মা নিলুফা চৌধুরী ওরফে নীলা চৌধুরী আদালতে না আসায় নব্বই দশকের জনপ্রিয় চিত্রনায়ক সালমান শাহকে হত্যা মামলায় আসামিদের অব্যাহতি চেয়ে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এর দাখিল করা চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে মামলাটি খারিজ করে দিয়েছেন আদালত।
রোববার (৩১ অক্টোবর) ঢাকা মহানগর হাকিম মামুনুর রশিদ বাদীপক্ষের সময়ের আবেদন নামঞ্জুর করেন।
এ সম্পর্কে নীলা চৌধুরীর আইনজীবী ফারুক আহমেদ বলেন, ‘মামলার বাদী সালমান শাহের মা দেশের বাইরে আছেন। তাই আজ (রোববার) মামলার ধার্য তারিখে নারাজি আবেদন দাখিল করলেও শুনানির জন্য সময় চেয়েছিলাম। আদালত ওই আবেদন নামঞ্জুর করেন। তখন আমরা ভার্চুয়ালি বাদীনির সঙ্গে যুক্ত হয়ে তার জবানবন্দি গ্রহণের জন্য আদালতে আবেদন করি। কিন্তু আদালত সে আবেদনও নাকচ করেন। আমরা এ আদেশের বিরুদ্ধে মহানগর দায়রা জজ আদালতে রিভিশন আবেদন দাখিল করব।’
এর আগে ২০২০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পিবিআই’র পরিদর্শক সিরাজুল ইসলাম ৬০০ পৃষ্ঠার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, সালমান শাহকে কেউ হত্যা করেনি বা অত্মহত্যার প্ররোচনাও দেয়নি। তিনি মূলত চিত্রনায়িকা শাবনূরের সঙ্গে সালমানের অতিরিক্ত অন্তরঙ্গতা, স্ত্রী সামিরার সঙ্গে দাম্পত্য কলহ, মাত্রাধিক আবেগপ্রবণতার কারণে একাধিকবার আত্মঘাতী বা আত্মহত্যার চেষ্টা, মায়ের প্রতি অসীম ভালোবাসা জটিল সম্পর্কের বেড়াজালে পড়ে পুঞ্জীভূত অভিমানে রূপ নেওয়া এবং সন্তান না হওয়ায় দাম্পত্য জীবনে অপূর্ণতার কারণেই আত্মহত্যা করেন। এ প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে নারাজি দাখিল করতে চেয়েছিলেন সালমানশাহের মা নীলা চৌধুরী।
১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সালমান শাহের ১১/বি নিউস্কাটন রোডের ইস্কাটন প্লাজার বাসায় নিজ কক্ষে তাকে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। পরে তাকে প্রথমে হলি ফ্যামেলি পরে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হলে চিকিংসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
ওই ঘটনায় সালমান শাহের বাবা কমর উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী একটি অপমৃত্যুর মামলা করেন। মামলাটি প্রথমে রমনা থানা পুলিশ পরে ডিবি পুলিশের সহকারী পুলিশ কমিশনার হুমায়ুন কবির তদন্ত করেন। তদন্তকালে সালমান শাহর লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রথম ময়নাতদন্ত করে আত্মহত্যা বলে উল্লেখ করা হয়।।
পরিবারের আপত্তি দিলে লাশ কবর থেকে তোলা হয়। লাশ পচে যাওয়ার কারণে মৃত্যুর কারণ নির্নয় কারা সম্ভব হয়নি বলে উল্লেখ করে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। সে অনুযায়ী তদন্তকারী কর্মকর্তা অপমৃত্যু বলেই প্রতিবেদন দাখিল করেন।
এরপর বাদী পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড উল্লেখ করে নারাজি দিলে ডিবির সহকারী পুলিশ কমিশনার মজিবুর রহমান তদন্ত করেন। তিনি তদন্তকালে ১৯৯৭ সালের ১৯ জুলাই সালমানের বাবার ডিওএইচএস (জোয়ার সাহারা) এর বাসায় রেজভী আহমেদ ওরফে ফরহাদ নামীয় জনৈক যুবকের আগমন ঘটে। মিথ্যা পরিচয়ে ওই যুবককে বাসায় প্রবেশের অভিযোগে তাকে কেন্টনমেন্ট থানা পুলিশের কাছে সোপার্দ করে একটি মামলা করা হয়।
ওই মামলায় রেজভীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে সে সালমান শাহ হত্যার কথা স্বীকার করে তার সহযোগী হিসেবে ডন, ডেভিড, ফারুক, আজিজ মোহাম্মাদ ভাই, সাত্তার, সাজু, সালমান শাহের স্ত্রী সামিরা, সামিরার মা লতিফা হক লুসি ও জনৈক রুবির নাম প্রকাশ করে। পরে ১৯৯৭ সালের ২২ জুলাই আদালতে তার স্বীকারোক্তি রেকর্ড করা হয়।
এরপর বাদী কমর উদ্দিন অপমৃত্যুর মামলাটি হত্যা মামলায় রূপান্তরের আবেদন করলে ১৯৯৭ সালের ২৭ জুলাই অপমৃত্যুর মামলা এবং কেন্টনমেন্ট থানার ওই মামলা একত্রে তদন্তের জন্য সিআইডিকে দেওয়া হয়। সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার খালেকুজ্জামান প্রায় সাড়ে তিন মাস তদন্তের পর ১৯৯৭ সালের ২ নভেম্বর প্রতিবেদনে বলেন, ‘জনৈক রেজভী হত্যাকাণ্ডে নিজে জড়িত এবং অন্যদের জড়িত থাকার বিষয় নাম প্রকাশ করলেও পরে জেলখানায় সে জানিয়েছে সালমান শাহ হত্যার বিষয়ে সে কিছুই জানে না। এতে প্রমাণিত হয় যে তার স্বীকারোক্তি স্বেচ্ছা প্রদত্ত ছিল না। মূলত সালমান শাহর সঙ্গে নায়িকা শাবনূরের অতিরিক্ত ঘনিষ্টতার কারণে তার স্ত্রীর সঙ্গে দাম্পত্য কলহের কারণেই তিনি আত্মহত্যা করেন।’
ওই প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে নারাজি দিলে ১৯৯৯ সালের ৭ মার্চ মামলাটি বিচার বিভাগীয় তদন্তে যায়। প্রায় ১৫ বছর ধরে মামলাটি বিচার বিভাগীয় তদন্তে সালমান শাহর বাবা কমর উদ্দিন ও মা নিলুফার চৌধুরী ওরফে নিলা চৌধুরীসহ পাঁচজনের সাক্ষ্য গ্রহণ করে ২০১৪ সালের ৮ ডিসেম্বর হত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি মর্মে প্রতিবেদন দাখিল হয়।
এরপর ওই বছর গত ২১ ডিসেম্বর মা নিলুফার চৌধুরী নারাজি দিলে ২০১৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি র্যাবকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরে র্যাবকে তদন্তে দেওয়া আদেশ উচ্চ আদালতে বেআইনি ঘোষিত হলে ২০১৬ সালের ৬ ডিসেম্বর পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত।