গুলশানের ফ্ল্যাটে তরুণীর লাশ, বসুন্ধরার এমডি’র দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

বিডিমেট্রোনিউজ ডেস্ক ॥ রাজধানীর গুলশানের একটি ফ্ল্যাট থেকে এক তরুণীর লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। ওই তরুণীর নাম মোসারাত জাহান (মুনিয়া)। তিনি রাজধানীর একটি কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিলেন।

সোমবার (২৬ এপ্রিল) সন্ধ্যার পর গুলশান-২ নম্বরের ১২০ নম্বর সড়কের একটি ফ্ল্যাট থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয় বলে জানিয়েছে পুলিশ।

মোসারাত জাহানের বাড়ি কুমিল্লা শহরে। তার বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিকুর রহমান। মেয়েটির পরিবার কুমিল্লায় থাকে। এখানে ওই ফ্ল্যাটে তিনি একাই থাকতেন।

পুলিশ জানায়, মোসারাত জাহান রোববার তার বড় বোনকে ফোন করে বলেন, তিনি ঝামেলায় পড়েছেন। এ কথা শুনে তার বড় বোন সোমবার কুমিল্লা থেকে ঢাকায় আসেন। সন্ধ্যার দিকে ওই ফ্ল্যাটে যান তিনি। দরজায় ধাক্কাধাক্কি করলেও বোন দরজা খুলছিলেন না। এরও কিছুক্ষণ আগে থেকে বোনের ফোন বন্ধ পাচ্ছিলেন। পরে বাইরে থেকে ‘লক’ খুলে ঘরে ঢুকে বোনকে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলতে দেখেন। পরে তিনি বাড়িওয়ালাকে বিষয়টি জানান। তখন পুলিশকে খবর দেওয়া হয়।

সোমবার দিবাগত রাত পৌনে একটার দিকে গুলশান থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ইমরান হোসেন মোসারাতের লাশের সুরতহাল করে তার লাশ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে রেখে যায়। পুলিশ সিসি ক্যামেরার ফুটেজ এবং মোসারাতের ব্যবহৃত ডিজিটাল ডিভাইসগুলো জব্দ করেছে।

গুলশান থানার ডিউটি অফিসার (এসআই) ফুলকুমার বলেন, এ ঘটনায় মোসরাতের বোন বাদি হয়ে একটি মামলা করেছে।

এদিকে রাজধানীর গুলশানের ফ্ল্যাট থেকে তরুণীর মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সায়েম সোবহান আনভীরের বিদেশে যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত।

আজ মঙ্গলবার ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের বিচারক শহিদুল ইসলাম এই আদেশ দেন। সায়েম সোবহান যেন দেশত্যাগ করতে না পারেন সে বিষয়ে ইমিগ্রেশন পুলিশকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

এর আগে তার বিদেশ যাতায়াতের ওপর নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আদালতে আবেদন করেন আত্মহত্যায় প্ররোচণা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গুলশান থানার ভারপাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবুল হাসান।

আবেদনে সাড়া দিয়ে বিচারক আগামী ৩০ মের মধ্যে তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন জমা দেয়ার আদেশ দিয়েছেন।

আদালতে গুলশান থানার সাধারণ নিবন্ধন শাখার কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ‘আজ মামলার এজাহার আদালতে আসে। বিচারক হাকিম শহিদুল ইসলাম তা গ্রহণ করে গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবুল হাসানকে আগামী ৩০ মে মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আদেশ মোতাবেক আমরা আদালতের দায়িত্ব পালন করব।’

গতকাল এক তরুণীকে আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে সায়েম সোবহানের বিরুদ্ধে করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল হাসান এই আবেদনটি করেন।

মামলার প্রতিবেদন দাখিল ৩০ মে

মরদেহ উদ্ধারের পর গতকাল রাতেই ভুক্তভোগী নিহত তরুণীর বোন নুসরাত জাহান বাদী হয়ে ৩০৬ ধারায় আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগ এনে গুলশান থানায় মামলা (নং-২৭) করেন। মামলার আসামি করা হয় বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি সায়েম সোবহান আনভীরকে (৪২)।

পরে মঙ্গলবার ঢাকা মহানগর হাকিম আবু সুফিয়ান মোহাম্মদ নোমান মামলার এজাহার গ্রহণ করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আগামী ৩০ মে দিন ধার্য করেন।

 

মামলার এজাহারে যা বলা হয়েছে

মামলার এজাহারে বাদী বলেন, দুই বছর আগে সায়েম সোবহানের সঙ্গে পরিচয় হয় ওই তরুণীর। তারা মাঝে মধ্যে রেস্টুরেন্টে দেখা করতেন। পরে ২০১৯ সালে ওই তরুণীকে স্ত্রী পরিচয় দিয়ে বনানীর একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেন সায়েম সোবহান। এক পর্যায়ে সায়েমের পরিবার বিষয়টি জানতে পারলে ওই তরুণীকে ভয়ভীতি দেখিয়ে ঢাকা ছাড়তে বলে। পরে ওই তরুণীকে কুমিল্লা নিয়ে যাওয়া হয়।

এজাহারে আরও বলা হয়, সায়েম সোবহান বিয়ের আশ্বাস দিয়ে ওই তরুণীকে এ বছরের মার্চ মাসে ফের ঢাকা নিয়ে আসেন এবং গুলশানের এই ফ্ল্যাটে রাখার ব্যবস্থা করেন। ওই তরুণীকে বিয়ে করে দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়ার আশ্বাসও দেন সায়েম।

বাদী এজাহারে বলেন, ২৩ এপ্রিল তরুণী তাকে ফোন করে বলেন, সায়েম তাকে বকা দিয়েছেন। বলেছেন, কেন তিনি ফ্ল্যাটের মালিকের বাসায় গিয়ে ইফতার করেছেন, ছবি তুলেছেন। ফ্ল্যাটের মালিকের স্ত্রী ফেসবুকে ছবি পোস্ট করেছেন। এ ছবি ফ্ল্যাট মালিকের স্ত্রীর বান্ধবী ‌পিয়াসা দেখেছেন। তিনি তার (আসামির) মাকে সবকিছু জানিয়ে দেবেন।

এজাহারে বলা হয়, আসামি ভুক্তভোগী তরুণীকে বলে, তিনি দুবাই চলে যাচ্ছেন, সে যেন কুমিল্লায় চলে যায়। আসামির মা জানতে পারলে তাকে (তরুণী) মেরে ফেলবেন।

বাদী অভিযোগে লিখেছেন, তার বোন সোমবার ফোন করে তাকে জানান যে সায়েম তার সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। তার বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। পরে বাদী ঢাকার পথে রওনা দেন। এর মধ্যে তার বোনের মোবাইল নম্বরটি বন্ধ পান। গুলশানের ওই বাসায় পৌঁছানোর পরও কোনো সাড়া না পেয়ে বাড়ির মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে মিস্ত্রি ডেকে দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করেন। এসময় ওই তরুণীকে তার বেডরুমে ফ্যান থেকে গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পান।

সায়েম সোবহান আনভীরের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্ররোচনায় সোমবার সকাল ১১টা থেকে বিকেলে সোয়া ৪টার মধ্যে কোনো একসময় ওই তরুণীর মৃত্যু হয়েছে বলে মামলায় অভিযোগ করেছেন তার বড় বোন।

 

যা বলছে পুলিশ

পুলিশের গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) সুদীপ কুমার চক্রবর্তী জানান, মামলা হয়েছে। আমরা কিছু আলামত জব্দ করেছি। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, সাক্ষ্যপ্রমাণ হাতে এলে ওই এমডির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। মেয়েটি কেন আত্মহত্যা করেছে এবং এর পেছনে কারও ইন্ধন রয়েছে কিনা, তা আমরা খতিয়ে দেখছি। ওই বাসা থেকে কিছু আলামত উদ্ধার করা হয়েছে। ওই বাসায় কার যাতায়াত ছিল তা জানার চেষ্টা চলছে।

গুরুত্ব বিবেচেনায় গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মামলার তদন্ত করছেন জানিয়ে ডিসি বলেন, ঘটনাস্থল থেকে সিসিটিভির ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। ফুটেজ বিশ্লেষণ করার মাধ্যমে মামলার তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি আসবে।

 

যা হয়েছিল

গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় গুলশানের একটি ফ্ল্যাট থেকে ওই তরুণীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তিনি রাজধানীর একটি কলেজের উচ্চমাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তার পরিবার থাকে কুমিল্লা শহরে।

এরপর তরুণীটিকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেয়ার রাতে গুলশান থানায় মামলা করেন তার বোন। এতে আসামি করা হয় বসুন্ধরা এমডি সায়েম সোবহান আনভীরকে।

পুলিশের গুলশান জোনের উপকমিশনার (ডিসি) সুদীপ কুমার চক্রবর্তী সাংবাদিকদের জানান, সোমবার সন্ধ্যার দিকে গুলশান ২ নম্বরের একটি ফ্ল্যাট থেকে ওই তরুণীর ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ করার পাশাপাশি মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠায়।

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts