পলিথিনের বিকল্প ‘বায়োটেক’ ব্যাগ

শিরিন সুলতানা কেয়া : দেখতে হুবহু পলিথিন, কিন্তু এটি পলিথিন নয়। তারপরেও পলিথিনের মতোই এ ব্যাগে পানিও বহন করা যায়। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর পলিথিন পচে না। তবে বিশেষ এই ব্যাগ পচনশীল। এই ব্যাগ তৈরিতে ব্যবহার হয় ভুট্টার উপাদান।

রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার চাপাল এলাকায় চার বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এই ব্যাগ তৈরির কারখানা। এর উদ্যোক্তা ইফতেখারুল হক। তার প্রতিষ্ঠানের নাম ক্রিস্টাল বায়োটেক।

নিজের কারখানায় তৈরি পরিবেশবান্ধব ব্যাগ তিনি বাজারজাত করছেন ‘বিটি ব্যাগ’ নামে। বিটি শব্দটি ইংরেজি ‘বায়োটেক’ বা বাংলা ‘জৈব প্রযুক্তি’ শব্দের সংক্ষিপ্ত রূপ। প্লাস্টিক ব্যাগের সমাধান স্লোগানে এই ব্যাগ বাজারে ছাড়ছেন ইফতেখারুল। এখন বেশ ভাল সাড়াও পাচ্ছেন তিনি।

ব্যবসায় প্রশাসনে পড়াশোনা শেষ করে পাটশিল্পে ক্যারিয়ার গড়েছিলেন রাজশাহী নগরের কাজীহাটার বাসিন্দা ইফতেখারুল হক। তখন দেখেন, পলিথিনের কারণে দেশের পাটশিল্পের বিকাশ হচ্ছে না। ইফতেখারুল ভাবতে থাকেন, পাটের ব্যাগ দিয়ে আসলে পলিথিনকে ঠেকানো সম্ভব না। পলিথিনকে আটকাতে হলে পলিথিনের মতোই বিকল্প কিছু প্রয়োজন।

তারপর ঘাঁটাঘাটি শুরু করেন ইন্টারনেটে। তখন বিশ্বের বেশকিছু দেশে পেয়ে যান জার্মান টেকনোলজির ভুট্টার বায়োটেক ব্যাগ। ২০২০ সালের শুরুর দিকে তিনি ভারতের আহমেদাবাদে যান এই ব্যাগ তৈরির একটি কারখানা পরিদর্শনে। দেখে সবকিছুই পছন্দ হয়। তারপর সেখানেই এই ব্যাগ তৈরির কাঁচামাল এবং কারখানার বিভিন্ন যন্ত্র অর্ডার দিয়ে আসেন। ওই বছরের এপ্রিলে সবকিছুই চলে আসে। তারপর পতিত পড়ে থাকা গোদাগাড়ীর ওই জায়গাটিতে স্থাপন করেন কারখানা। নভেম্বরের মধ্যেই শুরু হয় উৎপাদন।

ইফতেখারুল বললেন, ‘আমার এই কারখানা করার কারণ পলিথিনের ওপর রাগ থেকে বলতে পারেন। কারণ, আমি পাটের দুর্দিন দেখেছি। এই পলিথিনের কারণেই পাটশিল্পের বিকাশ হয়নি।’

দেখতে একেবারেই পলিথিন ব্যাগের মতোই এই ব্যাগ। তবে ওজনে পলিথিনের চেয়ে কিছুটা ভারি। পলিথিনের মতো এই ব্যাগে যে কোনো পণ্য বহন করা যায়। এমনকি পানিসহ মাছও নেওয়া যায়। এ ব্যাগে খাবার রাখাও নিরাপদ। ইফতেখারুল সম্প্রতি একটি পলিথিন ও একটি বায়োটেক ব্যাগে ২০ দিন কাঁচামরিচ রেখেছিলেন ফ্রিজে। দেখা গেছে, পলিথিনের ভেতর পানি জমে কাঁচামরিচ নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু বায়োটেক ব্যাগের ভেতরটা ছিল শুকনো। কাঁচামরিচের কোন ক্ষতি হয়নি। বছরের পর বছর পলিথিন যখন মাটিতে পচে না, তখন বায়োটেক ব্যাগ ব্যাকটেরিয়ার ছোঁয়ায় ছয় মাসের মধ্যে প্রকৃতিতে বিলীন হয়ে যায়। তাই এই ব্যাগ শতভাগ পরিবেশবান্ধব বলছেন ইফতেখারুল।

ক্রিস্টাল বায়োটেকের কর্ণধার ইফতেখারুল জানালেন, মসুর ডালের মতো সাদা সাদা একটি কাঁচামাল ভারত থেকে আমদানি করতে হয় এই ব্যাগ তৈরির জন্য। এই বায়োপ্লাস্টিকটিই ব্যাগ তৈরির একমাত্র উপাদান। এটিতে থাকে ক্যালসিয়াম কার্বোনেট, পিএলএ, পিবিএটি এবং ভুট্টার দানার ভেতরের সাদা অংশ। তাই ব্যাগটি ভুট্টার ব্যাগ হিসেবেই পরিচিতি পেয়েছে। ব্যাগ তৈরির ওই কাঁচামালটিতে ওয়ানস্টার্চসহ থাকে আরও কিছু বায়ো মেটারিয়াল।

যদিও ইফতেখারুল তার কারখানার জন্য আবেদন করে রাখলেও এখনও পর্যন্ত পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র পাননি। বুয়েটে ব্যাগ পরীক্ষার আগে ছাড়পত্র দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর। আর বিএসটিআই মৌখিকভাবেই ব্যাগ তৈরির অনুমোদন দিয়েছে ইফতেখারুলকে।

শুরুর দিকে ইফতেখারুল হক শুধু রাজশাহীর বাজারেই এই ব্যাগ দিতেন। দিনে দিনে তার পরিবেশবান্ধব এই ব্যাগের কথা ছড়িয়ে পড়ে। বাড়তে থাকে চাহিদাও। এখন দেশের নানাপ্রান্ত থেকেই কারখানায় অর্ডার আসছে। শুধু তাই নয়, ইতোমধ্যে দুবাইয়ে রপ্তানি হয়েছে এই ব্যাগ। আমেরিকা, কানাডা, ইংল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডে নমুনা পাঠানো হয়েছে। রপ্তানির বিষয়ে আলোচনা চলছে।

বর্তমানে ইফতেখারুলের কারখানায় এখন ৮ জন কর্মী ব্যাগ তৈরি করে যাচ্ছেন। কারখানার যন্ত্রাংশে প্রতিদিন দুই লাখ পিস বা দুই টন ব্যাগ উৎপাদন সম্ভব। এখন উৎপাদন হচ্ছে ৩০ হাজার পিস। বায়োটেক ব্যাগের দাম অবশ্য পলিথিনের চেয়ে কিছুটা বেশি। ১ কেজি পণ্য রাখা যায় এমন ব্যাগ কারখানা থেকে বিক্রি করা হয় প্রতি পিস ২ টাকা। এছাড়া দেড় কেজির ব্যাগ ৩ টাকা ও ৩ কেজির ব্যাগ ৫ টাকায় বিক্রি করা হয় কারখানা থেকে।

ইফতেখারুল দাবি করেন, দেশে তিনিই প্রথম পরিবেশবান্ধব এই ব্যাগ তৈরি শুরু করেন। তারপর আরও দু’এক জায়গায় শুরু হয়েছে। তিনি চান, এই ব্যাগ তৈরির কারখানা ছড়িয়ে পড়ুক। এখন দেশের নানাপ্রান্ত থেকেই উদ্যোক্তারা তার কারখানা পরিদর্শনে আসেন। গত শনিবার সকালে ইফতেখারুল যখন এসব কথা বলছিলেন, তখনও কারখানায় আসেন দুই উদ্যোক্তা। এদের একজন মোফাজ্জল হোসেন। তার বাড়ি জয়পুরহাটের কালাই উপজেলায়।

তিনি জানান, ফেসবুকে তিনি এই কারখানার সম্পর্কে জানতে পেরেছেন। তাই দেখতে এসেছেন যদি তিনিও একটা কারখানা করতে পারেন। বগুড়ার শেরপুরের অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকুরে মো. মনিরুজ্জামান থাকেন ঢাকায়। তিনিও আসেন কারখানা পরিদর্শনে। বললেন, ‘এটার সম্পর্কে জানতে পেরে কাউকে কিছু না জানিয়েই ঠিকানা অনুযায়ী ঢাকা থেকে চলে এসেছি। নিজে কিছু করা যায় কি না তা দেখার জন্যই আসা। উৎপাদন প্রক্রিয়া খুবই সহজ।’

ইফতেখারুল স্বপ্ন দেখেন একদিন দেশে কোন পলিথিনের ব্যাগ থাকবে না। তিনি বলেন, ‘আমি তো অন্য ব্যবসাও করতে পারতাম। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে পলিথিনের ব্যাগের বিরুদ্ধে আমি এই প্রতিষ্ঠান গড়েছি।’

সম্প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পলিথিন নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় সাধুবাদ জানান তিনি। ইফতেখারুল সম্প্রতি পরিবেশ অধিদপ্তরের এক মেলায় অংশ নিয়েছিলেন। ওই মেলায় তিনি পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানকে তার পরিবেশবান্ধব ব্যাগ দেখিয়েছেন। পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকও এটি দেখে খুশি হয়েছেন।

ইফতেখারুল বলেন, ‘উপদেষ্টা এই ব্যাগ সম্প্রসারণের ব্যাপারে আমাদের সঙ্গে বসতে চেয়েছেন। আমি উপদেষ্টাকে বলেছি, পলিথিনের সব কারখানাকেই এই বায়োটেক ব্যাগ তৈরির কারখানায় রূপান্তর করা সম্ভব। অল্প কিছু খরচ হবে। কোন শ্রমিক বেকার হবে না। দেশের সব পলিথিন কারখানাকে বায়োটেক ব্যাগ তৈরির কারখানায় রূপান্তর করতে যা যা সহযোগিতা প্রয়োজন, তার সবই আমি করতে চেয়েছি। আমি চাই, পলিথিন বিলুপ্ত হয়ে যাক।

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts