মঈনুনুদ্দীন তালুকদার হিমেল: দেশের বেকারত্ব ঘুচিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে ফ্রিল্যান্সিং। তাই ফ্রিল্যান্সারদের দেশের সম্পদ হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। তবে এবার সে ফ্রিল্যান্সিংয়ে প্রায় লাখটাকা বেতনে কাজ করতে গিয়ে পর্নগ্রাফির মামলায় দিশেহারা শতাধিক ফ্রিল্যান্সার। অবৈধ পন্থার সিপিএ মার্কেটিং কাজে যুক্ত হবার ফলে হুমকিতে পড়েছে তাদের ভবিষ্যৎ।
এই ঘটনায় ৪ জন গ্রেপ্তার হলেও বাকিরা পলাতক রয়েছেন। ঘটনাটি ঘটেছে দেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় জেলা ঠাকুরগাঁওয়ে।
জানা গেছে, ঠাকুরগাঁও শহরের হাজিপাড়ায় মহিলা কলেজ সংলগ্ন একটি ৪ রুমের বাসা ভাড়া নেয় সোহাগ নামক এক যুবক। সেখানে দক্ষ কিছু ফ্রিল্যান্সার নিয়ে অবৈধ পন্থায় সিপিএ মার্কেটিং এর কাজ শুরু করেন তিনি। তবে সম্ভাবনাময় এই কর্মক্ষেত্রকে ভুলদিকে পরিচালনা করেন সোহাগ।
এই বিষয়ে কথা হয় সোহাগের অফিসে কাজের সুবাদে বিপথগামী এক ফ্রিল্যান্সারের সাথে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই যুবক জানান, সোহাগের অফিসে মূলত সিপিএ মার্কেটিং এর কাজ হতো (CPA Marketing)। কৌশলী হলে এই পেশা থেকে প্রচুর টাকা আয় করা সম্ভব। তবে সোহাগরা কৌশল হিসবে কিছুটা অবৈধ পথ অবলম্বন করেছিলো।
এই ফ্রিল্যান্সার জানান, CPA অর্থ হচ্ছে “Cost Per Action“. অর্থাৎ এখানে ছোট ছোট কিছু টাস্ক (Task) পূরণ করে দিতে হবে। যার বিনিময়ে আপনি কিছু কমিশন পাবেন। বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে বা সাইটে আশা ভিজিটরদের CPA Marketing এর মাধ্যমে কোম্পানির নির্ধারিত সাইটে নিয়ে যাওয়াই হল ফ্রিল্যান্সারদের কাজ।
ব্যবসায়িক সাইট বা কোম্পানিগুলো তাদের পণ্য প্রচার বা সাইটের কোন সার্ভে করতে সিপিএ মার্কেটিং এর শরণাপন্ন হয়। বিভিন্ন উপায়ে এসকল কোম্পানির প্রমোশনাল কাজ সম্পন্ন করা হয়।
তিনি বলেন, সাধারণত যারা CPA মার্কেটিং করে তাদের নিজস্ব সাইট থাকে। আমাদের সাইটে কোম্পানির নির্ধারিত লিংক অ্যাটাচ করা থাকে। এতে করে ভিজিটর সাইটের কোথাও ক্লিক করলে অ্যাটাচ করা সাইটে যেতে বাধ্য হয়। আর এই ক্লিক করার সাথে সাথেই আমাদের কাজ সম্পূর্ণ হবে। আমরা ক্লিকের বিনিময় টাকা পাবো। তবে ভিজিটরদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পর্ন ছবি ও ছোটো ছোটো পর্ন ফুটেজ ব্যবহার করতো সোহাগ। ভিজিটররা সেই পর্ন ছবি বা ভিডিও দেখতে ক্লিক করলেই অ্যাটাচ করা সাইটে চলে যেতো। এতে করে বেশি পরিমাণ ক্লিক পাওয়া যেতো। বিশেষ করে টিনেজরা আমাদের ফাঁদে পড়তো। সেইসাথে বিভিন্ন ডেটিং সাইটসহ বিভিন্নভাবে ভিজিটর আকর্ষণের চেষ্টা করতাম। যেহেতু এসকল কৌশল গোপনীয়, সর্ব সম্মুখে প্রকাশ করার মতো নয়। তাই মুখবন্ধ রাখতে এখানে চাকরিরতরা অধিক বেতন পায়।
শামীমউজ্জামান নামে একজন ফ্রিল্যান্সার বলেন, এভাবে আমরা ভিজিটরদের ধোকা দিচ্ছি। সেইসাথে কিন্তু বায়ার কোম্পানিকেও ধোকা দিচ্ছি। কারণ কোম্পানি কখনওই এসকল অপ্রয়োজনীয় ভিজিটর চায় না। তারা পণ্যে আগ্রহী ভিজিটর খোঁজেন। এভাবে ভুয়া ভিজিটর অব্যাহত রাখলে বিদেশি কোম্পানিগুলো আমাদের দেশের ফ্রিল্যান্সারদের উপর থেকে বিশ্বাস হারাবে। ফলপ্রাপ্তি আস্তে আস্তে মুখ ফিরিয়ে নিবে।
ফ্রিল্যান্সারদের সংগঠন বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সার ডেভলপমেন্ট সোসাইটি (বিএফডিএস) এর ঠাকুরগাঁও জেলা কমিটির সভাপতি শাহিন সালেহিন বলেন, হাজিপাড়ায় ঘটে যাওয়া বিষয়টি জেনেছি। বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। তারা অবৈধ পন্থা অবলম্বন করেছিলো। সোহাগ নামক সেই ফ্রিল্যান্সারকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। তিনি আমাদের সংগঠনের সদস্য না। তবে গোপনে আমাদের সংগঠনের বেশকিছু সদস্য সেই অফিসের সাথে জড়িয়েছিলো। সেখানে জড়িতরা আমাদের সংগঠন থেকে অবশ্যই বহিষ্কার হবে। কারণ, কোনো বেআইনি কাজকে আমরা প্রশ্রয় দিতে চাইনা।
এ বিষয়ে বিএফডিএসের চেয়ারম্যান ড. তানজীবা রহমান বলেন, দেশে এখন সাত থেকে আট লাখ ফ্রিল্যান্সার রয়েছে। সব বয়সী মানুষ এখন যুক্ত হচ্ছেন ফ্রিল্যান্সিং কাজের সাথে। গ্রাফিক্স ডিজাইন, থ্রি-ডি, টুডি মডেলিংসহ বিভিন্ন ধরনের শতাধিক কাজের মধ্যে থেকে বেছে নিচ্ছেন পছন্দ ও দক্ষতা অনুযায়ী অনলাইন টাস্ক। ফ্রিল্যান্সারদের জন্যে কাজের অনেক সুযোগ রয়েছে। সেক্ষেত্রে আমরা যেনো কেউ ভুল পথে পা না বাড়াই সেদিকে আমদের সজাগ থাকতে হবে। যারাই এসকল কাজের সাথে জড়াচ্ছে তাদের আইনের আওতায় আনতে আমরা সরকারের সাথে একযোগে কাজ করছি। আশা করি, দ্রুতই চিহ্নিত করে এদের নির্মূল করা সম্ভব হবে।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ঠাকুরগাঁও সদর থানার উপপরিদর্শক এসআই জবেদ জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে মহিলাকলেজ সংলগ্ন বাসাটিতে পুলিশ অভিযান চালানো হয়। সেখানে থাকা ২৯টি ল্যাপটপ যাচাই করে পর্নগ্রাফিতে ব্যবহার হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। পরে আটককৃত ৪ জনও নিজেদের দোষ স্বীকার করেছে। পর্নগ্রাফি আইনে নাম ঠিকানাসহ ২৫ জন ও কিছু অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে আমরা মামলা করেছি। এর সাথে যুক্ত থাকা সকল পলাতক আসামিদের আইনের আওতায় আনতে পুলিশ কাজ করছে।