বুয়েটছাত্র ফারদিন নূর পরশ হত্যার ঘটনায় প্রধান আসামি তার বান্ধবী বুশরাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (১০ নভেম্বর) মামলা হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্রী বুশরাকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
বৃহস্পতিবার সকালে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন রামপুরা থানার ওসি রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার রাতে মামলা হয়েছে। মামলার প্রধান আসামি বুশরাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
জানা গেছে, বুশরাকে তার রামপুরার বাসা থেকে গ্রেফতার করেছে রামপুরা থানা পুলিশের একটি দল।
ফারদিনের বাবা নূর উদ্দিন রানা বাদী হয়ে রামপুরা থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলায় বান্ধবী বুশরাসহ আরও কয়েকজনকে আসামি করা হয়।
এর আগে নিখোঁজের তিন দিন পর নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে শীতলক্ষ্যা নদী থেকে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র ফারদিন নূর পরশ (২৪) এর লাশ উদ্ধার করা হয়। ফারদিন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিবেটিং ক্লাবেরও যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন তিনি।
সোমবার সন্ধ্যায় সিদ্ধিরগঞ্জের গোদনাইলের লক্ষ্মী নারায়ণ কটন মিলের পেছনে শীতলক্ষ্যা নদীর বনানী ঘাটসংলগ্ন এলাকা থেকে তার লাশ উদ্ধার করে নৌ-পুলিশ। ফারদিন নূর পরশ নারায়ণগঞ্জ সদর থানার কুতুবপুর দেউলপাড়ার নয়ামাটি এলাকার কাজি নুরুদ্দীন রানার ছেলে। তার পরিবার ঢাকার ডেমরার কোনাপাড়ার শান্তিবাগ এলাকায় বসবাস করে। তিন ভাইয়ের মধ্যে পরশ সবার বড়।পরশ গত ৪ নভেম্বর থেকে নিখোঁজ ছিলেন। এ ঘটনায় নিহতের বাবা কাজী নুরুদ্দিন ঢাকার রামপুরা থানায় একটি জিডি করেছিলেন।
পরশকে সর্বশেষ দেখা গেছে ঢাকার রামপুরায়, তার মোবাইল ফোনটি তারপর এগিয়েছে সদরঘাটের দিকে, সর্বশেষ জানা অবস্থান কেরানীগঞ্জে; আর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলে শীতলক্ষ্যা নদীতে।
তিন দিন আগে নিখোঁজ ফারদিনের লাশ কীভাবে সেখানে গেল? তিনি হত্যাকাণ্ডের শিকার হলে কোথায় তাকে হত্যা করা হয়েছে? খুনি কারা? সবই এখনও ধোঁয়াশা পুলিশের কাছে।
বুয়েটের পুরকৌশলের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ফারদিন থাকতেন পরিবারের সঙ্গে ঢাকার ডেমরার কোনাপাড়ায় পরিবারের সঙ্গে। কাজী নূর উদ্দিন রানার তিন ছেলের মধ্যে ফারদিন সবার বড়।
ফারদিন গত শুক্রবার দুপুরে বাসায় খেয়ে বেরিয়েছিলেন বলে জানান তার বাবা নূর উদ্দিন। বাসায় মা’কে বলে গিয়েছিলেন, শনিবার পরীক্ষা আছে, তাই বন্ধুদের সঙ্গে একত্রে পড়াশোনা করবেন হলে থেকে। পরীক্ষা শেষে বাসায় ফিরবেন শনিবার বিকালে।
কিন্তু শনিবার পরীক্ষায় ফারদিন ছিলেন অনুপস্থিত। তখন তার বন্ধুরা সেটা পরিবারকে জানালে উদ্বেগাকূল হয়ে পড়েন তার বাবা-মা। কোনো খবর না পেয়ে নূর উদ্দিন রামপুরা থানায় ছেলের হারানোর বিষয়টি নিয়ে একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।
সেই জিডির তদন্তে গিয়ে ফারদিনের রামপুরা থেকে সদরঘাটের দিকে যাওয়ার তথ্য পাওয়া যায় বলে জানিয়েছেন রামপুরা থানার ওসি রফিকুল ইসলাম।
তিনি বলেন, জিডির পরেই আমরা কাজ শুরু করি। মোবাইল ফোনের লোকেশন অনুযায়ী সে (ফারদিন) রামপুরা থেকে জনসন রোড হয়ে সদরঘাটের দিকে গেছে বলে আমরা লাশ উদ্ধারের আগেই জানতে পারি।
পুলিশ বলছে, ফারদিন ও তার বান্ধবী শুক্রবার বিকালে ধানমণ্ডির ইয়াম চা রেস্তোঁরায় খেয়ে নীলক্ষেতে এসেছিলেন। সেখানে বই কিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আইসক্রিম খান। এরপর রাত ১০টার দিকে তারা রিকশায় করে রামপুরা এলাকায় যান। রামপুরা পুলিশ বক্সের সামনে ফারদিন রিকশা থেকে নেমে যান।
এরপরই ফারদিনের মোবাইল ফোনের গতিপথ সদরঘাটের দিকে পেয়েছে পুলিশ; কিন্তু তিনি কেন লালবাগের বুয়েটের দিকে না এগিয়ে সদরঘাটের দিকে গেলেন, সেই প্রশ্নের উত্তর কেউ দিতে পারছে না।
রামপুরা থানার ওসি রফিকুল জানান, তারা ফারদিনের মোবাইল ফোনের সর্বশেষ অবস্থান পেয়েছেন শুক্রবার রাতে কেরানীগঞ্জ এলাকায়। তারপর থেকে আর পাননি, হয়ত মোবাইল ফোন বন্ধ ছিল বলে।
শুক্রবার রাত ১১টার পর থেকে ফারদিনের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল বলে তার মা ফারহানা ইয়াসমিন জানিয়েছেন।
সদরঘাটে বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারেই কেরানীগঞ্জ। পুলিশ কর্মকর্তাদের ধারণা, ফারদিন হয়ত নদীতে কোনো নৌযানে উঠেছিলেন বলে মোবাইলটির অবস্থান রাতে কেরানীগঞ্জে ধরা পড়ে।
সদরঘাটের দিকে ফারদিনের যাওয়ার উদ্দেশ্য যেমন জানা যাচ্ছে না, তেমনি তার জানা গন্তব্য বুয়েট হলেও কোনো নৌযানে ওঠার কারণও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ বুয়েটে যেতে নদী পথে কিংবা নদী পার হওয়ার কোনো প্রয়োজন পড়ে না।
ফারদিনের লাশ পাওয়া গেছে গোদনাইলে বর্ণালী টেক্সটাইল মিলের ঘাট এলাকায়। উদ্ধারের সময় তার হাতে ঘড়ি পরা ছিল; জামা-প্যান্ট ছিল প্রায় অক্ষত। তার মানিব্যাগও সঙ্গে ছিল বলে পুলিশ জানিয়েছে।
মঙ্গলবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে ফারদিনের ময়নাতদন্ত হয়। তাতে যুক্ত থাকা চিকিৎসক শেখ ফরহাদ বলার পর জানা যায়, নিখোঁজ হওয়ার দিনই হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন ফারদিন।
এই চিকিৎসক বলেন, নিহতের মাথা ও বুকে একাধিক আঘাতের চিহ্ন রয়েছে৷ তিন দিন আগেই তার মৃত্যু হয়েছে৷ মৃত্যুর পূর্বে শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন ওই ছাত্র৷ এটি হত্যাকাণ্ড বলেই ময়নাতদন্তে প্রতীয়মান হয়েছে।
তাহলে ফারদিনকে কি সদরঘাটে হত্যার পর লাশ বুড়িগঙ্গায় ফেলা হয়েছিল?
সাধারণ অর্থে সেই প্রশ্নের উত্তর ‘না’ হবে। কারণ বুড়িগঙ্গা থেকে অনেক দূরত্বের শীতলক্ষ্যার ওই অংশে ভেসে যাওয়া আপাতদৃষ্টিতে সম্ভবপর নয়।
মানচিত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, বুড়িগঙ্গার পানির স্রোত দক্ষিণ দিয়ে গিয়ে মিশেছে ধলেশ্বরীতে, এরপর মিলিত স্রোত গিয়ে মেঘনায় পড়েছে ধলেশ্বরী নামে। আর শীতলক্ষ্যাও অন্যদিক থেকে মেঘনার দিকে বহমান। অর্থাৎ বুড়িগঙ্গা থেকে কিছু ভেসে গেলে তা ভাটির দিকে মেঘনার আরও গভীরেই যেতে পারে। মেঘনায় কিছু দূর এগিয়ে আবার শীতলক্ষ্যার উজানের দিকে অর্থাৎ পানির স্রোতের বিপরীত দিতে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, নদীর স্রোতও খুব বেশি নেই যে দুদিনে একটি লাশকে টেনে কয়েক কিলোমিটার নিয়ে যাবে।
নৌপুলিশের নারায়ণগঞ্জ থানার ওসি মনিরুজ্জামানের ধারণা, ফারদিনের লাশ ডেমরা কিংবা আশপাশের এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলা হলে তা নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলে ভেসে আসার যুক্তি পাওয়া যায়।
ডেমরার পাশে ফারদিনের বাবার বাড়ি কোনাপাড়ায় কোনো বিরোধের কারণে এই তরুণ হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে পারেন, তেমন কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না।
তার পরিবারও সেদিকে কাউকে সন্দেহ করছেন না। ছিনতাই কিংবা ডাকাতির শিকার হলে ফারদিনের মোবাইল ফোন কিংবা মানিব্যাগ খোয়া যেত বলে মনে করছেন পুলিশ কর্মকর্তারা।
ফারদিনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বুয়েটের কোনো জটিলতা তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে নিয়েছে কি না, সেই প্রশ্নও উড়িয়ে দিচ্ছেন বুয়েটে তার সতীর্থরা।
২৪ বছর বয়সী ফারদিন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিবেটিং ক্লাবের যুগ্ম-সম্পাদক ছিলেন। আসছে ডিসেম্বরে স্পেনের মাদ্রিদে আয়োজিত একটি ডিবেটিং অনুষ্ঠানে বুয়েটের প্রতিনিধিত্ব করার কথা ছিল তার।
মঙ্গলবার বুয়েটে জানাজা শেষে এক মানববন্ধনে বুয়েট শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে লিখিত এক বক্তব্যে বলা হয়, ফারদিন ব্যক্তিজীবনে অত্যন্ত মেধাবী এবং নির্ঝঞ্ঝাট’ ছিল।আমরা কয়েকটি প্রিন্ট ও সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছু মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্যবিশিষ্ট সংবাদ দেখেছি, যা অপ্রত্যাশিত। চলমান তদন্তের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে আমরা সকলকে অনুরোধ করছি এ ধরনের ভুল তথ্য প্রচার থেকে বিরত থাকতে।