ভাঙারির দোকানে মুক্তিযোদ্ধার ভাস্কর্য


একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ সদ্য স্বাধীন হয়েছে। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা অস্ত্র উঁচিয়ে বিজয়োল্লাস করছেন। তার সামনে আরেক মুক্তিযোদ্ধার এক হাতে অস্ত্র, অন্য হাতে উড়িয়ে দিচ্ছেন পায়রা। মুক্তিযুদ্ধের এমন থিমে কয়েক বছর ধরে একটি ভাস্কর্য বানিয়েছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) গ্রাফিক ডিজাইন, কারুশিল্প এবং শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক আমিরুল মোমেনিন জোসি। কোথাও স্থাপন করতে না পেরে শেষে ভাঙারির দোকানে নামমাত্র মূল্যে ভাস্কর্যটি বিক্রি করে দিয়েছেন তিনি।

সম্প্রতি নগরের বিনোদপুর বাজারের এক ভাঙারি ব্যবসায়ী আমিরুল মোমেনিনের স্টুডিও থেকে ভাস্কর্য দুটি কিনে এনেছেন। এখন বিনোদপুর বাজারে খোকন নামের ওই ব্যবসায়ীর দোকানের সামনে পড়ে আছে ভাস্কর্যটি। দোকানটির নাম ‘খাকন আয়রন ঘর’। খোকন আছেন ক্রেতার অপেক্ষায়। কেউ না কিনলে ভাস্কর্য দুটি ভেঙে লোহা হিসেবে বিক্রি করবেন তিনি।

ভাঙারি ব্যবসায়ী খোকন বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধার ভাস্কর্য দুটির ভেতরে পুরো লোহার বিম দিয়ে জালি করা আছে। বাইরের অংশটা এসএস পাইপ এবং স্টিল দিয়ে তৈরি। এটায় কখনো মরিচা ধরবে না। উচ্চতায় এটি প্রায় ১৮ ফুট।’

খোকন জানান, দুই লাখ টাকায় তিনি ভাস্কর্যটি বিক্রি করবেন।

তবে ভাস্কর আমিরুল মোমেনিন জোসি জানালেন, মাত্র ৯ হাজার ৪০০ টাকায় ভাস্কর্যটি বিক্রি করেছেন তিনি। এটি তৈরিতে তার খরচ হয়েছে প্রায় ৬০ হাজার টাকা। নগরের মেহেরচণ্ডিতে লম্বা সময় ধরে নিজের স্টুডিওতেই ভাস্কর্য দুটি তৈরি করেন তিনি। কোথাও স্থাপন করতে না পেরে আক্ষেপ নিয়ে শেষে ভাঙারির দোকানে ভাস্কর্য দুটি বিক্রি করে দিয়েছেন।

শিল্পী আমিরুল মোমেনিন জোসির করা সাঁওতাল মুক্তিযোদ্ধার ভাস্কর্য ২০১১ সালের দিকে দিনাজপুরের পাঁচবিবিতে স্থাপন করা হয়। রাজশাহী কলেজের শহীদ মিনারের পেছনে রয়েছে তাঁর করা একটি ম্যুরাল। ভাষা-আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের থিমে এই ম্যুরালটি করা হয়। এছাড়া রাজশাহী কলেজেই আরেকটি অ্যাম্বুস রয়েছে তাঁর। রাজশাহীর ইতিহাস নিয়ে অ্যাম্বুসটি করা।

অধ্যাপক আমিরুল মোমেনিন জোসি বলেন, ‘সারাদেশে আমার ও আমার স্টুডেন্টদের করা প্রায় ২০০ ভাস্কর্য ছিল। অনেক জায়গায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ছিল, সেগুলো আমার বা আমার স্টুডেন্টের হাতে করা। ৫ আগস্ট টেলিভিশনে দেখলাম, অনেক ভাস্কর্য ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এটা তো একজন শিল্পীর জন্য কষ্টের। নিজের চোখে এসব দেখাও যায় না।’

তিনি বলেন, ‘বর্তমান প্রেক্ষাপটে মুক্তিযোদ্ধার ভাস্কর্যটি কোথাও বিক্রি করা সম্ভব না। এটি এখন নিছকই ‘মূর্তি’। এটি কোথাও স্থাপন করা সম্ভব বলেও মনে করি না। তাই ভাঙারির দোকানে বিক্রি করে দিয়েছি। এটা একজন শিল্পীর জন্য কতটা কষ্টের তা বলে বোঝানো যাবে না।’

তিনি বলেন, ‘ওই ব্যবসায়ীকে বলেছিলাম ভেঙে লোহা হিসেবে যেন সে নিয়ে যায়। কিন্তু সে অক্ষত অবস্থায় নিয়ে গিয়ে দোকানের সামনে ফেলে রেখেছে। আমার কাছে ফোন আসছে। কষ্টটাও বাড়ছে।’

তিনি জানিয়েছেন, ভাস্কর্যটি নিয়ে হইচই শুরু হওয়ায় দোকানিও এটা নিয়ে বিপদে পড়েছেন। তিনি এটা ফেরত দিতে পারেন। যদি ফেরত দেন, তাহলে কেউ যদি কোথাও এটি স্থাপন করতে চান, তাহলে অধ্যাপক আমিরুল মোমেনিন সেটা করে দেবেন। প্রতিস্থাপনের আগে এই ভাস্কর্যের আরও কিছু কাজ করা প্রয়োজন, সেটিও তিনি করে দেবেন।

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts