ভিটামিন-ডি পেতে রৌদ্র-স্নান প্রসঙ্গ

লে. কর্ণেল (সহযোগী অধ্যাপক) নাসির উদ্দিন আহমদ
ভিটামিন-ডি হাড়, দাঁত আর মাংসপেশীর স্বাস্থ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মানবদেহে অনেকগুলো ক্যানসার প্রতিরোধে এর ভূমিকা রয়েছে। হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, মাল্টিপল স্কেলেরোসিস সহ আরো কিছু রোগ প্রতিরোধেও এর ভূমিকা রয়েছে।
ইনসুলিনের মাত্রা ঠিক রেখে ডায়াবেটিস চিকিৎসায় এটি সাহায্য করে। এছাড়া এই ভিটামিন রোগ প্রতিরোধের ব্যবস্থাপনায়, মস্তিষ্ক এবং স্নায়ুতন্ত্রের সুস্থ্যতার জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। প্রায় দুইশতাধিক ধরণের জীনের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে এটি। ভিটামিন-ডি শরীরের জন্য খুবই জরুরী উপাদান।
দীর্ঘদিন এই ভিটামিনের অভাবে যা হতে পারে স্হূলতা, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, বিষন্নতা, ফাইব্রোমায়ালজিয়া , হাড় ক্ষয়, ক্রনিক ফ্যাটিগ সিনড্রোম, আলঝেমার্স রোগ ইত্যাদি।
ভিটামিন-ডি এর প্রধান উৎস সূর্যালোক। রৌদ্র-স্নান তাই এত দরকারী। আসুন রৌদ্র-স্নানে। ভিটামিন-ডি বাগিয়ে নিই।
এছাড়া কিছু ভিটামিন-ডি সমৃদ্ধ খাবার তো আছেই। যেমন কলিজা, ডিমের কুসুম, দুধ ও দুগ্ধজাত খাদ্য, ছানা, পনির, মাখন, সামুদ্রিক মাছের তেল, সামুদ্রিক মাছ টুনা, স্যামন, ম্যাকারেল, সারডিন, কিছু মাশরুম আর ভিটামিন-ডি সমৃদ্ধ গুড়া-দুধ, কমলার শরবৎ ইত্যাদি।
ভিটামিন-ডি শুধু নিরেট ভিটামিন নয় বরং এটিকে বলা  যায় হরমোন—প্রাণরস। সুর্য্যি মামা তার কিরণমালা দিয়ে যখন পরশ বুলায় তখন ত্বকের নিচে তৈরী হয় ভিটামিন-ডি এর প্রাথমিক যৌগ। সাধারণত আমাদের শরীরের শতকরা ৫০-৯০ ভাগ ভিটামিন তৈরী হয় সূর্যালোক থেকেই। সূর্যের আলোকছটায় থাকে  বিভিন্ন তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের আলো। সাধারণত ২৯০-৩১৫ ন্যানোমিটার তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের আলোক রশ্মি যোগান দেয় ভিটামিন-ডি।
এই তরঙ্গের আলোক ঢেউ এর আরেক নাম আলট্রা ভায়োলেট-বি, বাংলায় এদের নাম দেয়া হয়েছে অতিবেগুনী রশ্মি-বি। এরা কিন্ত কাঁচের ভিতর দিয়ে প্রবেশ করতে পারেনা। ফলে কেউ যদি আয়েশ করে ঘরের ভিতর বসে কাঁচের জানালার ফাঁক গলে নেমে আসা সূর্য-ঢেউয়ে স্নান সারতে চান তারা কিন্ত বন্চিত হবেন এই ভিটামিন থেকে। ঘর ছেড়ে বাইরে আসতে হবে আলো পেতে অথবা নিদেনপক্ষে কাঁচের জানালা খুলে দিতে হবে কিংবা আসতে হবে খোলা বারান্দায়। একেবারে ঢাক ঢোল পিটিয়ে বাদ্য বাজনা বাজিয়ে ঘটা করে সূর্য স্নানের জন্য সমুদ্রে সৈকতে আরাম কেদারায় শুতে হবে এমনটির দরকার নেই। দরকার শুধু পর্যাপ্ত আলো। তবে এটাও ঠিক সমুদ্র সৈকত নয় বরং পাহাড় চূড়ায় ভিটামিন-ডি বরং বেশী।
ঋতু ভেদে আলোক রশ্মির তরঙ্গ দৈর্ঘ্যেও হেরফের ঘটে থাকে। গ্রীষ্মের রোদ যতটা ভিটামিন ডি তৈরী করে শীতের রৌদ্র ততটা পারেনা। সেজন্য গ্রীষ্মের রোদে বসতে হবে মিনিট পনেরো থেকে ঘন্টা দুয়েক। সপ্তাহে দুদিনের রৌদ্রই যথেষ্ট। যারা ভিটামিন-ডি নিয়ে গবেষণা করেন তারা বলেন, রৌদ্রে যেতে হবে বেলা দশটা থেকে তিনটার মাঝে। কতটুকু সময়ে এই ত্বকের কারখানায় ভিটামিন তৈরী হবে তা নির্ভর করে বেশ কতগুলো নিয়ামকের উপর। যেমন আপনার অবস্থান, ঋতুভেদ, দিনের কোন অংশের আলো, আকাশের অবস্থা (মেঘাচ্ছন্ন), কুয়াশা, বায়ুদূষণ, চামড়ার তারতম্য ইত্যাদি অনেক কিছুর উপর।
বিষুব রেখা থেকে যত দূরে যেতে থাকবেন সূর্যের আলো কিন্ত তত তীর্যক ভাবে পড়তে থাকবে আপনার গায়ে। আর তীর্যকভাবে আলো পড়লে অতিবেগুনী রশ্মি-বি আসবে কম অর্থাৎ ভিটামিন-ডি তৈরী হবে কম। গ্রীষ্মে পৃথিবীর আবর্তনের ফলে বিষুব রেখা থেকে দূরবর্তী অন্চলে সূর্য অনেকটা খাড়া ভাবে পতিত হয় ফলে শীতকালের তুলনায় তখন সেখানে ভিটামিন-ডি তৈরী করতে পারে অঢেল পরিমাণে।
খুব অল্প সময়ের আমাদের ত্বকে তৈরী হতে পারে ‪১০০০০-২৫০০০‬ আই ইউ (ভিটামিন-ডি পরিমাপের একক) ভিটামিন-ডি। আলোয় যাতে শরীর পুড়ে না যায় সে ব্যবস্থাও করা যেতে পারে। সাধারণত আলোয় চামড়া পুড়তে যত সময় লাগে তার অর্ধেক সময়েই তৈরী হয় ভিটামিন-ডি। রোদ চশমা, সুতির কাপড় পরিধান করলেও ক্ষতি নেই। হাত পা মুখ খোলা থাকলেই চলবে। এতে যতটুকু আলো পরশ মাখবে তাতেই উৎপন্ন হয়ে যাবে প্রয়োজনীয় ভিটামিন। তবে একথাও ঠিক যত গুড় তত মিষ্টি। আপনি সম্পূর্ণ পিঠ উন্মুক্ত রাখলে যতটুকু ভিটামিন তৈরী হবে শুধু হাত পা খোলা রাখলে তৈরী হবে তার চেয়ে অনেক কম। সুর্য যখন হেলে রশ্মি ছড়ায় তখন আলট্রাভায়োলেট-বি কিন্ত থাকে খুব কম। সেজন্য সকাল কিংবা বিকেলের রোদ কিন্ত ভিটামিন প্রাপ্তির জন্য মোটেও মোক্ষম সময় নয়। আপনার ছায়া যখন আপনার চেয়ে বড় থাকে তখন নয় বরং যখন ছোট থাকবে তখনই যান রৌদ্র স্নানে। কাজ হবে ত্বকের কারখানায়। উৎপন্ন হবে ভিটামিন-ডি।
এখানে ত্বকের রঙের সাথে কিন্ত সূর্যের খানিকটা পক্ষপাত রয়েছে। শ্বেতাঙ্গ আর কৃষ্ণাঙ্গদের যে এখানেও পার্থক্য। শ্বেতাঙ্গদের ত্বকে অল্প সময়েই তৈরী হয় ভিটামিন ডি সুর্যের পরশে। কৃষ্ণাঙ্গদের কিছুটা বেশী সময় লাগে কেননা তাদের ত্বকে থাকে অনেক বেশী মেলানিন। আফ্রিকা, ক্যারিবীয় দ্বীপপুন্জ কিংবা দক্ষিন এশিয়ার অধিবাসীদের বেশী সময় রোদ্র স্নান করতে হবে। এখানকার অধিবাসীদের চামড়ায় মেলানিনের বাহার। মেলানিন হলো এক ধরণের রন্জক পদার্থ যার অধিক্য আমাদের কালো করে দেয়। এই মেলানিন ভিটামিন ডি তৈরীর প্রাথমিক উপাদানের সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় আলোক রশ্মিকে গলধকরণ করতে। ফলে অধিক মেলানিন সমৃদ্ধ কালো মানুষদের বেশীক্ষণ রোদ্র স্নানে থাকতে হয় ভিটামিন-ডি তৈরী করতে। অবশ্য আমাদের মতো কালো মানুষদের এক সুবিধাও আছে। বেশী রোদে পুড়লেও এই কালো মানুষদের ত্বকে কর্কট রোগ বা ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা কম যা শ্বেতাঙ্গদের ক্ষেত্রে বেশী। সুতরাং শেষমেষ ভারসাম্য রেখেছে এই প্রকৃতি।
দূষিত বায়ু কিন্ত ভিটামিন-ডি তৈরী করতে পারে না। বায়ু দূষণের কারণে অতিবেগুনী রশ্মি-বি বায়ুতে শোষিত হয় কিংবা প্রতিবিম্বিত হয়ে মহাশূন্যে ফেরত চলে যায়। সে কারণে যে সমস্ত নগরে বায়ু দূষণের মাত্রা বেশী সেখানে মানব-মানবীর ত্বক ভিটামিন তৈরীতে হিমশিম খায়। আমাদের তিলোত্তমা মহানগরী ঢাকার বাতাসের দূষণ পেরিয়ে অতিবেগুনী-বি রশ্মি কি আসতে পারছে?
যারা গৃহবন্দী কিংবা ধর্মীয় ও সামাজিক কারণে বাইরে বেরুন কম কিংবা বেরুলেও একেবারে সর্বাঙ্গ ঢেকে রাখেন তাদের ভিটামিন-ডি এর ঘাটতি হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। যারা বয়োবৃদ্ধ অবস্থায় বৃদ্ধাশ্রমে ঘরের ভিতর অবস্থান করেন তাদেরও একই দশা। বাইরে বেরুতে যারা সান-ব্লক ক্রীম ব্যবহার করেন নিয়মিত, কৃষ্ণ ত্বক যাদের প্রকৃতি প্রদত্ত, যারা মুটিয়ে গেছেন কিংবা বুড়িয়ে গেছেন, কিংবা খুব সচেতনভাবেই সূর্যালোককে পরিহার করে চলেন তাদের এই ভিটামিনের ঘাটতির আশঙ্কা বেশী। মনে রাখতে হবে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সবাইকেই রোদে আসতে হবে ভিটামিন-ডি পেতে। তবে সত্তরোর্ধ বয়সী কুন্জিত ত্বক অনেক সময় লাগায় ভিটামিন-ডি তৈরী করতে। সেজন্য আমাদের মুরুব্বীদের ভিটামিন ডি এর জন্য খানিকটা বেশীক্ষণ রাখতে হবে সুর্য-স্নানে। আর উনাদেরই বেশী দরকার এই ভিটামিন।
ত্বকের নিচে আলোর ছোঁয়ায় তৈরী ভিটামিন-ডি কিন্ত কাঁচা ভিটামিন, বলা যায় এই ভিটামিনের প্রথম ধাপ। এটাকে বলা যেতে পারে প্রাক-ভিটামিন-ডি। এই ত্বক-কারখানায় উৎপন্ন যৌগটিকে রক্ত এসে বহন করে নিয়ে যায় বিশাল এক কারখানায়—লিভারে। এখানে রূপান্তর ঘটে ভিটামিনের, নামও বদলে যায়। তখন এর নাম দাঁড়ায় ক্যালসিডিয়ল। রক্তে ভিটামিন-ডি এর মাত্রা বলতে বুঝায় ক্যালসিডিয়লের মাত্রা। এই যৌগটি কিন্ত নিষ্ক্রীয়। এরা রক্ত বাহিত হয়ে পৌঁছে যায় কিডনীতে। কিডনী এই যৌগটিকে আরো শাণিত করে। তখন এর নাম হয় ক্যালসিট্রায়োল। এটি মোক্ষম, কার্যকরী, শাণিত ভিটামিন-ডি।
সূর্য প্রতিদিন অকাতরে বিলিয়ে যাচ্ছে তার কিরণমালা—অঢেল ভিটামিন-ডি অথচ আমরা কি আশ্চর্যজনকভাবে ভুগছি এই ভিটামিনের ঘাটতিতে। প্রায়শই আমরা নানা অজুহাতে আমাদের ছেলে-মেয়েদের  বারণ করি রোদের ভিতর যেতে। ফলস্বরূপ দেখা যাচ্ছে শহর-গাঁয়ে সর্বত্র অপ্রতুল ভিটামিন-ডি নিয়ে বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্ম যাদের বেশীর ভাগই ভঙ্গুর ঊনুপাজরে হাড় নিয়ে বেড়ে উঠবে আর রোগ ব্যাধির বিরুদ্ধে গড়ে তুলতে পারবেনা সামান্য প্রতিরোধ-ব্যূহ যা রীতিমত জাতীয় স্বাস্থ্যের প্রতি অশনি-সংকেত।যদিও তারা পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করছে এমনকি রীতিমত দুধ পানও করছে দুবেলা। এ যেন  সুলিভানের সেই কথার মতো যিনি তাঁর গবেষণালব্ধ তথ্য প্রকাশ করতে গিয়ে আশ্চর্যান্বিত হয়েছিলেন কিছু সংখ্যক আমেরিকান কিশোরীর ভিটামিন-ডির ঘাটতি দেখে যারা সবাই ছিলো সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, প্রাণোচ্ছ্বল আর পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহনকারী। কিন্ত ছিলো ভিটামিন-ডি ঘাটতির শিকার। আর বৃদ্ধ-বণিতা তো রয়েছেনই ঘাটতির ভিতর।সুতরাং নিজে সহ পরিবারের সবাইকে নিয়ে সুর্য-স্নান করুন, উৎসাহিত করুন রৌদ্রের কাছে যেতে, প্রকৃতির কাছে যেতে।
লে. কর্ণেল (সহযোগী অধ্যাপক) নাসির উদ্দিন আহমদ: ক্লাসিফাইড মেডিসিন স্পেশালিস্ট ও এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট
সিএমএইচ, ঢাকা। ০১৮১৯০৪৬৫০৫
Print Friendly

Related Posts