অলোক আচার্য : স্বাধীনতা পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের প্রথম চাওয়া। সব কিছুতেই মানুষ স্বাধীনতার স্বাদ পেতে চায়। পরাধীন নিষ্পেশিত জীবন সবচেয়ে বড় অভিশাপ। তবে স্বাধীনতার স্বাদ রাতারাতি পাওয়া যায় না। প্রতিটি পরাধীন জাতি, গোষ্ঠীকে স্বাধীনতার স্বাদ পেতে বহু মূল্যবান ত্যাগ করতে হয়েছে। প্রয়োজন হয় সর্বোচ্চ আত্নত্যাগের। এই ত্যাগ যারা করতে পারে স্বাধীনতা একসময় তাদের কাছে আসে। কোনো ভূখন্ড স্বাধীন হতে হলে প্রথমে নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে হয়। একটি যুদ্ধ, একটি স্বাধীন দেশ পাওয়ার জন্য বহু মানুষের রক্ত, সম্মান, সাহস আর শক্তির সমন্বয় প্রয়োজন হয়। তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন হয় একটি স্বপ্নের। স্বাধীনতার স্বপ্ন। যে স্বপ্ন একদিন বাঙালি দেখেছিল।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ কাল রাতে পশ্চিম পাকিস্তানের সশস্ত্র সেনাবাহিনী তাদের ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঘুমন্ত নিরীহ বাঙালির উপর আক্রমণ চালিয়েছিল অপারেশন সার্চ লাইট নাম দিয়ে যা ইতিহাসের জঘন্যতম একটি ঘটনা। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বাঙালির প্রয়োজন ছিল একটি কাঠামো যা পূরণ যুদ্ধের গতি-প্রকৃতি নির্ধারণ করবে, যুদ্ধকে সঠিক পথে পরিচালিত করবে। ১০ এপ্রিল গিয়ে সেই আশা পূরণ হয়। পূর্ণ মর্যাদায় গঠিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার। ঘটনাটি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে একদিকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধ এবং অন্যদিকে দেশকে মুক্ত করার চ্যালেঞ্জ। ১০ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠন দিবস। মার্চের ৭ তারিখেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে বাঙালি ঝাঁপিয়ে পরে যুদ্ধে। তারা বুঝে গিয়েছিল যুদ্ধ অনিবার্য। মাঝখানে শুধু সময়ক্ষেপণ মাত্র। স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে তারা শত্রুর মুখোমুখি দাড়ায়।
১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে ১০ তারিখ তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠন করা হয়। এবং ১৭ই এপ্রিল এই সরকারের আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। এই দিনটি মুজিব নগর দিবস হিসেবে পালিত হয়। মুজিবনগর স্বাধীন বাংলাদেশের অভূদ্যয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম এবং সময়।
মুজিবনগর সরকারের শপথের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম সুসংগঠিত ও প্রাতিষ্ঠানিক রুপ পায়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই দুটি ঘটনাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মুজিবনগর সরকার গঠনের পর মুক্তিযুদ্ধের গতি বৃদ্ধি পায়।
১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপ্রধান ও সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক করে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা করা হয়। এই সরকার সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপ্রধান এবং বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তাকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান ও সশস্ত্র বাহিনীর অস্থায়ী সর্বাধিনায়ক নির্বাচিত করে। তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী,ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীকে অর্থমন্ত্রী, খন্দকার মোশতাক আহমেদকে পররাষ্ট্র, আইন এবং সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী, এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে স্বরাষ্ট্র, কৃষি, ত্রাণ এবং পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়ে মন্ত্রিপরিষদ গঠন করা হয়। চার জন মন্ত্রীকে ১২টি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ভাগ করে দেয়া হয়।
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছিল বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্তের এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে বাস্তবায়নের। প্রথমে ১৯৭০ এর নির্বাচনে জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ৩ মার্চে জাতীয় পরিষদ বৈঠক অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা। ২৫ মার্চ থেকে নির্বিচারে গণহত্যা ও বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণা এবং জনপ্রতিনিধিদের গণপরিষদ গঠন এবং জনগণের সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করতে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী রূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা দৃঢ় সমর্থন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি এবং সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগ, জাতিসংঘের সনদ মেনে চলার প্রতিশ্রুতি প্রদান করা হয়েছিল।
এই ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছিল, স্বাধীনতার এই ঘোষণাপত্র ৭১ এর ২৬ মার্চ তারিখ থেকে কার্যকর হয়েছে এবং পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি ও উপ-রাষ্ট্রপতির শপথ পরিচালনার জন্য অধ্যাপক ইউসুফ আলীকে প্রতিনিধি নিয়োগ করার কথা বলা হয়।প্রথমেই এ সরকার বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণাকে সমর্থন ও অনুমোদন করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে নেতৃত্ব দিয়েছে মুজিবনগর সরকার। বলা যায় মুজিবনগর সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার কারণেই ১৬ ডিসেম্বর বিশে^র মানচিত্রে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে আর্বিভূত হয়। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পেছনে এই সরকারের ভূমিকা ছিল অনবদ্য। ফলে এই সরকারের নাম ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরেই লেখা থাকবে আজীবন। স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার মাত্র ১৫ দিনের মাথায় সরকার গঠন হবে তা অকল্পনীয় ছিল পাকিস্তানিদের কাছে। এটা ছিল পাক শাসকদের কাছে একটি বার্তা। তারা হয়তো ভেবেছিল তাদের এই হঠাৎ আক্রমণে বাঙালিরা লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যাবে বা আত্নসমর্পণ করবে। অথবা শেখ মুজিবুর রহমানকে বাঙালির চোখের আড়াল করলেই সমস্যার সমাধান হবে। কিন্তু কোনোটাই হয়নি। দোর্দণ্ড প্রতাপে ঘুরে দাঁড়ায় স্বাধীন হওয়ার স্বপ্ন দেখা বাংলাদেশ। গঠন করা হয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ অস্থায়ী সরকার বা মুজিবনগর সরকার। এই অস্থায়ী সরকার গঠনের মধ্য দিয়েই পরিকল্পিত কায়দায় মুক্তিবাহিনীকে সংগঠিত ও সমন্বয় সাধন করে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ পরিচালনা ও স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায় করেছিল মুজিব নগর সরকার।
১০ এপ্রিল সরকার গঠনের পর ১১ এপ্রিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে তাজউদ্দিন আহমদ একটি বেতার ভাষণ দেন। এ ভাষণে তিনি দেশব্যাপী পরিচালিত প্রতিরোধ যুদ্ধের বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেন। এছাড়াও ১৭ এপ্রিল মন্ত্রী সভার শপথ গ্রহণের তারিখ নির্ধারিত হয়। মেহেরপুরের সীমান্তবর্তী গ্রাম বৈদ্যনাথ তলায় শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়।
শপথ গ্রহণের পরই তাজউদ্দিন আহমদ এ স্থানের নাম দেন ‘মুজিবনগর’। পরবর্তী সময়ে প্রবাসী সরকার মুজিবনগর সরকার হিসেবেই পরিচিতি লাভ করে। এই ঐতিহাসিক জায়গাটি এদেশের স্বাধীনতার প্রথম স্বাক্ষী। বাঙালির ওপর প্রথম আঘাত আসে তার ভাষার অধিকার হরণের চেষ্টার মধ্যে দিয়ে। তাদের শোষণ করার নীতি ছিল একটি ভুল নীতি। এই ভুল নীতি অবলম্বন করে কোনো অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠী নিপীড়িতদের দমিয়ে রাখতে পারেনি। আজও যেসব শাসকগোষ্ঠী কোনো জাতিসত্তার স্বাধীনতাকে অস্ত্রের মাধ্যমে দমিয়ে রেখেছে বা রাখার চেষ্টা করছে সেটাও ভুল। অস্ত্র দিয়ে স্বাধীনতাকে বেশিদিন আটকে রাখা যায় না। মন যখন স্বাধীনতা চায় তখন অস্ত্র দিয়ে তা কিভাবে আটকানো যায়? এরপরও পশ্চিম পাকিস্থান শাসকগোষ্ঠী বারবার বাঙালিকে অস্ত্র আর ক্ষমতা দিয়ে দমিয়ে রাখতেই চেয়েছিল। বাঙালির ছয়দফা আন্দোলন,গণঅভ্যুত্থান এবং সাধারণ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা এসবই স্বাধীনতার পথে এক একটি বিজয় ছিল। তারপর মার্চের ৭ তারিখ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ বাঙালিকে স্পষ্টভাবেই স্বাধীনতার পথে পথ দেখায়। ১০ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠনের মধ্যে দিয়ে এবং ১৭ এপ্রিল শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানকে একটি যোগ্য জবাব দেওয়া এবং স্বাধীনতার গতিকে তরান্বিত করা হয়েছিল।