খালার ভালোবাসায় মায়ের অভাব ভুলেছে মাহিন আর তুবা

বাবা থেকেও না থাকার মতো। খালার কাছে বড় হচ্ছে মাহিন আর তুবা। মা মারা যাওয়ার সময় তুবা ছিলো ছোট। সেই ছোট্ট তুবা এখন আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে। আগে কেউ মায়ের কথা জিজ্ঞাসা করলে বলতো, মা তো আকাশের চাঁদ হয়ে গেছে। এখন সে খালার কাছে বড় হচ্ছে। খালাকেই মা বলে ডাকছে। খালাও এখন তুবাকে ছাড়া কিছু বোঝেন না। সব ধ্যান-ধারণা তাকে ঘিরে। খালার ভালোবাসায় মায়ের অভাব ভুলেছে তুবা। এখন আর সে বলে না ‘মা আকাশের চাঁদ হয়ে গেছে।’

২০১৯ সালের ২০ জুলাই রাজধানীর বাড্ডায় সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করার খোঁজখবর নিতে গিয়ে ছেলেধরা গুজবে গণপিটুনির শিকার হয়ে নিহত হন তাসলিমা বেগম রেনু নামে মধ্যবয়সী এক নারী। এ ঘটনায় অজ্ঞাত ৫০০ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন রেনুর ভাগ্নে সৈয়দ নাসির উদ্দিন টিটু।

২০২০ সালের ১০ সেপ্টেম্বর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের ইন্সপেক্টর আব্দুল হক ১৩ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক দুই জনের বিরুদ্ধে দোষীপত্র দাখিল করেন।

ঢাকার ষষ্ঠ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মোহাম্মদ মোরশেদ আলমের আদালতে হত্যা মামলাটি বিচারাধীন। মামলাটি বিচারিক কার্যক্রম শেষের পর্যায়ে চলে এসেছে। রায়ের জন্য দিন ধার্য রয়েছে। আগামি ৩০ সেপ্টেম্বর আদালত আলোচিত এ হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করবেন। রায়ে আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক সাজার প্রত্যাশা করছে রেনুর পরিবার।

এদিকে রেনুকে ছাড়া আদর-যত্নেই বেড়ে উঠছে তার তুই সন্তান মাহিন আর তুবা। মাহির এখন উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুলে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। আর তুবা ঢাকা শাহিন স্কুল অ্যান্ড কলেজে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ছে। সে বড় হচ্ছে খালা নাজমুন নাহার নাজমার কাছে।

জানতে চাইলে নাজমুন নাহার নাজমা বলেন, মাহিন তো ৯ম শ্রেণিতে পড়ছে। ও জানে ওর মায়ের সাথে কি অঘটন ঘটেছে। বোঝেও। তুবা তো ছোট। ও ওর মাকে ভুলে গেছে। আমাকেই মা হিসেবে মেনে নিয়েছে। আগের মত এখন আর বলে না, মা আকাশের চাঁদ হয়ে গেছে।

তিনি বলেন, পাঁচ বছরের অধিক সময় হয়ে গেছে। মামলার বিচার এখনো শেষ হয়নি। রায়ের পর্যায়ে এসেছে। আমার বোনটাকে কি নির্মমভাবে মেরেছে দেশবাসীসহ বিশ্ববাসী দেখেছে। যে কেউ বাচ্চা ভর্তি করতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেতে পারে। তাই বলে কি এমনটা করবে? এটার বিচার দেশবাসী চায়, পরিবার হিসেবে তো আমরা চাচ্ছি। দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা হোক। সমাজে একটা উদাহরণ হয়ে থাকে যেন। আমার মায়ের ইচ্ছা ছিলো হত্যার বিচার দেখে যাওয়ার কিন্তু পারলেন না। রেনুর শোকে মাও মারা গেলেন। আমরা বোন হয়েই বিষয়টা সহ্য করতে পারছি না। আর মা তো মা-ই।

নাজমা বলেন, আমার আগে ছিলো দুইটা সন্তান। এখনো হয়েছে চারটা। তবে সবাই তুবাকে নিয়ে ব্যস্ত। সবকিছু ওকে ঘিরে। আমরা ওর জন্য সর্বোচ্চটা চেষ্টা করি। বিষয়টা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, আমার দুই সন্তানের চেয়ে তুবার আবদারটা বেশি। আমিই ওর মা। কাউকে সে ভাগ দিবে না। আমরাও ওকে ছাড়া থাকতে পারি না। ও আছে বলেই এখনো আছি। তুবা না থাকলে অস্থির লাগে। ওকে আদর, ভালোবাসার কোনো ত্রুটি নেই।

তবে একটা শঙ্কা কাজ করছে নাজমার মধ্যে। বড় হয়ে তুবা যখন বিষয়টা জানতে পারবে, তখন ওকে কি দিয়ে শান্তনা দিবেন- এ চিন্তাটা রয়ে গেছে। যাই হোক বোন হত্যার বিচার হোক।

মামলার বাদী নাসির উদ্দিন টিটু বলেন, পাঁচ বছর পার হয়ে গেছে। অবশেষে মামলাটা রায়ের পর্যায়ে এসেছে। আমাদের আশা, এমন একটা রায় হবে যেখানে একটা বার্তা বা ম্যাসেজ থাকে। আর যেন কারো সাথে এমন দুর্ঘটনা না ঘটে। আমরা এখনো ট্রমার মধ্যে আছি। রায়টা রায়ের মত হলে ট্রমাটা কেটে যাবে। আমরা দোষীদের ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট চাই। এর মাধ্যমে একটা বার্তা বাংলাদেশে পৌঁছে যাবে।

উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ২০ জুলাই রাজধানীর বাড্ডার একটি স্কুলে সন্তানদের ভর্তির বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে নিহত হন তাসলিমা বেগম রেনু। এ ঘটনায় অজ্ঞাত ৫০০ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন রেনুর ভাগ্নে সৈয়দ নাসির উদ্দিন টিটু।

২০২০ সালের ১০ সেপ্টেম্বর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের ইন্সপেক্টর আব্দুল হক ১৩ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক দুইজনের বিরুদ্ধে দোষীপত্র দাখিল করেন। ২০২১ সালের ১ এপ্রিল ১৩ আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জগঠন করেন আদালত।

আসামিরা হলেন- ইব্রাহিম ওরফে হৃদয় মোল্লা, রিয়া বেগম ময়না, আবুল কালাম আজাদ, কামাল হোসেন, মো. শাহিন, বাচ্চু মিয়া, মো. বাপ্পি ওরফে শহিদুল ইসলাম, মুরাদ মিয়া, সোহেল রানা, আসাদুল ইসলাম, বেল্লাল মোল্লা, মো. রাজু ওরফে রুম্মান হোসেন ও মহিউদ্দিন।

মামলাটিতে আদালত চার্জশিটভূক্ত ২৬ জন সাক্ষীর মধ্যে ১৯ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছেন। এরপর আসামিদের আত্মপক্ষ শুনানি, মামলা যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে রায়ের তারিখ ধার্য করা হয়ছে।

আসামিপক্ষের আইনজীবীরা বলছেন, অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। কাজেই তারা খালাস পাবেন এমন আশা করছি।

এদিকে দুই শিশুর মামলাটি ঢাকার নারী ও শিশু টাইব্যুনাল-৭ এ বিচারাধীন।

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts