ডেঙ্গুজ্বরে সাবধনতা ও চিকিৎসা

ডা. কায়েম উদ্দিন 
বর্তমানে ডেঙ্গুজ্বরের প্রার্দুভাব দেখা যাচ্ছে। যার ভয়াবহতা প্রকট, যদিও ডেঙ্গু প্রাণঘাতী রোগ নয় তার পরও গত কয়েত বছর বেশ কিছু রোগী ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে, যার কারণে ডেঙ্গু এখন আতঙ্কের এক নাম। তবে আশার কথা হলো সঠিক চিকিৎসা ও নিয়মমাফিক চললে এই রোগ থেকে পুরোপুরি মুক্তি পাওয়া সম্ভব। আসুন আমরা ডেঙ্গুজ্বরের ভয়াবহ রূপ ডেঙ্গু শক সিনড্রোম ও এর প্রতিরোধের উপায় জেনে নিই এবং সচেতন হই।
*ডেঙ্গু শক সিনড্রোম:
ডেঙ্গুজ্বরের ভয়াবহ রূপ হলো ডেঙ্গু শক সিনড্রোম। ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারের সঙ্গে সার্কুলেটরি ফেইলিউর হয়ে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম হয়। এর লক্ষণ হলো-
-রক্তচাপ হঠাৎ কমে যাওয়া।
-নাড়ীর স্পন্দন অত্যন্ত ক্ষীণ ও দ্রুত হয়।
-শরীরের হাত পা ও অন্যান্য অংশ ঠান্ডা হয়ে যায়।
-প্রস্রাব কমে যায়।
-হঠাৎ করে রোগী জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে পারে। এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
*ডেঙ্গুজ্বর কিভাবে প্রতিরোধ করা যায়:
ডেঙ্গুজ্বর প্রতিরোধের মূল মন্ত্রই হলো এডিস মশার বিস্তার রোধ এবং এই মশা যেন কামড়াতে না পারে, তার ব্যবস্থা করা। মনে রাখতে হবে, এডিস একটি ভদ্র মশা, অভিজাত এলাকায় বড় বড় সুন্দর সুন্দর দালান কোঠায় এরা বাস করে। স্বচ্ছ পরিষ্কার পানিতে এই মশা ডিম পাড়ে। ময়লা দুর্গন্ধযুক্ত ড্রেনের পানি এদের পছন্দসই নয়। তাই ডেঙ্গু প্রতিরোধে এডিস মশার ডিম পাড়ার উপযোগী স্থানগুলোকে পরিষ্কার রাখতে হবে এবং একই সঙ্গে মশক নিধনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
-বাড়ির আশপাশের ঝোপঝাড়, জঙ্গল, জলাশয় ইত্যাদি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
– যেহেতু এডিস মশা মূলত এমন বস্তুর মধ্যে ডিম পাড়ে যেখানে স্বচ্ছ পানি জমে থাকে, তাই ফুলদানি, অব্যবহৃত কৌটা, ডাবের খোসা, পরিত্যক্ত টায়ার ইত্যাদি সরিয়ে ফেলতে হবে। ব্যবহৃত জিনিস যেমন মুখ খোলা পানির ট্যাংক, ফুলের টব ইত্যাদিতে যেন পানি জমে না থাকে, সে ব্যবস্থা করতে হবে।
-ঘরের বাথরুমে কোথাও জমানো পানি ৫ দিনের বেশি যেন না থাকে। একুরিয়াম, ফ্রিজ বা এয়ার কন্ডিশনারের নিচেও যেন পানি জমে না থাকে।
-এডিস মশা সাধারণত সকাল ও সন্ধ্যায় কামড়ায়। তবে অন্য সময় ও কামড়াতে পারে। তাই দিনের বেলা শরীর ভালভাবে কাপড়ে ঢেকে বের হতে হবে, প্রয়োজনে মসকুইটো রিপেলেন্ট ব্যবহার করা যেতে পারে। ঘরের চারদিকে দরজা জানালায় নেট লাগাতে হবে।
-দিনে ঘুমালে মশারি টাঙিয়ে অথবা কয়েল জ্বালিয়ে ঘুমাতে হবে।
-বাচ্চাদের যারা স্কুলে যায়, তাদের হাফপ্যান্ট না পরিয়ে ফুল প্যান্ট বা পায়জামা পরিয়ে স্কুলে পাঠাতে হবে। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে অবশ্যই সব সময় মশারির মধ্যে রাখতে হবে, যাতে করে রোগীকে কোন মশা কামড়াতে না পারে। মশক নিধনের জন্য স্প্রে, কয়েল, ম্যাট ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে মশার কামড় থেকে বাঁচার জন্য দিনে ও রাতে মশারী ব্যবহার করতে হবে। ডেঙ্গু জ্বর হয়ত বা নির্মূল করা যাবে না। এর কোন ভ্যাক্সিনও বের হয়নি, কোন কার্যকরী ওষুধও আবিষ্কৃত হয় নিই। ডেঙ্গু জ্বরের মশাটি আমাদের দেশে আগেও ছিল, এখনও আছে, মশা প্রজননের এবং বংশবৃদ্ধির পরিবেশও আছে। তাই ডেঙ্গু জ্বর ভবিষ্যতেও থাকবে। একমাত্র সচেতনতা ও প্রতিরোধের মাধ্যমেই এর হাত থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
*করণীয় ও চিকিৎসা :
তীব্র ধরণের ডেঙ্গুর লক্ষণ প্রকাশ পেলে বাসায় চিকিৎসা করার সুযোগ নেই। মনে রাখবেন তীব্র ডেঙ্গু এক ধরণের মেডিকেল ইমার্জেন্সি। এসব রোগীদের হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা নিতে হবে। গড়ে প্রতি বিশ জনে একজন তীব্র ডেঙ্গুতে  আক্রান্ত হতে পারেন। তীব্র ডেঙ্গুতে রক্তচাপ কমে রোগী শকে চলে যেতে পারে, রোগীর আভ্যন্তরীণ অঙ্গ থেকে শুরু হতে পারে রক্তক্ষরণ। যাদের আগে একবার ডেঙ্গু হয়েছে তাদের দ্বিতীয় আক্রমণে তীব্র ডেঙ্গু হতে পারে।
এ সময় রক্তের অণুচক্রিকা কমে যেতে পারে খুব দ্রুত। সেজন্য প্রতিদিন রক্ত পরীক্ষা করে অণুচক্রিকার পরিমাণ জানতে হয়। এই সংখ্যা ৫০ হাজারের নিচে নেমে গেলে দিনে অন্তত দুবার এই পরীক্ষা করা দরকার। সাথে নজর রাখতে হবে ডেঙ্গুর ভয়ানক উপসর্গের দিকে।
ডেঙ্গুর কোন নির্ধারিত চিকিৎসা নেই। প্রকাশিত লক্ষণের শুধু চিকিৎসা করতে হবে। সেজন্য কারো ডেঙ্গু হলে করণীয় হলো:
* পূর্ণ বিশ্রাম নিন—শারীরিক ও মানসিক বিশ্রাম গ্রহণ করুন।
* পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করুন। শরবত, ফলের রস, স্যুপ, ডাবের পানি, স্যালাইন পানি পান করুন।
* জ্বর বা ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল সেবন করুন
* এসপিরিন, আইবোপ্রোফেন কিংবা ব্যথা বেদনা নাশক বড়ি গ্রহণ করবেন না। এগুলো ডেঙ্গু রক্তক্ষরণজনিত জটিলতা বাড়িয়ে দিতে পারে।
* ডেঙ্গু জ্বর চলে যাওয়ার চব্বিশ ঘন্টা পর যদি শরীর আরো বেশী খারাপ হতে থাকে তবে অবশ্যই সতর্ক হোন।
* রক্ত পরীক্ষা করে অণুচক্রিকার এবং হেমাটোক্রিটের পরিমাণ জেনে নিন।
* রক্তের অণুচক্রিকা কমতে থাকলে দ্রুত হাসপাতালে চলে আসুন।
* অণুচক্রিকা দশ হাজারের নিচে নেমে গেলে কিংবা রক্তক্ষরণ শুরু হলে রক্ত প্রদান করুন।
* রক্তের অণুচক্রিকা বৃদ্ধির জন্য পেঁপে, পেঁপে পাতার রস, দুধ, ডালিম ইত্যাদি খেতে হবে। পেঁপে পাতার রস অণুচক্রিকা বৃদ্ধির জন্য কার্যকর প্রমানিত হয়েছে।
তবে ডেঙ্গু চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধ ই জরুরি।
ডা. কায়েম উদ্দিন, বোর্ড সদস্য ও সহযোগী অধ্যাপক টাংগাইল হোমিও মেডিকেল  কলেজ।
চেম্বার: জার্মান হোমিও রিসার্চ, সিএমবি -বটতলা রোড, টাংগাইল।  মোবাইল : ০১৭১৫-৩৪০-৪৯০
Print Friendly

Related Posts