে ব্লক করতে পারবে। এই সফটওয়্যারটি অডিও মনিটর করতে পারে এবং যে কোন ভিস্যুয়াল কন্টেন্টের প্রাসঙ্গিকতা বিশ্লেষণ করতে পারে। কোম্পানিটি বলছে, এর ফলে অভিভাবক যেমন তাদের ছেলে-মেয়েদের সুরক্ষা দিতে পারেন, তেমনি তরুণদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তাও খুব একটা ক্ষতিগ্রস্ত হয় না।

কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা রিচার্ড পার্সি বলছেন, তরুণরা কী করছে আমরা সেটা অন্য কাউকে দেখতে দেই না। কারণ সাইবার নিরাপত্তার জন্য যা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তা হলো শিশুর আস্থা অর্জন করা।

খোলামেলা আলোচনা

রুথ মস বলেন, এই সমস্যার জন্য প্রায়ই অভিভাবককে দোষ দেয়া হয়। শিশুরা যত বড় হতে থাকে, যতই স্বনির্ভর হতে থাকে প্রযুক্তি দিয়ে তাদের সাহায্য করার সুযোগ ততই সীমিত হয়ে পড়ে। তাদের টিনএজ সন্তানের মোবাইল ফোনে কী ঘটছে বেশিরভাগই মা-বাবাই তা জানতে পারেন না কিংবা নজর রাখতে পারেন না।

বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞই মনে করেন, বেশিরভাগ শিশুই কোন না কোন সময়ে অনলাইনে এ ধরনের অনুপযুক্ত কন্টেন্টের মুখোমুখি হবে। তারা পরামর্শ দিচ্ছেন, শিশুদের মধ্যে ‘ডিজিটাল প্রতিরোধ’ ক্ষমতা বাড়াতে হবে।

মনস্তত্ত্ববিদ ড. লিন্ডা পাপাডোপুলাস বলেন, নিরাপদ জীবন যাপনের জন্য অন্যান্য বিষয়ে যেভাবে শিশুদের শিক্ষা দেয়া হয়, তেমনি অনলাইনে নিরাপদ থাকার দক্ষতাও শিশুদের মধ্যে গড়ে তুলতে হবে। অনলাইনে কী ধরনের বিষয়বস্তু রয়েছে সে সম্পর্কে ছেলে-মেয়েদের সাথে খোলামেলা আলোচনা করতে হবে, এবং কীভাবে তারা এসব বিষয় থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারে সেই শিক্ষাও দিতে হবে।

তিনি জানান, অনলাইনে পর্নোগ্রাফি দেখার সুযোগ হয়েছে যেসব শিশুর তাদের গড়পড়তা বয়স ১১ বছর। তার পরামর্শ হচ্ছে, যদি আপনার বাচ্চা এরকম কিছু করে, তাহলে তার হাত থেকে মোবাইল ফোনটি ছিনিয়ে না নিয়ে তার সাথে বসে বিষয়টি তাকে বুঝিয়ে বলুন। যে কোন হঠকারী সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে ঠাণ্ডা মাথায় বিষয়টি নিয়ে নিজে চিন্তাভাবনা করুন।

  • টালিয়া ফ্র্যাঙ্কো, বিবিসি ক্লিক

Print Friendly

Related Posts