ডা. লায়লা শিরিন
প্রতি বৎসর ৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ক্যান্সার দিবস বা বিশ্ব ক্যান্সার সচেতনতা দিবস পালন করা হয়। আজ বিশ্ব ক্যান্সার দিবস। এই ক্যান্সার দিবসটিতে মহিলাদের বলতে চাই, যাতে তারা আরও সচেতন হন, বুঝতে পারেন, ঝুঁকিগুলো এড়িয়ে কিভাবে ভালো থাকা যায়।
প্রথমতঃ স্তন ক্যান্সার। আজ-কাল চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নত হবার কারণে এটি অত্যন্ত ভালো প্রগ্নোসিস, বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ভালো । আমরা খুব বেশি জোর দেই প্রথমেই ক্যান্সার প্রতিরোধ আর ক্যান্সার আক্রান্ত হলে আগেই নির্নয় এর উপর।
এজন্য খুব জরুরি খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন, ওজন নিয়ন্ত্রণ, পরিমিত ব্যায়াম। এ ছাড়াও পারিবারিক ইতিহাস জানা। সঠিক সময়ে বিয়ে আর সন্তান জন্মদান, নিয়মিত স্তন্যদান ইত্যাদি জরুরি। আজকাল মেয়েদের এই রোগে আক্রান্ত হবার হার অনেক বেশী। একইভাবে সচেতনতাও জরুরি।
বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ আর স্ক্রিনিং ম্যামোগ্রাম ছাড়াও নিজেই নিজের স্তন পরীক্ষা করা যেতে পারে। যার ফলে স্তনের পরিবর্তন সাথে সাথেই ধরতে পারার মাধ্যমে আমরা এই রোগটি সহজেই নিরাময়যোগ্য পর্যায়ে নির্নয় করতে পারি।
আসুন “নিজেই নিজের স্তন পরীক্ষা “এ বিষয় নিয়ে একটু আলোচনা করি:
নিজে নিজের স্তন পরীক্ষা স্তন ক্যান্সার প্রাথমিকভাবে নির্নয় এর জন্যে গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত ২০ বছর বয়স থেকে সব মেয়েদেরই এই পরীক্ষা করা উচিৎ। প্রতি মাসে একবার। সাধারণত মাসিক শুরু হবার পর, প্রথম ১০ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে। যদি কারো মাসিক না হয় তখন ক্যালেন্ডারের পাতায় দাগ দিয়ে রাখবেন, যেদিন স্তন পরীক্ষা করবেন সেদিন (সাধারণত ব্যাথা যেদিন কম থাকে সেদিন চেক করবেন)। পরের মাসগুলোয় এই দিনে স্তন পরীক্ষা করুন। গর্ভবতী এবং স্তন্যদানের সময়ও স্তন পরীক্ষা করবেন। কারণ এই সময়ের ক্যান্সার সাধারণত মিস হয় বেশি, যার কারণে বেশিরভাগ খারাপ অবস্থা হয়ে যায়। তাই এটি অভ্যাসে পরিনত করুন। নিজের খেয়াল নিজেই রাখুন।
জরায়ু মুখের ক্যান্সার
আমাদের দেশে এই রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। কম বয়সে বিয়ে, অধিক সন্তান জন্মদান, ঠিকমত পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা না বজায় রাখা, কিছুক্ষেত্র বহুবিবাহ বা বহুসংগী থাকা। একটা কথা মনে রাখা জরুরি যে এটার কারণ সমন্ধে যদি সবাইকে জানানো যায় তাহলেই এটি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব। শুধু জানা নয়, জানতে হবে, জানাতে হবে, শেয়ার করতে হবে আর তাহলেই প্রতিরোধ করা যাবে, সর্বসাধারণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে।
যেমন: বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ, অধিক সন্তান প্রসব নিরুৎসাহিত করা, ধুমপান, পানের সাথে জর্দা, সাদা পাতা, গুল বর্জন করা ইত্যাদি। আর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, সুশৃঙ্খল জীবনযাপন ও সামাজিক অনুশাসন মেনে চলা। এর পাশাপাশি নারীর নিয়মিত পেপস স্মেয়ার টেস্টে অংশ নেওয়া। এতে করে রোগ আগে শনাক্ত করা সম্ভব হবে। এখন কিন্তু এই রোগ প্রতিরোধ এর টিকাও বেড়িয়ে গেছে। কাজেই সন্তান ধারণের বয়সে টিকা নিন। রোগ প্রতিরোধ করুন। আর এই রোগের প্রগ্নোসিস (রোগের সম্ভাব্য পরিনতি সম্পর্কে পূর্বাভাস) কিন্তু খুবই ভালো যদি প্রাথমিক পর্যায়ে নির্নয় করা যায়।
পায়ুপথের ক্যান্সার
যদিও এই ক্যান্সার পুরুষদের কিছু বেশি হয়, তারপরেও মহিলাদের কঞ্জার্ভেটিভ মানসিকতার কারণে এ রোগটি যাদের হয় তাদের খুবই খারাপ অবস্থা হয়ে যায়। আমাদের এখনকার পর্যবেক্ষণ হলো স্তন ক্যান্সার এর সচেতনতা অনেকটা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রচারণার কারণে। কিন্তু একইভাবে আমাদের বিশেষত যারা পর্দানশিন বা যারা খুব লজ্জিত হন ব্যাক্তিগত সমস্যা বলতে, তারা পায়ুপথের সমস্যা এড়িয়ে যান বা লুকিয়ে রাখেন। অনেকেই মহিলাদের কাছেও সহজ হতে পারেন না। ফলে পায়ুপথের ক্যান্সার অনেকটা ছড়িয়ে যাবার পরে এটি ধরা পড়ে। কিন্তু স্তন ক্যান্সার এর মত পায়ুপথের ক্যান্সারও নিরাময়যোগ্য। আগে ধরা পড়লে বেঁচে থাকার হার অনেক বেশী।
পায়ুপথে যদি তাজা রক্ত না গিয়ে মরা রক্ত, আমযুক্ত রক্ত, পেটে মোচড় দিয়ে অথবা কালো দুর্গন্ধযুক্ত পায়খানা হয় এগুলো ক্যান্সার এর লক্ষ্মণ হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি। বিশেষত যদি একদম মলদ্বারের কাছে না হয়ে ক্যান্সার যদি উপরের দিকে হয়, সে ক্ষেত্রে রোগীর একমাত্র লক্ষ্মণ শুধু রক্ত শুন্য এবং ফ্যাকাসে হতে পারে।
ব্যাথা-বেদনা আর পায়খানা করার সময় ফোটা ফোটা রক্তপাত, এটি খুবই কম ক্যান্সার এর কারণে হয়। সাধারণত এটিকে “এনাল ফিসার” বলে পায়ুপথ ছিড়ে রক্তপাত হয় এবং ছোট্ট একটি অপারেশনে এটি ভালো হয়ে যায়। কখনো কখনো অপারেশন না করে শুধু খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করেও রোগী ভালো থাকতে পারেন।
কিন্তু ব্যাথা-বেদনা ছাড়া রক্তপাত অনেকে সহ্য করে থাকেন। ভাবেন এটা খারাপ কিছুই না। মনে রাখবেন বেশিরভাগ ক্যান্সারে প্রাথমিকভাবে ব্যাথা থাকেনা। সে কারণে রোগীরা অপেক্ষা করেন আর রোগ নিরাময়ের পর্যায়ের অনেক পরে তারা চিকিৎসার জন্য আসেন।
শুধু মাত্র DRE বা পায়ুপথের আংগুলের যে পরীক্ষা ডাক্তার করে থাকেন তাই দিয়েও অনেক আগেই বেশিরভাগ পায়ুপথের ক্যান্সার শনাক্ত করা সম্ভব। আর সাথে কোলোনোস্কপি করা জরুরি।
এছাড়াও আমাদের দেশের মহিলাদের পান, গুল, তামাক, জর্দা ব্যবহার করার কারণে মুখ ও মুখগহ্বর এর ক্যান্সারের ঝুঁকিও অনেক বেশী। পাশাপাশি ধুমপান প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যেভাবেই হোক না কেনো ফুসফুসের ক্যান্সার ছাড়াও স্তন এবং অন্যান্য বেশিরভাগ ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। কাজেই এই সমস্ত বিষয় নিয়ে শুধু মহিলাদের নয় বরং সমস্ত দেশের জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আসুন আমরা সকলে মিলে আজকের বিশ্ব ক্যান্সার দিবসের দিনে এই সমস্ত বিষয় নিয়ে সচেতন হই, সচেতনতা বৃদ্ধি করার জন্য কাজ করি, সমাজের সবার অংশগ্রহণ আর সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করি। আমরা নিশ্চয়ই সম্মিলিত প্রচেষ্টার দ্বারা ক্যান্সার জয় করতে পারবো।
ডা. লায়লা শিরিন সহযোগী অধ্যাপক, ক্যান্সার সার্জারি, জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল।
চেম্বার: কনসালটেন্ট, সার্জারি (স্তন,পায়ুপথ, খাদ্যনালীর ক্যান্সার ও ল্যাপারস্কপিক সার্জারি বিশেষজ্ঞ) ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল, মতিঝিল, ঢাকা।