পরিচয় থেকে প্রণয়। ঘটনাচক্রে ধর্ষণ মামলা। ধর্ষকের কারাবাস। অবশেষে বিয়ের শর্তে মুক্তি। মুক্ত জীবনে শুরু হলো তাদের দাম্পত্য জীবন। কিন্তু যেখানে বিশ্বাস, ভালোবাসা থাকে না সেখানে ঝামেলা হওয়াই স্বাভাবিক। শুরু হলো দোষারূপের অভিযোগ। মাত্র সাত মাসও টিকলো না তাদের বেঁধে দেওয়া বিয়ের বন্ধন।
হাসানুজ্জামান বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের প্রজেক্টে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২০২০ সালে ফেসবুকের মাধ্যমে তাদের পরিচয়। প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে তাদের। এরপর থেকে আসামি ভিকটিমকে বিয়ের প্রস্তাব দেন এবং তার সাথে বিভিন্ন জায়গায় দেখা করতে চান। তারা বিভিন্ন জায়গায় দেখাও করেন। প্রেমের সম্পর্কের কারণে বিয়ের প্রলোভনে দেখিয়ে আসামি গত বছরের ১৬ জানুয়ারি বিকেল থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি আদাবরের একটি বাসায় স্বামী-স্ত্রী হিসেবে বসবাস করেন। ওই সময় ভিকটিমকে প্রতিনিয়ত ধর্ষণ করেন আসামি। এরপর ভিকটিম আসামিকে বিয়ের কথা বললে বিভিন্ন তারিখ দিয়ে কালক্ষেপণ করতে থাকেন। আসামি বিভিন্ন সময় ভিকটিমের কাছ থেকে সাত লাখ টাকাও নেয়। একপর্যায়ে চাপ দিলে ২১ ফেব্রুয়ারি দুপুরে আসামি ভিকটিমকে জানিয়ে দেয়, তিনি বিয়ে করবেন না।
এরপর ভিকটিম গত ৬ মার্চ আদাবর থানায় মামলা করেন। পুলিশ আসামিকে গ্রেপ্তার করে। এরপর হাসানুজ্জামান সিএমএম আদালতে জামিন আবেদন করেন। কিন্তু জামিন পাননি। পরে তিনি মহানগর দায়রা জজ আদালতে জামিন আবেদন করেন। আদালত মামলাটি ঢাকার ৪র্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে পাঠান। ১৭ এপ্রিল সংশ্লিষ্ট আদালত বিয়ের শর্তে জামিন পাবেন মর্মে জানিয়ে ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে পাঠানোর আদেশ দেন। । এরপর কারামুক্ত হতে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন আসামি হাসানুজ্জামান।
১৯ এপ্রিল ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মোছা. বিলকিছ আক্তারের আদালত আসামি হাসানুজ্জামানের জামিন মঞ্জুর করেন। এরপর এজলাসে বসেই বিয়ে পিঁড়িতে বসেন তারা। ১২ লাখ টাকা দেনমোহরে তাদের বিবাহের কাজ সম্পন্ন হয়। প্রায় দেড় মাস কারাভোগের পর বিয়ে করে মুক্তি পান হাসানুজ্জামান। তারা মোহাম্মদপুরের শেখের টেকে একটি বাসায় একত্রে বসবাস করেন। দাম্পত্য কলহের কারণে তাদের সংসার সাত মাসও টেকেনি। গত ২৬ অক্টোবর হাসানুজ্জামান ভিকটিমকে ডিভোর্স লেটার পাঠান। এদিকে মামলা থেকে অব্যাহতি পাওয়া হাসানুজ্জামানের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতন ও যৌতুক আইনে পৃথক দুটি মামলা করেছেন ভিকটিম।
মামলা সম্পর্কে ভিকটিম বলেন, সামাজিক স্বীকৃতির জন্য হাসানকে বিয়ে করেছিলাম। কিন্তু কি হলো আবার। ৬ মাসও সংসার করতে পারলাম না। গত ২৬ অক্টোবর হাসানকে আমাকে ডিভোর্স দেওয়ার কথা জানায়। যদিও আমি এখনো কোনো কাগজ পাইনি।
তিনি বলেন, মোহাম্মদপুরের শেখেরটেকে একটি বাসায় আমি, হাসান ও তার মা বাস করতাম। আমাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করতো হাসান। বলে, মামলা থেকে বাঁচতে তোমাকে বিয়ে করেছিলাম। এখন মামলা শেষ। আমি আর তোমার সাথে সংসার করতে চাই না। যদি সংসার করতে চাও তাহলে ৫ লাখ টাকা দেও। মামলা চালাতে আমার ৫/৬ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। তোমার কারণে আমার এতগুলো টাকা খরচ হয়েছে।
বাদী বলেন, অনেকভাবে অত্যাচার করেছে। তারপরও চেষ্টা করেছি সংসার করার। অত্যাচার করেছে আবার আমার বিরুদ্ধে থানায় জিডিও করেছে। অভিযোগ করেছে- আমি উচ্চস্বরে কথা বলি, তার কাছে টাকা চাই। আমার মা একবার বাসায় এসেছিলো। তার নামেও জিডি করেছে। আমার কথা, মাত্র কয়েকমাস সংসার শুরু করেছি। আমার ভুল হতে পারে। সংশোধনের সুযোগ দিবে না। একটা বার সুযোগ দিয়ে দেখুক। আর টাকা কোথা থেকে দিবো। আমি একটা সরকারি চাকরি করি। যে টাকা জমিয়েছিলাম সেই টাকা থেকে সাত লাখ টাকা দিয়েছি। সেই টাকাও আর চাইনি। যে মামলায় ওর খরচ হয়েছে। এখন আমাকে একা বাসায় রেখে তারা চলে গেছে। কোনো খোঁজ খবর নেয় না। ওর ভাই, বোনদের ফোন দিয়ে বলেছি এসব কথা। তারা বলে তোমাদের বিষয়, তোমরা দেখো। তারা কিছু করতে পারবে না।
তিনি বলেন, দুইবার ধোঁকা খেয়েছি। তারপরও আমি তার সাথেই সংসার করতে চাই। স্বীকৃতি ধরে রাখতে চাই।
হাসানুজ্জামান বলেন, বিয়েটা করেছিলাম, সংসারও করছিলাম। কিন্তু সে প্রতিনিয়ত বলতে থাকে, তোমার ক্ষতি করবো। টাকা চাই প্রতিনিয়ত। শুনেছি আমার বিরুদ্ধে আরও একটি মামলা দিছে। বাসাটার যত ফার্নিচার নিজের দখলে রেখে দিয়েছে। সবকিছু ভোগ দখল করে আছে। কতক্ষণ পর্যন্ত এসব অত্যাচার সহ্য করা যায়। প্রতিনিয়ত হুমকি ধামকি দিয়েই চলে।
নিজেকে ভিকটিম দাবি করে হানসানুজ্জামান বলেন, যে অভিযোগটা আমাকে দেওয়া হয়েছিল তা সত্য নয়। বিয়ের প্রলোভনে তাকে আমি ধর্ষণ করিনি। কোনো প্রলোভনও আমি দেখাইনি। যাই হোক নিজে ভিকটিম হয়ে সেদিন পজিটিভলি বিয়ে করে সংসারটা শুরু করলাম। এরপর থেকে আমার কাছে টাকা ধার চায়। আমি ধার দিবো না জানালে বলে তাহলে আমার দেন মোহরের টাকা দাও। তার এটা সেটা লাগবে। আমিও তো একটা মানুষ। বিষয়টি নিয়ে থানায় একটি অভিযোগ করি। পুলিশ আমার পক্ষে রিপোর্ট দিয়েছে।
তিনি বলেন, আমি আরও একটা মামলার সাথে জড়াচ্ছি। একের পর এক মামলা দিয়ে যদি আমাকে হয়রানি করা হয়, তাহলে আমি যাবোটা কোথায়। অবশেষে বাসা থেকে বের হয়ে আসি। মানসিক, আর্থিক সবকিছু মিলিয়ে এ সিদ্ধান্ত নেই। বাসায় থাকলে আমি স্বাভাবিক থাকতে পারতাম না।
সংসার করার ইচ্ছা ছিলো জানিয়ে হাসানুজ্জামান বলেন, সংসার করার জন্য তাকে বাসায় এনেছিলাম। চেষ্টা করেছিলাম সুখ না হোক, হ্যাসেলটা যেন না হয়। সর্বোচ্চ চেষ্টাও করেছিলাম। কিন্তু তা আর হলো। মানসিক টর্চার এবং টাকার প্রেশারে তাকে ডিভোর্স দেই।
বাদীপক্ষের আইনজীবী আজাদ রহমান জানান, ভিকটিমকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে আসামি ধর্ষণ করে। এরপর বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়। জানি এরকম সংসার টেকে না। তারপরও আমরা চেয়েছিলাম তারা একত্রে সংসার করুক। কিন্তু তা আর করতে পারলো না। মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়ে ভিকটিমকে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়েছে বলে শুনেছি।
আসামিপক্ষের আইনজীবী মো. আলমগীর হোসেন বলেন, হাসানুজ্জামান কারামুক্ত হতে বাদীকে বিয়ে করেছিলেন। তিনি মামলা থেকেও অব্যাহতি পেয়েছেন। এ পর্যন্ত আমি জানি। এরপর হাসানুজ্জামান আমাকে ফোন করে ডিভোর্সের বিষয়টি জানায়। আমি বলেছি, ডিভোর্সের কাজ আমি করি না। যেহেতু হাসানুজ্জামান তাকে ডিভোর্স দিয়েছে, চাইলে ভিকটিম আইনের সহায়তা নিতে পারে।