হাসপাতালে বাগ্বিতণ্ডা, থানায় ধরে নিয়ে ছাত্রলীগ নেতাদের নির্যাতন- এরপর জল গড়িয়েছে বহুদূর। এসব ঘটনায় জল গড়িয়েছে বহুদূর। সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন মূল অভিযুক্ত অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) হারুন-অর-রশিদ। ঘটনার তদন্ত করছে পুলিশ।
তবে ঘটনার সূত্রপাত যাকে ঘিরে সেই এডিসি সানজিদা এসব বিষয় নিয়ে এতদিন কোনো কথাই বলেননি। মঙ্গলবার (১২ সেপ্টেম্বর) বেসরকারি সম্প্রচারমাধ্যম চ্যানেল আইয়ের মুখোমুখি হন তিনি।
সানজিদা বলেন, “বেশ কিছুদিন ধরে আমার কার্ডিয়াক সমস্যা হচ্ছিল। গত পাঁচ মাস ধরে এই সমস্যাটা বেড়ে যায়। তিন সপ্তাহ ধরে বুকের সমস্যাটা বেড়ে যায়। তাই শনিবার ইব্রাহিম কার্ডিয়াকের একজন ডাক্তারকে দেখাতে চাচ্ছিলাম। আমি ল্যাব এইডের যে ডাক্তারকে দেখাই উনি দেশের বাইরে আছেন। তাই আমি ইব্রাহিম কার্ডিয়াকের একজন ডাক্তারকে দেখানোর চেষ্টা করি।”
তিনি আরও বলেন, “যেহেতু আমার ইমার্জেন্সি ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট দরকার ছিল। সেজন্য আমি ইব্রাহিম কার্ডিয়াক যে স্যারের জোনে আছে, স্যার পরিচিত। সেজন্য আমি স্যারকে একটু, যে স্যারকে (এডিসি হারুন) নিয়ে কথা হচ্ছে এডিসি স্যারকে বলি যে স্যার আমরা একটা সিরিয়াল ম্যানেজ করে দেওয়া সম্ভব কি-না। তখন স্যার ওসির মাধ্যমে একটা সিরিয়াল ম্যানেজ করে দেন। সন্ধ্যা ৬টার পর সিরিয়াল ছিল। সেই হিসেবে সন্ধ্যা ৬টার পর আমি যাই সেখানে। কিন্তু ওখানে যাওয়ার পর জানতে পারি যে, কোনো একটা কনফারেন্সে আছেন।”
“যেহেতু আমার ইমার্জেন্সি দরকার ছিল, তাই আমি সেটা স্যারকে জানাই যে, স্যার ডাক্তার তো এখন একটা কনফারেন্সে আছেন, উনি আজ দেখবেন না। যেহেতু আমার আর্জেন্ট দরকার তাই অন্য কোনো ডাক্তার ম্যানেজ করে দেওয়া যায় কি-না। স্যার খুব সম্ভবত আশপাশেই ছিলেন। তাই স্যার তখন বলেন যে, আপনি ওখানেই থাকেন আমি এসে দেখতেসি অন্য কোনো ডাক্তার ম্যানেজ করা যায় কি-না।”
“বেশ কিছুক্ষণ পর স্যার আসেন। এসে স্যার উনাদের সঙ্গে কথা বলেন এবং একজন ডাক্তার ম্যানেজ করে দেন। এরপর আমি ডাক্তারকে দেখাই এবং উনি আমাকে বেশকিছু টেস্ট করতে বলেন। ব্লাড টেস্ট, ইকো, ইসিজি করানো হয়েছিল। যে সময়টায় ঘটনাটা ঘটে তখন আমি ইটিটি করাচ্ছিলাম। ইটিটি রুমেই ছিলাম। সেখানে বেশ কিছুটা সময় লেগে যায় ২০-২৫ মিনিটের মতো।”
বাগ্বিতণ্ডার বিষয়ে পুলিশ কর্মকর্তা সানজিদা বলেন, “ইটিটি যখন শেষ পর্যায়ে তখন আমি রুমের বাইরে একটা সাউন্ড শুনতে পাই। হট্টগোল হচ্ছে এবং খুব চিৎকার চেঁচামেচি হচ্ছে। প্রথম যে সাউন্ডটা আসে সেটা হচ্ছে স্যারের। স্যার বলছিলেন, ভাই আপনি আমার গায়ে হাত তুলবেন কেন। আপনি তো আমার গায়ে হাত তুলতে পারেন না।”
“প্রথমে আমি ধারণা করেছিলাম হয় অন্য কারও সঙ্গে হয়ত কোনো একটা ঝামেলা হয়েছে। কিন্তু এর কিছু পরেই আমি সেখানে দেখতে পাই যে আমার স্বামী। উনি এখানে কী কারণে আসছেন বা কী করছেন সেটা আসলে আমি জানি না। উনাকে টোটালি আউট অব মাইন্ড লাগছিল। উনি খুবই উত্তেজিত অবস্থায় আছেন। তখন উনার সঙ্গে আরও বেশ কয়েকজন ছেলেও ছিল। আমি তাদেরকে চিনি না। স্যারকে কাইন্ড অব মারতে মারতেই রুমটার মধ্যে নিয়ে আসেন।”
এডিসি হারুনের ভূমিকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “স্যার তাদের হাত থেকে বাচার জন্য তখন ওই ইটিটি রুমটার এক কোনায় গিয়ে দাঁড়ালেন। ওই সময় আনফরচুনেটলি ভেরি আনফরচুনেটলি আমার স্বামী ওই ছেলেগুলোকে বলেন যে, তোরা এই দুইজনের ভিডিও কর। আমি তখন ইটিটির পোশাকে ছিলাম। আপনি জানেন যে পোশাকটা কী রকম থাকে। স্বাভাবিকভাবেই পোশাকটা খুব শালীন অবস্থায় ছিল না। তখন আমি হাজব্যান্ডের সঙ্গে শাউট করছিলাম যে, রুমের মধ্যে তো কোনো ছেলে ঢোকার কথা না। আপনি ঢুকেছেন কেন এবং এতোগুলো ছেলে নিয়ে কেন ঢুকেছেন। আবার আপনি বলছেন যে ভিডিও করার জন্য।”
ওই সময় স্বামীর আচরণের কথা স্মরণ করে সানজিদা বলেন, “আমি যখন চিৎকার করছিলাম তখন উনি আমাকেও ২-৩টা চড় মারেন। তখন আমার ড্রাইভারও ছুটে আসে। তখন ড্রাইভারের ওপর দিয়ে আমার গায়ে হাত তোলা হয়। একটা পর্যায়ে উনারা যারা ভিডিও করছিল, একটা ছেলে আমার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। তখন তার সঙ্গেও আমার হাতাহাতি বা ওই রকম একটা অবস্থা তৈরি হয়ে যায়। আমি কোনোভাবেই চাচ্ছিলাম না যে আমি ওই পোশাকে আসি। আমি একজন নারী, তারা আমাকে এই অবস্থায় ভিডিও করুক।”
“তাদের ইনটেনশন দেখেই মনে হচ্ছিল যে, স্যার আর আমাকে পাশাপাশি রেখে ভিডিও করা। যেটা পরবর্তীতে তারা হয়তো ইউজ করবে। অবশ্যই কোনো একটা অসৎ উদ্দেশ্য ছিল। দুই তিন জনের হাতে ক্যামেরা ছিল এবং তারা ভিডিও করছিল। আমি ওদের হাত থেকে ক্যামেরাটা নিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। যে ছেলেটাকে আহত অবস্থায় দেখা যাচ্ছে আমি তার হাত থেকেও কয়েকবার ক্যামেরা নিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করি। তখন স্বভাবিকভাবে আমার গায়েও বেশ কয়েকবার টাচ লেগেছে। আমি যখন ক্যামেরা নেওয়ার চেষ্টা করি আমার গায়েও বেশ কয়েকবার লেগেছে। স্বভাবিকভাবে আমি আমার স্বামীর সঙ্গে চিৎকার করছিলাম।”
এডিসি সানজিদার কথায়, ওরা স্যারকে রুম থেকে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করছিল। তখন স্যার বলছিলেন, ‘আপনারা আমাকে বাইরে নিয়ে গেলে তো মেরে ফেলবেন। আমি আমার থানার ফোর্সকে জানিয়েছি। তারা এলে আমি বের হব’। এর মধ্যে হাসপাতালের সিকিউরিটিতে যারা ছিল তারাও এসেছেন। ১৫ মিনিট পর থানা থেকে ফোর্স আসে। এরপর তারা নিচে যায়। এর মধ্যে আমার বডিগার্ডও ব্যথা পেয়েছিল। ছেলেগুলো বডিগার্ডের গায়েও হাত তুলেছিল। আমার গায়েও হাত তোলে।”
গত শনিবার রাতে ছাত্রলীগের দুই কেন্দ্রীয় নেতাকে শাহবাগ থানায় নিয়ে নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে ডিএমপির রমনা জোনের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (এডিসি) হারুনের বিরুদ্ধে।
আহতরা হলেন, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের বিজ্ঞানবিষয়ক সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শহীদুল্লাহ হলের সাধারণ সম্পাদক শরীফ আহমেদ মুনিম এবং সাংগঠনিক সম্পাদক ও ফজলুল হক হলের সভাপতি আনোয়ার হোসেন নাঈম।
আহতদের সহপাঠী ও ছাত্রলীগ সূত্রে জানা গেছে, এডিসি হারুন শনিবার রাতে আরেক নারী পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে বারডেম হাসপাতালে আড্ডা দিচ্ছিলেন। ওই সময় নারী কর্মকর্তার স্বামী বিসিএস কর্মকর্তা আজিজুল হক মামুন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের দুই নেতাকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে যান। আজিজুল হক মামুন বর্তমানে রাষ্ট্রপতির এপিএস হিসেবে নিযুক্ত। এ সময় তার সঙ্গে এডিসি হারুনের বাগ্বিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে সেটি হাতাহাতিতে রূপ নেয়। এরই জেরে সঙ্গে থাকা ওই দুই ছাত্রলীগ নেতাকে থানায় নিয়ে বেদম মারপিট করা হয়।
এরপর রবিবার প্রথমে এডিসি হারুনতে ডিএমপির রমনা বিভাগ থেকে প্রত্যাহার করে পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্টে সংযুক্ত করা হয়। এর কয়েক ঘণ্টা পর তাকে কক্সবাজারের আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নে (এপিবিএন) বদলি করা হয়।এরপর সোমবার তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
এডিসি হারুনকে সাময়িক বরখাস্তের আগে সোমবার দুপুরে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ডিএমপি কমিশনারের সঙ্গে দেখা করেন।
রাষ্ট্রপতির আদেশে সোমবার বিকেলে এডিসি হারুনকে সাময়িক বরখাস্তের প্রজ্ঞাপনে সই করেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. মোস্তাফিজুর রহমান।