অলোক আচার্য
দ্বীপ বা মাটির প্রদীপ জ্বেলে অন্ধকার দূর করা জন্যই দুর্গাপূজার পরে শ্যামা পূজার এই ক্ষণকে বলে দীপাবলি। চারিদিক প্রদীপের আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে। প্রদীপ হলো মঙ্গলের বা শুভ কাজের প্রতীক। তাছাড়া মাটির এই প্রদীপ হলো আদিকালের আলোর প্রধান এবং একমাত্র উৎস। দেবী দুর্গা বাপের বাড়ি বেড়ানো শেষে ফিরে গেছেন কৈলাসে। এরপরেই অনুষ্ঠিত হয় শ্যামা পূজা। দেবী দুর্গারই অসুর বধের এক রুপ হলো দেবী কালী বা কালীকা। এই পূজা দেবী কালিকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হয়।
বাংলাদেশ এবং ভারতে ব্যাপক আয়োজনে উৎসাহ-উদ্দীপনায় কালীপূজা অনুষ্ঠিত হয়। দুর্গাপূজার পরে শ্যামাপূজাই হিন্দুদের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব। কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে শ্যামাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। এসময় এটিকে দীপাবলি কালী পূজাও বলা হয়ে থাকে। অন্ধকার থেকে আলো জ্বেলে মায়ের আগমন ঘটে। চারিদিকে আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। দেবী দুর্গার মতো দেবী কালীও অসুরের হাত থেকে মানুষ এবং দেবতাদের রক্ষার উদ্দেশ্যেই আবির্ভূত হন। পৃথিবীতে সব জীবের কল্যাণ এবং সুখ-শান্তি আনতেই দেবী কালীর আগমন ঘটে। দুষ্টের বিনাশ ও শিষ্টের লালনই তার উদ্দেশ্য।
হিন্দু পুরাণ মতে, দেবী কালী হলো দেবী দূর্গারই একটি শক্তির প্রকাশ। সংস্কৃত ভাষায় কাল থেকে কালী শব্দটির উৎপত্তি। জগতের শুভ শক্তির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাই দেবী কালীর উদ্দেশ্য। এটি শক্তিপূজা। দীপের আলোয় আলোকিত হয় জন্যই এ সময়ের পূজাকে দীপাবলি কালী পূজা বলা হয়। এই দিনে হিন্দু ধর্মের মানুষের প্রত্যেক বাড়িতেই প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করা হয়। মৃত ব্যক্তিদের উদ্দেশ্যেও এদিন প্রদীপ জ্বালানো হয়। দেবী কালীর রয়েছে অনেক রুপ। প্রতিটি রুপেই তিনি অসুর সংহার করেছেন। জগতে এনে দিয়েছেন শান্তি। শান্তির বার্তা দিতেই পৃথিবীতে তার আবির্ভাব ঘটে।
তিনি শ্যামা, আদ্য মা, মা তারা, চামুন্ডি, ভদ্রকালি, মহামায়াসহ বিভিন্ন নামে পরিচিত। দেবী কালীকে মৃত্যু, সময় ও পরিবর্তনের কর্তা মনে করা হয়। তন্ত্র অনুসারে দেবী কালী হলো দশমহাবিদ্যার প্রথম দেবী। পূরাণ অনুসারে তাঁর প্রথম আবির্ভাব হয় ভগবান শিব হতে। কালের আরেক নাম হলো ভগবান শিব। দেবী কালী তারই একটি অংশ। তিনি শক্তির চূড়ান্ত প্রকাশ এবং সকল জীবের জননী। সৃষ্টির শুরুতে ভগবান বিষ্ণুর শরীর থেকে মধু ও কৈটভ নামের দুটি ভয়ংকর দৈত্যকে বধ করার জন্য দেবী কালীকে আহ্বান করা হয়। এছাড়া চন্ড ও মুন্ডকে দেবী কালী বধ করেন। এরপর রক্তবীজের মতো ভয়ংকর অসুরের সাথে যুদ্ধে দেবী কালী রক্তবীজকে বধ করেন। হিন্দু মহাকাব্য মহাভারতের ১০.৮.৬৪ শ্লোকে কালী আবির্ভূত হয়েছে। তাকে বলা হয় কালরাত্রি (আক্ষরিক অর্থে গাঢ় নীল)। মোট কথা ভয়ংকর সব অসুরকে বধ করতেই দেবী কালী রুপের আগমন। শক্তির আরেক রূপ হলো দেবী কালী। এছাড়া মহাকালী, ভদ্রকালী রুপেও দেবীর মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে।
পৃথিবীতে সুর আর অসুরের দ্বন্দ্ব চিরকালের। অসুরের দাপটে সুর অর্থাৎ শুভ শক্তি যুগে যুগে কোণঠাসা হয়েছে। তারপর যখন পৃথিবী পাপে ভারাক্রান্ত হয়েছে তখনই কোনো শুভ শক্তি পৃথিবীতে এসেছে। দেবী কালী হলো সেই শুভ শক্তি। এখন যেমন পৃথিবীতে ক্ষমতাশালীদের উল্লাস, ধর্ষকদের কুৎসিত হাসি, অসৎ মানুষের দাপটে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস এসবই মনুষ্যত্বের বাইরে। এরাই অসুর। মনুষ্যত্ব আর পশুত্বের লড়াই চলছে। তাতে মনুষ্যত্ব আজ কোণঠাসা। বহুযুগেও এরকম হয়েছে। পৃথিবীতে ক্ষমতাশালীদের দাপট বেড়েছে। তারপর একসময় তার পতন ঘটেছে কোনো একক শক্তি বা বহুশক্তির মিলিত রুপের কাছে। অর্থাৎ পৃথিবীতে একটি ভালো শক্তি জাগ্রত হয়েছে। শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
পৃথিবীতে যখন আসুরিক শক্তি প্রবল হয়ে ওঠে তখন তা বিনাশ করার প্রয়োজন হয়। তা যেমন বহুকাল আগেও হয়েছে, আজও হচ্ছে। অত্যাচারী রাজারা প্রজাদের ওপর অত্যাচার করেছে, অন্যদেশ আক্রমণ করে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়েছে। তারপর কেউ একজন এসেছে সেই অপশক্তিকে দমন করতে। এই অসুর বধ করার জন্যই পৃথিবীতে আবিভূত হন দেবী কালী। নারী শক্তিতে যে অসুর অবহেলা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছিল। নারী শক্তিকে যখন অবমাননা করা হয় তখন দেবী কালী আবির্ভূত হন।
পূজা সনাতন ধর্মামলম্বীদের মাঝে আনন্দের বার্তা নিয়ে আসে। একটি উৎসব সবার মনেই আনন্দ বয়ে আনে। ঈদ, পূজা, বড়দিন বা বৌদ্ধ পূর্ণিমা এসব আমাদের সবাইকে একসাথে বেঁধে রেখেছে। বাঙালির প্রাণ একই সূত্রে বাঁধা। তা সে সব মানুষের। যুগ যুগ ধরেই সহাবস্থানের মাধ্যমে বাঙালির একাত্মতা চোখে পড়ে। একজন আরেকজনের পাশে থেকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। পূজা তাই একটি মেলবন্ধন। সনাতন ধর্মের আদি শক্তি দেবী দূর্গার একটি রুপ হলো দেবী কালী। তার হাতে অস্ত্র এবং অসুরের মুন্ডু। দেবী দেবী কালী সমগ্র নারী শক্তির প্রতীক। নারীদের অনুপ্রেরণা। নারীরা দুর্বল নয় বরং সব অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে সেই কথাই মনে করিয়ে দেয়।
অসুর কে বা কারা? যার মধ্যে সুর নেই অর্থাৎ নম্রতা, বিনয় ও মনুষ্যত্ব নেই সেই অসুর। এসব অসুররূপী মানুষগুলো আজ সমাজে বড় বেশী হয়েছে। তাদের দাপটে সুর অর্থাৎ সত্যিকারের মানুষগুলো কোণঠাসা। অসহায় নারীদের আর্তনাদ আকাশে বাতাসে।
নারীর মধ্যেই সেই শক্তি আছে। যা এসব অসুরকে বধ করতে পারে, ধ্বংস করতে পারে। নারী শক্তি যুগে যুগে জাগ্রত হয়েছে। আজও তাই হবে। নারী শক্তি ঠিক জেগে উঠবে। হাতে অস্ত্র নিয়ে দেবী কালী অসুরের সাথে যুদ্ধে রত।
তন্ত্র পুরাণে দেবী কালীর একাধিক রুপভেদেও উল্লেখ আছে। তোড়লতন্ত্র অনুসারে কালী নয় প্রকার। যথা- দক্ষিণাকালী, কৃষ্ণকালী, সিদ্ধকালী, গুহ্যকালী, শ্রীকালী, ভদ্রকালী, চামুন্ডাকালী, শ্মশানকালী ও মহাকালী, কালকালী, কামকলাকালী, ধণকালী, চণ্ডিকাকালী, সৃষ্টিকালী, স্থিতিকালী, সংহারকালী, রক্তকালী, যমকালী, মৃত্যুকালী, রুদ্রকালী, পরমার্ককালী, মার্তন্ডকালী, কালাগ্নিরুদ্রকালী, মহাভৈরবঘোর ও চন্ডকালী প্রভৃতি। পৃথিবীতে যারা অত্যাচারী, লোভ আর ক্রোধান্বিত থাকে তারাও ধ্বংস হয়। কোনো শক্তি আসে তাকে ধ্বংস করতে। প্রতিটি নারী এক একটি শক্তি স্বরুপ। তাদের মধ্যেও সেই বিনাশী শক্তি আছে। যা সব হিংস্র হায়েনাকে ধ্বংস করতে সক্ষম। যাই হোক সনাতন ধর্মামলম্বীদের দ্বিতীয় বড় ধর্মীয় উৎসব কালী পূজা মানুষের মুখে একটু হাসি বয়ে আনবে। মনে শক্তি যোগাবে। আর দেবীর কাছে প্রার্থণা থাকবে পৃথিবীকে কলুষরূপ অন্ধকার দূর করে মানুষকে একটি সুস্থ স্বাভাবিক ও সুন্দর জীবন ফিরিয়ে দিতে। অন্ধকার থেকে আলোর পথে আনতে দেবী কালী শক্তির প্রয়োজন। সমাজে যত হিংস্র মানুষ রয়েছে, অসৎ মানুষ যারা সমাজের রন্ধ্রে বিষ ছড়িয়ে দিয়েছে তাদের দূর করে শান্তি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে কালী শক্তির প্রয়োজন। শ্যামা পূজায় প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের সাথে সাথে দূর হয়ে যাক যত অন্ধকার।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট।
Email- sopnil.roy@gmail.com