বাবা-মাকে একসঙ্গে পেলো জান্নাত, প্রশংসায় ভাসছেন বিচারক

আবু নাঈম, পঞ্চগড়: ১১ মাস বয়সি নুরে জান্নাত জন্মের পর থেকেই বাবার আদর থেকে বঞ্চিত। তার মা যখন ৮ মাসের অন্তঃস্বত্ত্বা তখন থেকেই পারিবারিক কলহে আলাদা থাকতেন বাবা নুরজামাল এবং মা আখি মনি।

অবশেষে বিচারকের বিচক্ষণতায় মীমাংসা হলো সেই কলহ, মা-বাবাকে প্রথমবারের মত একসঙ্গে পেল নুরে জান্নাত।

রোববার (২৩ জানুয়ারি) বিকেলে পঞ্চগড়ের অতিরিক্ত চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক মতিউর রহমান তার খাসকামরায় এই কলহ মিমাংসা করেন।

এ সময় নুরে জান্নাতের মা-বাবা ও স্বজনদের উপস্থিতিতে সৃষ্টি হয় আনন্দঘন মুহূর্তের। বিচারকের আয়োজনেই মিষ্টিমুখ করানো হয় উপস্থিত সবাইকে। শিশুটির জন্য কেনা নতুন পোশাক নিজের হাতে পরিয়ে দেন বিচারক মো. মতিউর রহমান।

বিষয়টি নিয়ে রোববার রাতেই বিচারক মতিউর রহমান তার ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডিতে একটি স্টোরি লিখে স্ট্যাটাস দেন। স্ট্যাটাসটি ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই প্রশংসায় ভাসছেন তিনি।

পাঠকদের জন্য স্ট্যাটাসটি তুলে দেওয়া হলো-

নুরে জান্নাতের মায়ের সাথে যখন ওর বাবার দাম্পত্য কলহ শুরু হয় তখন ওর বয়স মাত্র আট মাস; আট মাস বলতে মাতৃগর্ভে ৮ মাস। মায়ের পেটে আরো দুই মাস থাকার পর নুরে জান্নাত যখন পৃথিবীতে আসে তখন বাবা-মা দুজনেই আদালতের দুই কাঠগড়ায়। বাবা, মায়ের বিরুদ্ধে এবং মা, বাবার বিরুদ্ধে পাল্টাপাল্টি অভিযোগে মামলা দায়ের করে।

সেই ২০১৯ সালের নভেম্বর হতে চলছে মামলা। নুরে জান্নাত ভূমিষ্ঠ হয়ে বড় হয়েছে। কিন্তু বাবার স্নেহ পরশ বঞ্চিত তীব্র দুঃখ-হতাশা নিয়ে। গত দুইদিন আগে ২০১৯ সালের মামলাটি সাক্ষীর জন্য ডাক পড়ে। এক পক্ষে নুরে জান্নাতের বাবা নুরজামাল ইসলাম আর অপরপক্ষে মা আখি মনি। আখিমনির কোলে নুরে জান্নাত। নুরে জান্নাত ওর বাবাকে চেনেনা এখনো। চেনেনা বলতে দেখা হয়নি কোনদিন। দূর থেকে দেখা হলেও স্পর্শ পায়নি বাবার। বাবা ও মায়ের হাজারো দোষ থাকলেও এই এগারো মাস বয়সী নুরে জান্নাত বোঝেনা এসবের কোন কিছুই। সার্বজনীন এই শিশুদের মধ্যে কোন রাগ নেই, অনুরাগ নেই, সুশীল সমাজের বিরোধ নেই, সাংবিধানিক সংকট নেই। অথচ সমাজের সবচেয়ে ভয়ানক দ্বন্দ্ব আর বিচ্ছেদের শিকার কচি মনগুলো।

আমি এজলাসে বসে নুরে জান্নাতের নাম ধরে ডাকি। নুরে জান্নাত আমার দিকে তাকায়। নিজের হাতে নিজে তালি দেয়। শব্দহীন সে তালি বাজে না। বাবা বিহীন পৃথিবীতে তালি বাজার কথাও নয়। আমি বাজাতে চাই সে তালি। খুব করে উভয়পক্ষের সাথে কথা বলি। পরস্পরের পজিটিভ দিক গুলো তুলে ধরি। দিনশেষে ব্যর্থ হয়ে ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরি। দুনিয়ার সবচেয়ে তীব্র হতাশা আর না পারার গ্লানি আমাকে কুরে কুরে খায়। আমি কেন পারিনা নুরে জান্নাতদের মুখে হাসি ফোটাতে! নিজের উপর খুব রাগ হয় আমার।
হাল ছাড়ি না তবুও। আবার ডেট রাখি দুইদিন পরে।
আজ একটার পর একটা মামলার ডাক পড়ে, অবশেষে ডাক পড়ে আখি মনির। আদালতের পেয়াদা হাক ছাড়ে- আখি মনি হাজির…
নুরে জান্নাতকে সাথে নিয়ে আখি মনি হাজির হয়। সাথে আখিমনির নানা-নানি সহ সবাই। প্রকাশ্য আদালতে বলি- নুরে জান্নাত বড় হলে আমি ওর কাঁধেই দিতাম এই বিচারের ভার। আর দর্শক হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখতাম এই পিতা-মাতার কি বিচার করেন ছোট্ট শিশু নূরে জান্নাত।
অবুঝ ছোট শিশু আদালত, কাঠগড়া, বিচারক এসবের বোঝেনা কিছুই। বোঝে শুধু আদর আর ভালোবাসা।
অতীতকে ভুলে গিয়ে শুধু নুরে জান্নাতের জন্য একে অপরকে ক্ষমা করে দেওয়ার বিনীত অনুরোধ করি আমি। অবশেষে বরফ গলতে শুরু করে। নুরজামাল এগিয়ে এসে হাত ধরে আখিমনির। আখি মনির আঁখি আর বাধা মানে না। প্রায় দুই বছর হতে জমিয়ে রাখা চোখের জল…
এগারো মাস বয়সী নুরে জান্নাতকে বাবা আজ প্রথম কোলে নেবে- পরশ দেবে এ জন্য সামান্য একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে খুব মন চায় আমার।
নুরে জান্নাত এর বাবার হয়ে (এজলাস ২০ মিনিটের জন্য মুলতবি করে) বাজার থেকে মিষ্টি আর জান্নাত এর কাপড় নিয়ে ফিরে আসি।
আমার খাসকামরায় উভয়কে ডাকি। সবার আগে মিষ্টি খায় জান্নাত। তারপর বাবার হাত ধরে …..
তিনটি মানুষের ছয়টি হাত একসাথে হয়।
নুরে জান্নাত অপলক তাকিয়ে থাকে বাবার দিকে।
অস্ফুট স্বরে বলে, বাবা এতদিন তুমি কোথায় ছিলে…

আদালত সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ সালের ১৬ অক্টোবর দেবীগঞ্জ উপজেলার সোনাহার মল্লিকাদহ ইউনিয়নের নুল্ল্যাপাড়া এলাকার নজরুল ইসলামের ছেলে নুরজামাল ইসলাম (২৭) এবং নীলফামারী জেলার ডোমার উপজেলার বড় রাউতা এলাকার রাশেদুল ইসলামের মেয়ে আঁখি মনির (২৫) বিয়ে হয়। বিয়ের কিছুদিন পর নুরজামাল শ্বশুরবাড়িতে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে অংশ নেন। পরে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে আসতে চাইলে উভয় পক্ষের মধ্যে বাকবিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে তারা নুরজামালকে মারধর করেন। এ ঘটনায় নুরজামাল ২০১৯ সালের ৩ ডিসেম্বর তার শ্বশুরসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে পঞ্চগড় আদালতে একটি মারধরের মামলা করেন। সেই মামলা চলাকালে নুরজামাল তার স্ত্রী আখি মনিকে বাড়িতে নিয়ে এসে সংসার করছিলেন। এরপর আবারও কলহের সৃষ্টি হলে আখি মনি বাবার বাড়িতে যান।

এদিকে, ২০২০ সালের ৪ ডিসেম্বর স্বামী নুরজামালের বিরুদ্ধে পঞ্চগড় আদালতে একটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন আখি মনি। স্বামী-স্ত্রী আলাদা থাকতে শুরু করেন। ওই মামলা দায়েরের সময় আঁখি মনি আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। এরপর বাবার বাড়িতেই নুরে জান্নাতের জন্ম হয়।

পঞ্চগড়ের অতিরিক্ত চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বেঞ্চ সহকারী আশরাফুল ইসলাম বলেন, নুরজামাল ইসলামের দায়ের করা মামলাটির সাক্ষ্য গ্রহণ চলছিল। ১১ মাসের ছোট্ট শিশুটি নিয়ে আদালতে আসা-যাওয়ার বিষয়টি বিচারক মতিউর রহমানকে ভাবনায় ফেলে দেয়। ফুটফুটে শিশুটির ভবিষ্যতের কথা ভেবেই তিনি আপসের উদ্যোগ নিয়েছেন। দুই পক্ষকে ডেকে পরস্পরের মধ্যে সমঝোতা করে দিয়েছেন। দুজনের দুটি মামলায় আপসনামা দাখিল করার সিদ্ধান্তও হয়েছে।

নুরজামাল ইসলাম বলেন, বাবা হিসেবে আমার মেয়েকে ১১ মাস পর কোলে নিতে পেরে সত্যিই খুব ভালো লাগছে। আমাদের দাম্পত্য জীবন ফিরিয়ে দিতে বিচারকের এই উদ্যোগ আমি সারা জীবন মনে রাখব।

 

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts