লে. কর্ণেল ডা. নাসির উদ্দিন আহমদ
বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবসের শ্লোগান: ১৪ নভেম্বর বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস। জনসাধারণের মাঝে এই রোগ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সারা বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে দিবসটি। এবারের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়—ডায়াবেটিক সেবায় সবার অন্তর্ভুক্তিকরণ, যদি এবার না হয় তবে কখন।
বিশ্বের প্রায় ৪২২ মিলিয়ন মানুষ এই ব্যাধিতে আক্রান্ত। আমাদের প্রায় প্রতিটি ঘরে ঘরে এই রোগের বিস্তার। সবার মাঝে উৎকন্ঠা-উদ্বেগ। দীর্ঘস্থায়ী এই রোগের জন্য প্রয়োজন সচেতনতা। রোগটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলে দেখা দেয় নানাবিধ জটিলতা। এই রোগের কার্যকরী ওষুধ হলো ইনসুলিন। একশত বছর আগে এত মোক্ষম ও মূল্যবান জীবন রক্ষাকারী ওষুধ আবিষ্কার হলেও এখনো বিশ্বের কোটি কোটি ডায়াবেটিস আক্রান্ত মানুষ এই চিকিৎসা সেবা থেকে বন্চিত।
ডায়াবেটিসের জটিলতা:
মানব দেহের এক গুরুত্বপূর্ণ হরমোন বা প্রাণরস হলো ইনসুলিন। এটির ফ্যাক্টরী অগ্নাশয়ে। আমাদের উপরের পেটে পেছনের দিকে পাতার মতো একটি অঙ্গ হলো অগ্নাশয়। এই অঙ্গটি প্রতিনিয়ত তৈরী করছে ইনসুলিন। ডায়াবেটিসের মূল সমস্যা হলো ইনসুলিনের ঘাটতি অথবা অকার্যকারিতা। শরীরের কোষে গ্লুকোজ প্রবেশের বাহক হলো ইনসুলিন। এর অভাব ঘটলে অথবা এটি অকার্যকর হলে গ্লুকোজ কোষে প্রবেশের অনুমতি পায় না। তখনই দেখা দেয় বিপত্তি। রক্তে হু হু করে বাড়তে থাকে চিনির মাত্রা। তখন শরীর নেতিয়ে পড়ে। মূত্র নি:সরণ বেড়ে যায়। ক্ষুদ-পিপাসা বৃদ্ধি পায় কিন্ত ওজন কমতে থাকে ক্রমশ। চোখের জ্যোতি কমতে শুরু করে। এক পর্যায়ে এ রোগের জটিলতায় মানুষ চিরদিনের মতো অন্ধ হয়ে যায়। কিডনীতে নেমে আসে জটিলতা। ক্ষেত্রবিশেষে কিডনী বিকল হয়ে যায়। স্নায়ুতন্ত্র আক্রান্ত হয়। পায়ে দেখা দেয় ক্ষত বা আলসার। কখনো দেখা দেয় পচন-রোগ বা গ্যাংগ্রীন। তখন পা কেটে ফেলতে হয় জীবন রক্ষার্থে। এ রোগে রক্তনালীতে জমতে থাকে চর্বির আস্তরণ। হার্ট এটাক, আর স্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যায় চারগুণ। এভাবে ডায়াবেটিস যেন শরীরের সমস্ত তন্ত্রের জন্য ব্যাপক জটিলতার দ্বার উন্মোচন করে দেয়।
ইনসুলিনে আশাবাদ:
ইনসুলিন আবিষ্কারের পূর্বে টাইপ-১ ডায়াবেটিসে মৃত্যু ছিলো অবধারিত। এই ডায়াবেটিসে অগ্নাশয়ের ইনসুলিন উৎপাদনের কোষ ধ্বংস হয়ে যায়। ফলে ইনসুলিনের অভাবে শরীরের চর্বি ভেঙে কিটো-এসিড তৈরী হয়। রক্তে এই এসিড বেড়ে গেলে রোগী অজ্ঞান হয়ে মৃত্যু বরণ করে।
ইনসুলিন আবিষ্কার এই সকল রোগীদের জন্য জীবন বর্তিকা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলো। বিশ্বের ডায়াবেটিস রোগীদের শতকরা ৫-১০ ভাগ টাইপ-১ ডায়াবেটিসে ভুগছেন। বাকী প্রায় সবাই টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।
ডায়াবেটিসে করণীয়:
ডায়াবেটিস দেখা দিলে যাপিত জীবনে পরিবর্তন আনতে হবে। খাদ্যাভ্যাস বদলে ফেলতে হবে। চিনি কিংবা চিনি জাতীয় খাবার পরিহার করতে হবে। ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। মেদ-ভূঁড়ি ঝেঁটে বিদায় করতে হবে।নিয়মিত শরীরচর্চা বা হাঁটার অভ্যাস তৈরী করতে হবে। নিজেকে রাখতে হবে সচল, কর্মময়। অতিরিক্ত স্ট্রেস থেকে মুক্ত রাখতে হবে শরীর-মন। ঘুমাতে হবে দৈনিক সাত ঘন্টা করে। ধূমপান কিংবা মদ্যপানের বদভ্যাস থেকে মুক্ত থাকতে হবে। নিয়মিত ওষুধ সেবন করে রক্তের চিনির মাত্রা কাঙ্খিত সীমার মধ্যে রাখতে হবে। নিয়মিত পরখ করে দেখতে হবে কোনো জটিলতা তৈরী হচ্ছে কিনা। ডায়েট (খাদ্যাভ্যাস), ডিসিপ্লিন (শৃঙ্খলা) এবং ড্রাগ (ওষুধ) এই তিন “ডি” দিয়ে মোকাবিলা করতে হবে বড় ডি তথা ডায়াবেটিসকে।
লে. কর্ণেল ডা. নাসির উদ্দিন আহমদ
ক্লাসিফাইড মেডিসিন স্পেশালিস্ট ও এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট সিএমএইচ, ঢাকা।
চেম্বার: আল-রাজি হাসপাতাল, ফার্মগেট। মোবাইল: ০১৮১৯০৮৬৫০৫, ০১৭৫৬১৭৩৭৬৫