বিডিমেট্রোনিউজ ডেস্ক ॥ বিভিষিকাময় রাতে হারলো ফ্রান্স, হারলো ক্রোয়েশিয়া। মনে রাখার মতো রাত কাটলো ইউরোতে। দিনের প্রথম ম্যাচেই সব নাটকীয়তা শেষ হয়ে গিয়েছিল বলে মনে হয়েছিল। ৩-১ থেকে ৩-৩ হয়ে যাওয়া ম্যাচে ৫-৩ ব্যবধানে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে স্পেনের জয়ের সে ম্যাচকে ইউরোর সেরা ম্যাচ বলা যায়। কিন্তু ফ্রান্স-সুইজারল্যান্ড ম্যাচ তাহলে পিছিয়ে থাকবে কেন?
আগের ম্যাচে অবিশ্বাস্যভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর পর ৮ গোলের রোমাঞ্চ ছড়িয়ে স্পেনের কাছে হেরে যায় ক্রোয়েশিয়া। বিদায় নেয় গত বিশ্বকাপের রানার্সআপরা। ওই টানটান উত্তেজনার রেশ না কাটতেই ফ্রান্স ও সুইজারল্যান্ড ম্যাচে আরেকটি অবিশ্বাস্য প্রত্যাবর্তনের নজির তৈরি হয়। এগিয়ে থাকা সুইশরা দুই গোলে পিছিয়ে পড়েও ঘুরে দাঁড়ায়। নির্ধারিত সময় শেষ হয় ৩-৩ ব্যবধানে। অতিরিক্ত সময়েও স্কোর পাল্টায়নি, টাইব্রেকারে ৫-৪ গোলে জিতে ফ্রান্সকে হারিয়ে ১৭ বছর পর কোয়ার্টার ফাইনালে সুইজারল্যান্ড। আগামী ২ জুলাই সেন্ট পিটার্সবার্গে তাদের প্রতিপক্ষ স্পেন।
টানা দুই দিনে গত বিশ্বকাপ ও ইউরোর তিন ফাইনালিস্টের বিদায় হলো মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের মঞ্চ থেকে। রোববার (২৭ জুন) বেলজিয়ামের কাছে হারে গতবারের চ্যাম্পিয়ন পর্তুগালের ইউরো শেষ হয়। পরের দিন স্পেন বিদায় করলো বিশ্বকাপের রানার্সআপ ক্রোয়েশিয়াকে। কয়েক ঘণ্টা পর এই আসরের সবচেয়ে বড় অঘটনের শিকার হয়ে ইউরোর স্বপ্ন শেষ হলো বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ও গত আসরের রানার্সআপ ফ্রান্সের।
বুখারেস্টের ন্যাশনাল এরেনায় দারুণ আক্রমণে শুরুতেই এগিয়ে যায় সুইজারল্যান্ড। ১৫ মিনিটে সেফেরোভিচ বক্সের বাইরে থেকে লক্ষ্যে শট নেন। প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারের গায়ে লেগে বল যায় জুবেরের কাছে। ততক্ষণে বক্সে ঢুকে গেছেন সেফেরোভিচ। জুবেরের মাপা ক্রসে লাফিয়ে দুর্দান্ত হেড করেন তিনি, ফরাসি গোলকিপার হুগো লরিস বল আটকাতে পারেননি। শুরুতেই লিড নিয়ে ২০০৪ সালের পর প্রথম কোয়ার্টার ফাইনালে খেলার স্বপ্ন দেখা শুরু করে সুইজারল্যান্ড।
প্রথমার্ধে ফ্রান্স কোনও সুযোগ তৈরি করতে পারেনি। কিলিয়ান এমবাপ্পে, র্যাবিওট শট নিলেও তা লক্ষ্যে ছিল না। ১-০ গোলে এগিয়ে থেকে বিরতিতে যায় সুইশরা। দ্বিতীয়ার্ধে ফিরে ব্যবধান দ্বিগুণ করার বড় সুযোগ পায় তারা। ৫২ মিনিটে ফরাসির বক্সে ঢুকেই বেঞ্জামিন পাভার্দের ফাউলের শিকার হন জুবের। সুইজারল্যান্ডের আবেদনে সাড়া দিয়ে ভিএআর যাচাই করে পেনাল্টি দেন রেফারি।
৫৫ মিনিটে পেনাল্টি কিক নিতে যান রিকার্ডো রদ্রিগেজ। বাঁ দিক দিয়ে কোনাকুনি নিচু শট নেন তিনি। বলের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে দুর্বল শট এক হাতে রুখে দেন লরিস। অধিনায়কের এই বীরত্বের পর যেন গা ঝারা দিয়ে ওঠে ফ্রান্স। মাত্র ৯০ সেকেন্ডের ব্যবধানে জোড়া গোল করেন করিম বেনজেমা। ৬ বছর পর জাতীয় দলে ফিরে অবিশ্বাস্য তিনি। পর্তুগালের বিপক্ষে জোড়া গোল করা রিয়াল মাদ্রিদ ফরোয়ার্ড ৫৭ মিনিটে চোখ ধাঁধানো গোল করেন।
এমবাপ্পের ছোট পাস থেকে দারুণভাবে গোলের সুযোগ তৈরি করে কাজে লাগান বেনজেমা। পিএসজি স্ট্রাইকার বল বক্সের মধ্যে বাড়ান। কিছুটা পেছনে থাকা বল বাঁ পা দিয়ে টেনে সামনে নেন বেনজেমা, তারপর এগিয়ে গিয়ে বাঁ পায়ের শটেই লক্ষ্যভেদ। ৫৯ মিনিটে দলকে এগিয়ে দেন তিনি। আন্তোয়ান গ্রিজমানের উঁচু শটে বল সুইশ গোলরক্ষক সমারের হাতে লেগে দূরের পোস্ট দিয়ে বের হওয়ার পথে ছিল, কিন্তু তার আগেই হেড করেন বেনজেমা। টানা দুই ম্যাচে জোড়া গোল করে গোল্ডেন বুট পাওয়ার দৌড়ে এগিয়ে থাকলেন তিনি।
সুইজারল্যান্ডকে দুই গোলে পেছনে ফেলে ফ্রান্স ৭৫ মিনিটে। কিছুটা জায়গা খুঁজে বের করে বক্সের বাইরে থেকে শক্তিশালী শটে স্কোর ৩-১ করেন পল পগবা।
কিন্তু ফ্রান্সকে সহজে ছেড়ে দেয়নি সুইজারল্যান্ড। ৮১ মিনিটে এমবাবুর চমৎকার ক্রস থেকে সেফেরোভিচের শক্তিশালী হেড জালে জড়ায়। আরেকটি গোলের জন্য বুক চিতিয়ে লড়াই করে গেছে ১৯৯২ সালের সেমিফাইনালিস্টরা। ফলও পেয়ে যায় হাতেনাতে। নির্ধারিত সময়ের শেষ মিনিটে তৃতীয় গোল করে ম্যাচ অতিরিক্ত সময়ে নেয় সুইশরা। গ্রানিত জাকার পাস ধরে প্রেসনেল কিম্পেম্বেকে বোকা বানিয়ে বক্সে ঢুকে ৯০ মিনিটে লরিসকে পরাস্ত করেন বদলি নামা মারিও গাভ্রানোভিচ।
অতিরিক্ত সময়ে ম্যাচ গড়াতো না, যদি যোগ করা সময়ের তৃতীয় মিনিটে কোমানের শট ক্রসবারে না লাগতো। বুক দিয়ে বল নিয়ন্ত্রণে নিয়ে দারুণ শট নিয়েছিলেন। কিন্তু গোলপোস্ট হতাশ করে তাকে।
বাড়তি ৩০ মিনিটর খেলায় শুরুতে সুযোগ তৈরি করে ফ্রান্স। ৯৫ মিনিটে পাভার্দের রকেট গতির শট ডান হাত উঁচু করে থামিয়ে দেন সুইশ গোলকিপার সমার। অতিরিক্ত সময়ের দ্বিতীয়ার্ধে দুইবার এমবাপ্পে সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারেননি। ১০৯ মিনিটে কোমানের বাড়ানো বল বক্সে পেয়েছিলেন তিনি, কিন্তু ডান পায়ের বদলে বাঁ পায়ে শট নেওয়ায় ডানদিকের পোস্টের বাইরে দিয়ে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। দুই মিনিট বাদে বাঁ দিক দিয়ে বক্সে ঢুকে শট নেন এমবাপ্পে, এবারও গোলবারের পাশ দিয়ে বল মাঠের বাইরে। ১১৯ মিনিটে জিরুদের হেড দুহাতে লুফে নিয়ে স্কোর অপরিবর্তিত রাখেন সমার। তাতে অতিরিক্ত সময়েও ফল অমীমাংসিত থাকায় টাইব্রেকারে গড়ায় ম্যাচ।
প্রথম শটে সুইজারল্যান্ডের গাভ্রানোভিচ গোল করেন। ফ্রান্সকে স্বস্তি এনে দিয়ে গোল করেন পগবাও। দ্বিতীয় শুটে সুইশদের উল্লাসে মাতান ফ্যাবিয়ান স্কার। ফ্রান্সের পক্ষে দ্বিতীয় শটে ডানপ্রান্ত দিয়ে জালে বল জড়ান জিরুদ। মানুয়েল আকানজি ঠাণ্ডা মাথায় তৃতীয় শটে লক্ষ্যভেদ করে সুইজারল্যান্ডকে ম্যাচে রাখেন। তৃতীয় শট থেকে ফ্রান্সের হয়ে লক্ষ্যভেদ করেন থুরাম। ভারগাসের শট ডান হাত দিয়ে লরিস ঠেকালেও বল রাখতে পারেননি। কিম্পেম্বে করেন ফ্রান্সের চতুর্থ গোল। লরিসকে ভুল দিকে পাঠিয়ে সুইশদের শেষ শটে সফল হন মেহমেদি। ফ্রান্সের শেষ শট নিতে আসেন এমবাপ্পে, তার উঁচু শট ডান দিকে ঝাঁপিয়ে রুখে দেন সমার। তারপরই অঘটন ঘটিয়ে উল্লাসে ফেটে পড়ে সুইশরা।