নায়িকা পরীমনি, মডেল ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা ও মরিয়ম আক্তার মৌ এবং প্রযোজক নজরুল ইসলাম রাজের বিরুদ্ধে দায়ের সাতটি মামলার তদন্তভার পেয়েছে পুলিশ অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। সম্প্রতি এসব নায়িকা, মডেল, প্রযোজক এবং তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে প্রতারণা, ব্ল্যাকমেইল, মাদক ব্যবসাসহ নানা অভিযোগ তুলে ধরেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আর এসব অভিযোগে দায়ের হওয়া মামলাগুলোর তদন্তই আজ শনিবার থেকে শুরু করছে সিআইডি।
এদিকে মডেল-নায়িকা গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসছে তাদের অনেক প্রভাবশালী সহযোগীদের নাম। তদন্ত করে এসব ব্যক্তিরও পৃথক তালিকা প্রস্তুত করছে সিআইডি ও র্যাব। সেই তালিকা ধরে অভিযান চালানোর কথা জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংশ্লিষ্ট ইউনিটগুলো।
সিআইডি জানায়, শুধু শো-বিজ অঙ্গনের তারকাই নয়, বরং তাদের পৃষ্ঠপোষক ও নেপথ্যের ‘নায়ক’দের শনাক্ত করতে চায় সিআইডি। এ ছাড়া ঢাকার অপরাধ জগতের কারা এসব সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছে তাদের বিরুদ্ধেও অনুসন্ধান শুরু করেছে পুলিশের এ অপরাধ তদন্ত বিভাগ। এসব সিন্ডিকেট অবৈধভাবে উপার্জন করা অর্থ বিদেশে পাচার করেছে কিনা, সেটিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ইতোমধ্যে গ্রেপ্তারকৃত প্রযোজক নজরুল ইসলাম রাজ ও মিশু হাসান কানাডায় অর্থ পাচার করেছেন বলে প্রাথমিক তথ্য পেয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তারা।
ডিবি বুঝে না নেওয়ার আগেই মামলা গেল সিআইডিতে :
রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকায় অভিযান চালিয়ে গত ৩ আগস্ট রাতে শরফুল হাসান ওরফে মিশু হাসান এবং তার সহযোগী মো. মাসুদুল ইসলাম ওরফে জিসানকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা রাজধানীর গুলশান, বারিধারা ও বনানীসহ বিভিন্ন অভিজাত এলাকায় পার্টি বা ডিজে পার্টি আয়োজনের বেশকিছু তথ্য দেন। এ তথ্যের ভিত্তিতেই গত বুধবার বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত বনানী এলাকায় পৃথক অভিযান চালিয়ে চিত্রনায়িকা পরীমনি, প্রযোজক রাজ, পরীমনির ম্যানেজার আশরাফুল ইসলাম দীপু ও রাজের ম্যানেজার সবুজ আলীকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
পরীমনি, রাজ এবং তাদের দুই সহযোগীর বিরুদ্ধে বনানী থানায় মাদক আইনে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করে র্যাব-১। এ ছাড়া রাজ ও তার ম্যানেজার সবুজের বিরুদ্ধে পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে আরেকটি মামলা করা হয়। মাদক আইনে দায়ের হওয়া দুটি মামলা ওইদিনই ডিবিতে স্থানাস্তর করা হয়। কিন্তু তার একদিনের মাথায় শুক্রবার সেগুলো স্থানান্তর করা হয় সিআইডিতে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র অবশ্য জানায়, ডিবিতে মামলার নথিপত্র পৌঁছানোর আগেই সিআইডিতে স্থানান্তর করা হয়েছে। বনানী থানায় ওসি নূরে আজম মিয়া আমাদের সময়কে বলেন, ‘পরীমনি ও রাজের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া দুটি মামলা বৃহস্পতিবারই ডিবিতে স্থানান্তরের আদেশ হয়। কিন্তু মামলার নথি পৌঁছানো হয়নি। এ ছাড়া রাজের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলাটি আমাদের কাছেই রয়েছে।’
এদিকে মামলা স্থানান্তর হলেও শুক্রবার দুপুরে ডিবির যুগ্ম কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ বলেন, ‘পরীমনি মূলত একজন সিনেমার নায়িকা। কিন্তু এর আড়ালে সে যেসব অবৈধ কাজ ও ব্যবসা করত; সেগুলো কাদের নিয়ে করত, কাদের সহযোগিতায় করত, কারা তার নেপথ্যে রয়েছে, আমরা তাদের নাম পেয়েছি। তার বক্তব্য নোট করছি। যারাই তার সঙ্গে জড়িত ছিল তাদের সবাইকেই গ্রেপ্তার করা হবে।’ তিনি এও জানান, পরীমনির ঘটনায় শিগগিরই তার কস্টিউম ডিজাইনার জিমিকে গ্রেপ্তার করা হবে। এ ছাড়া জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে অপর একজন নারীকেও।
প্রযোজক নজরুল ইসলাম রাজ প্রসঙ্গে হারুন অর রশিদ বলেন, ‘রাজ একজন লেখাপড়া না জানা মানুষ। সে ছোট একটা চাকরি করত। বিভিন্ন মডেলকে নিয়ে সে ঘরোয়া পার্টি করত। উচ্চবিত্তদের মডেল সাপ্লাই দিত। তার কাছ থেকেও আমরা তথ্য পেয়েছি। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত সবাইকেই আইনের আওতায় আনা হবে।’
রাজধানীর বারিধারায় গেল ১ আগস্ট রাত ১০টার দিকে প্রথমে মডেল পিয়াসার বাসায় অভিযান চালায় ডিবি পুলিশ। রাত পৌনে ১২টার দিকে তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। এ মডেলের দেওয়া তথ্যে মডেল মৌকে ধরতে ওইদিন রাতেই মোহাম্মদপুরের বাবর রোডে তার বাসায় অভিযান চালায় ডিবি পুলিশ। তার বাসা থেকেও বিপুল পরিমাণ মদ উদ্ধার করা হয়। রাত ১টার দিকে মৌকেও গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
এর পর সোমবার দুপুরে গুলশান থানায় পিয়াসার বিরুদ্ধে ও মোহাম্মদপুর থানায় মৌয়ের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করে পুলিশ। এ ছাড়া খিলক্ষেত ও ভাটারা থানায় পিয়াসার নামে আরও দুটি মামলা দায়ের করা হয়। দুই মামলায় তিন দিন করে পুলিশ রিমান্ডে ছিলেন পিয়াসা ও মৌ। মামলাগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে ডিবিতে না গেলেও নিরাপত্তাজনিত কারণে এ দুই মডেলকে ডিবিতে রাখা হয়েছিল। গতকাল এ চারটি মামলাও সিআইডিতে স্থানান্তর করা হয়।
এদিকে শুক্রবার নতুন করে তিন মামলায় পিয়াসার ৮ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। আর মডেল মৌকে আরও চার দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। এ দুই মডেলকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে সিআইডি। জানতে চাইলে সিআইডির মিডিয়া শাখার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজাদ রহমান বলেন, ‘পরীমনি, পিয়াসা, মৌ ও রাজের সাতটি মামলার তদন্তভার আমরা পেয়েছি। মামলাগুলোর আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু করা হবে।’ সিআইডির প্রধান ব্যারিস্টার মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘এ ধরনের কাজে আর কারা জড়িত সেটিও আমরা অনুসন্ধান করে দেখছি।’
ব্ল্যাকমেইলের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন এবং মাদক ব্যবসায় জড়িত সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রাখার কথা জানিয়েছে ডিবি ও র্যাব। জানতে চাইলে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘মাদকের বিরুদ্ধে অভিযানের অংশ হিসেবেই তাদের (গ্রেপ্তার নায়িকা, মডেল, প্রযোজক ও তাদের সহযোগী) বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। এ ধরনের অভিযান অব্যাহত থাকবে।’