মায়ের আহ্বানে জঙ্গিবাদ ছেড়ে স্কুলপড়ুয়া আবু বক্করের আত্মসমর্পণ

শিক্ষকের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ হয়ে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া আবু বক্কর রিয়াসাদ রাইয়ান। সন্তানের শিক্ষকের মাধ্যমে এ পথে পা বাড়ান মা সাবেক কেবিন ক্রু আম্বিয়া সুলতানা এমিলিও।

কিছুদিন পর নিজের ভুল বুঝতে পেরে র‌্যাবের মাধ্যমে জঙ্গিবাদ থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরেন মা আম্বিয়া। এ সময় ছেলেকেও ভুল পথ থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার আকুতি জানান তিনি।

গত নভেম্বরে সন্তানকে জঙ্গিবাদ থেকে ফিরে আসতে উচ্চ শিক্ষিত মায়ের এমন আহ্বান নজর কাড়ে সবার। দীর্ঘদিন পরে হলেও এবার মায়ের আহ্বানে সাড়া দিয়ে জঙ্গিবাদ থেকে ফিরে এসেছে আবু বক্কর।

মঙ্গলবার (৮ আগস্ট) নারায়নগঞ্জে র‌্যাব-১১ ব্যাটালিয়ন কার্যালয়ে এসে তিন সঙ্গীসহ হাজির হয়ে আত্মসমর্পনের ইচ্ছা প্রকাশ করে নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার আহ্বানে ঘর ছাড়া আবু বক্কর।

তার সঙ্গে র‌্যাবের কাছে আত্মসমর্পণ করা বাকি তিনজন হলেন নতুন জঙ্গি সংগঠনের সদস্য মো. হাসান সাইদ, শেখ আহমেদ মামুন ও মোহাম্মদ ইয়াসিন।

বুধবার (৯ আগস্ট) রাজধানীর কারওয়ানবাজার র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে তাদের আত্মসমর্পনের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে জানাবে র‌্যাব।

গত বছর ৫ নভেম্বর মা আম্বিয়া সুলতানা ওরফে এমিলিকে উদ্ধার করে র‌্যাব। পরে চার দিন পরিবারের সান্নিধ্যে রেখে ডি-রেডিক্যালাইজেশনের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু করে বাহিনীটি।

পরে ৯ নভেম্বর রাজধানীর কারওয়ান বাজার র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন আম্বিয়া।

এ সময় হিজরতে থাকা সন্তান আবু বক্করকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, আব্বু… যদি তুমি আমার ম্যাসেজ পেয়ে থাকো, বলতে চাই, তুমি চরম একটা ভুল পথে আছো। তুমি তোমার এই মাকে বিশ্বাস করতে পারো। তোমার কাছে আমার অনুরোধ, তুমি যদি কখনো তোমার এই মাকে ভালোবেসে থাকো, তাহলে তুমি দেশের জন্য কোনো ধরনের হুমকির কাজ করবে না। কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা, নৃশংসতা, অন্যায় কাজে শামিল হবে না। আমি অনুরোধ করছি, তুমি আত্মসমর্পণ করো, প্রশাসন সদয় হবেন।

স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে মায়ের এমন আহ্বানে সাড়া দিয়েছে ছেলে আবু বক্কর। দীর্ঘদিন পরে হলেও অবশেষে  তিন সঙ্গীসহ আত্মসমর্পণ করেছে সে।

র‌্যাব জানায়, আবু বক্করের বয়স ১৬ বছর। সে নারায়ণগঞ্জের একটি স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়াশোনা করত। গৃহশিক্ষক আল-আমিনের মাধ্যমে আবু বক্কর ও তার মা আম্বিয়া জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েন।

আত্মসমর্পণ করা বাকি তিন জঙ্গির মধ্যে একজন হাসান সাইদ। তিনি একটি মাদরাসায় দাওরা হাদিস শেষ করেছেন। শেখ আহমেদ মামুন বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছিলেন। সাইদ তাকে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করেন। আর ইয়ামিন একটি ঘড়ির দোকানে মেকানিক হিসেবে কাজ করতেন। সশস্ত্র প্রশিক্ষণে অংশ নিতে গিয়ে ভুল বুঝতে পারেন তিনি।

এ বিষয়ে র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হওয়ার পর ছেলে আবু বক্করকে একই পথে ঠেলে দেন মা আম্বিয়া সুলতানা এমিলি। তিনি আটমাস পর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার পর ছেলেকে ফিরে পাওয়ার আকুতি জানান। মঙ্গলবার (৮ আগস্ট) আবু বক্কর তিন সঙ্গীসহ র‌্যাব-১১ ব্যাটালিয়নে হাজির হয়। আমরা তাকে সব ধরনের আইনি সহায়তা দেবো।

র‌্যাবের এই মুখপাত্র বলেন, গত বছরের অক্টোবরে নতুন জঙ্গি সংগঠনের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া অভিযানে এখন পর্যন্ত ৭৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যাদের মধ্যে সংগঠনের আমির আনিসুর রহমান মাহমুদ, সামরিক শাখার প্রধান রনবীর ও উপ প্রধান মানিক, অর্থ ও গণমাধ্যমে শাখার প্রধান রাকিব রয়েছেন।

এছাড়া পাহাড়ি বিচ্ছিন্নবাদী সংগঠন কেএনএফের ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। জঙ্গি সংগঠনটির সদস্যদের অর্থের বিনিময়ে পাহাড়ে সামরিক প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল কেএনএফ।

র‌্যাব জানায়, নতুন জঙ্গি সংগঠনের ডাকে সাড়া দিয়ে ঘরছাড়া তরুণদের বিষয়ে র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখা নজরদারি করতে গিয়ে তথ্য পায়, নারায়ণগঞ্জ থেকে আবু বক্কর রিয়াসাদ রাইয়ান নামের এক তরুণ গত বছরের মার্চ মাসে নিরুদ্দেশ হয়। তার পরিবার সংশ্লিষ্ট থানায় একটি জিডিও করে। র‌্যাবের প্রকাশিত নিরুদ্দেশ হওয়া ৫৫ জনের তালিকায় আবু বক্করের নাম ছিল।

গত ৩ নভেম্বর অভিযানে র‌্যাব সংগঠনের নারী শাখার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পায়। সে সময় জানা যায়, একজন মা উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন এবং তার সন্তানকে প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে তথাকথিত হিজরতের নামে প্রেরণ করেছেন।

র‌্যাব এসব তথ্য বিশ্লেষণ ও নজরদারির মাধ্যমে নিজ সন্তানকে প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে তথাকথিত হিজরতের নামে পাঠানো আম্বিয়া সুলতানা ওরফে এমিলিকে গত ৫ নভেম্বর উদ্ধার করে। পরে ডি-রেডিক্যালাইজেশনের মাধ্যমে তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু করে।

যেভাবে মা-ছেলে জঙ্গিবাদে :

ছেলের শিক্ষক আল-আমিনের মাধ্যমে আম্বিয়া ও তার ছেলে আবু বক্কর ২০২১ সালের প্রথম দিকে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে সংগঠনে যোগদান করেন। পরবর্তীতে আবু বক্কর ২০২২ সালের মার্চ মাসে আল আমিনের নির্দেশনায় প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে তথাকথিত হিজরতের নামে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। তারপর সে আর ফিরে আসেনি।

সর্বশেষ জানা যায়, নানা প্রক্রিয়া শেষে গত সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে আল-আমিনের নির্দেশনায় পাহাড়ে প্রশিক্ষণের জন্য আবু বক্করকে বান্দরবানে দিয়ে আসেন গ্রেপ্তার রনি।

র‌্যাবের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার প্রক্রিয়া শুরুর পর গত নভেম্বরে আম্বিয়া জানান, তিনি মাস্টার্স সম্পন্ন করে ২০০৯ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত ইউনাইটেড এয়ারওয়েজে কেবিন ক্রু হিসেবে চাকরি করেন। ভুল একটা পথকে সঠিক মনে করে তিনি সন্তানকে এ পথে দেন। শিক্ষিত মেয়ে হয়েও তিনি বুঝতে পারেননি। কারণ কোরআন-হাদিসের দক্ষতা তার কম ছিল। সঠিক ব্যাখ্যা বুঝতে পেরে অবশেষে নিজের ভুল বুঝতে পারেন তিনি।

তিনি জানিয়েছেন, জঙ্গিদের গ্রুপ, সংগঠনের নাম, তাদের কর্মকাণ্ড সব কিছু তার কাছে গোপন করা হয়েছিল। একটা ভুল বিষয়কে তার সামনে এনে কোরআন হাদিসের রেফারেন্স দিয়ে বোঝানো হয়েছে। আবু বক্কর তার একমাত্র আদরের সন্তান।

আবু বক্কর মেধাবী ছাত্র ও বিনয়ী ছিল। বিপথে নেওয়ার জন্য তার সন্তানের মতো ছেলেদের টার্গেট করা হচ্ছে, তিনি যার শিকার হয়েছেন বলেও উল্লেখ করেন।

তিনি বলেন, আমার সন্তান গতবছরের ১৫ মার্চ ঘর থেকে বেরিয়েছে। এর আগে ২০২১ সালে তার শিক্ষক আল আমিন দেশের বাইরে ছিলেন। তিনি দেশে ফিরে যোগাযোগ করেন। আল আমিন আমাদের খুবই বিশ্বস্ত ছিলেন। ভদ্র বিনয়ী আল-আমিন খুব ভালো পড়াতেন বলে আমরা তাকে খুবই পছন্দ করতাম। তিনিই আমাদেরকে ডিমোটিভেট করেছেন। আল-আমিন বলেছিলেন যে, প্রস্তুতি নিতে হবে, গাজওয়াতুল হিন্দ সম্পর্কে তৈরি হয়ে থাকতে হবে। আমি প্রথমে সন্তানকে বলতাম তোমার এসব শুনতে হবে না, তুমি পড়াশুনা করো। মেধাবী আবু বক্কর ছোট বেলাতেই বৃত্তি পায়। শিশু একাডেমি থেকে পুরস্কারও পায় আবু বক্কর।

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts