বখাটে উৎপাতে স্কুলে যাওয়া বন্ধ, বাড়িতেও আতঙ্কে

আবু নাঈম: পঞ্চগড়ে বখাটের উৎপাতে দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক ছাত্রীর স্কুলে যাতায়াত বন্ধ হয়ে গেছে। তার এক প্রকার ঘরেই কাটছে সময়। রাতে ভয়ে এক ঘরে ঘুমাতে বাধ্য হচ্ছেন পরিবারের ৫ সদস্য।

স্কুলছাত্রীর পরিবারের অভিযোগ, বখাটেদের ক্রমাগত হুমকি আর পথঘাটে উত্যক্ত করায় ওই স্কুলছাত্রীর লেখাপড়া বন্ধের উপক্রম হয়েছে। প্রতিদিন চরম হয়রানির শিকার হচ্ছে দরিদ্র পরিবারটি।

স্কুলছাত্রীর পরিবার সূত্রে জানা যায়, পঞ্চগড় সদর উপজেলার ধাক্কামারা ইউনিয়নের টেংগনমারী এলাকায় বাড়ি ওই স্কুলছাত্রীর। বাবা দরিদ্র জেলে। মানুষের জায়গায় ভাঙাচোরা একখানি ঘর তুলে থাকেন তারা। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া অবস্থাতেই স্কুল যাতায়াতের পথে প্রেম নিবেদনসহ উত্যক্ত করতে থাকে প্রতিবেশি যুবক হৃদয় হোসেন (২২)। তার সহযোগী হিসেবে কাজ করতো আরও তিন জন যুবক। তারা হলেন- ওই এলাকার এলাকার সুজন (২২), হৃদয়ের ছোট ভাই রিপন (১৭) ও সাইফুল্লাহ (১৬)। দিন যতই এগুতো থাকে ততই বাড়ে উত্যক্তের মাত্রা।

পরিবারটি জানায়, গত ৬ মাস আগে একদিন বাবা-মা কাজে গেলে এই সুযোগে বাড়িতে ঢুকে স্কুলছাত্রীর শ্লীলতাহানীর চেষ্টা করে হৃদয়। পরে সে চিৎকার করলে পালিয়ে যায় হৃদয়। এ ঘটনায় পঞ্চগড় সদর থানায় অভিযোগ দেওয়া হয়। অভিযোগ অনুযায়ী দুই পক্ষকে নিয়ে থানায় বসে শালিস করে সমঝোতা করে দেওয়া হয়। সেই সাথে ওই যুবককে ধাক্কামারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের জিম্মায় দেওয়া হয়। বলা হয়, এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলে সাথে সাথেই তাকে পুলিশের হাতে তুলে দিতে হবে। এরপর কিছুদিন থেমে ছিলো তাদের উৎপাত। তবে তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। গত ২৪ মে হৃদয়ের ছোট ভাই রিপন, সাইফুল্লাহ ও সুজন ওই স্কুলছাত্রীর ৪ বছরের ছোট বোন ও তার চাচার ৬ বছরের ছেলেকে একটি নির্মাণাধীন ঘরে নিয়ে গিয়ে তাদের বিবস্ত্র করে যৌন মিলনে বাধ্য করে। আর তারা মোবাইলে ভিডিও ধারণ করে। এক পর্যায়ে শিশুরা কান্নাকাটি শুরু করলে তাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে পালিয়ে যায় তিন যুবক। পরে বিষয়টি জানাজানি হলে ১ জুন পঞ্চগড় সদর থানায় মামলা করে ওই স্কুলছাত্রীর বাবা। মামলার পর হুমকি ধামকি আরও বেড়ে যায়। ওই স্কুলছাত্রী স্কুলে যাওয়ার পথে উত্যক্ত ও তাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দেওয়া হয়।

বর্তমানে ওই স্কুলছাত্রীর স্কুল যাতায়াত এক প্রকার বন্ধ হয়ে গেছে। বাড়িতেই দিন কাটছে তার। লেখাপড়া অনিশ্চিত হয়ে পড়ায় মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে সে।

গত ৬ জুন পঞ্চগড় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষাবৃত্তি প্রদান অনুষ্ঠানে ওই স্কুলছাত্রী ও তার বাবা বিষয়টি তুলে ধরে সহযোগিতা কামনা করেন।

স্কুলছাত্রীটি বলেন- হৃদয়, সুজন, রিপন ও সাইফুল্লাহ আমাকে দীর্ঘদিন ধরে উত্যক্ত করে আসছে। তাদের অত্যাচারে আমি স্কুলে যেতে পারছি না। তারা আমাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দিয়েছে। আমার পরিবারকে প্রতিদিন হুমকি ধামকি দিচ্ছে। আমার ছোট বোনকে বিবস্ত্র করে অশ্লিল ভিডিও তৈরি করেছে। এরা সবাই এলাকায় বখাটে হিসেবে পরিচিত। মদ গাঁজা খায়। এরা স্কুলছাত্রীদের উত্যক্ত তো করেই স্কুলের ম্যাডামদের সাথেও বাজে আচরণ করে।

স্কুলছাত্রীর বাবা বলেন, আমি মামলা করার পরও তাদের অত্যাচার থেকে মুক্তি পাচ্ছি না। রাত বিরাতে তারা আমার বাড়ির চারপাশে দলবল নিয়ে ঘোরাঘুরি করে। ভয়ে আমি কাজে যেতে পারছি না। আমার মেয়েটার পরীক্ষা যে কয়দিন ছিলো আমি নিয়ে গেছি, নিয়ে আসছি। আমি দিন আনি দিন খাই। প্রতিদিন মেয়ের পিছনে সময় দিলে বাড়িতে চুলা জ্বলবে না। তাই এখন তার স্কুল যাওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু পরীক্ষার দিনগুলোতে আমি নিয়ে যাই নিয়ে আসি। আসামিরা সবাই বাড়িতেই থাকে কিন্তু পুলিশ তাদের ধরছে না।

ওই স্কুলছাত্রীর মা বলেন, আমরা গরিব মানুষ বলে দিনের পর দিন আমাদের এমনটা করা হচ্ছে। ওই ছেলেরা সবাই বখাটে। এলাকার সবাই তাদের বিষয়ে জানে। মেয়ের নিরাপত্তার চিন্তার রাতে সবাই এক ঘরে ঘুমাই।

লাঙ্গলগাঁও বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সিদ্দিক হোসেন বলেন, ওই স্কুলছাত্রী এমন সমস্যায় পড়েছে আমরা জানতাম না। আগে জানলে আমরা সব ধরনের সাপোর্ট দিতাম। সে নিয়মিত স্কুলে না আসায় আমরা বার বার খোঁজ নিয়েছি। আমরা তার বাড়িতে গিয়ে খোঁজ খবর নিয়েছি। এখন সে পরীক্ষাগুলো দিচ্ছে। বিষয়টি উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে অবহিত করা হয়েছে।

পঞ্চগড় সদর থানার উপ-পরিদর্শক ভবেশ চন্দ্র পাল বলেন, এর আগে ওই স্কুলছাত্রীকে উত্যক্ত করার ঘটনায় থানায় বসে উভয়পক্ষ সমঝোতা করে। সম্প্রতি তার ছোট বোনকে বিবস্ত্র করে অশ্লীল ভিডিও তৈরির একটি মামলা করেছে ভুক্তভোগী পরিবার। ওই মামলায় আসামিদের গ্রেপ্তারের জন্য আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। আর স্কুলছাত্রীকে উত্যক্ত করার বিষয়ে নতুন করে তারা অভিযোগ দিলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

পঞ্চগড় সদর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম প্রামানিক বলেন, বখাটের উৎপাতে স্কুল যাতায়াতে সমস্যার বিষয়টি আমরা জানার পর সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে ওই স্কুলছাত্রীর বাড়িতে পাঠানো হয়। তিনি তার সমস্যার কথা শুনেছেন। পরে আমরা এ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে অবহিত করেছি।

এ বিষয়ে অভিযুক্ত হৃদয় হোসেন বলেন, আমি গাড়ি চালাই বাড়িতেই থাকি না। তারা যে অভিযোগ করেছে সব মিথ্যে। আমি মেয়েদের উত্যক্ত করি কি না এলাকায় মানুষকে জিজ্ঞাসা করলেই জানতে পারবেন।

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts