এ এইচ এম নোমান
আজ থেকে ১৬ বছর আগের কথা। হিসাব কষে দেখলাম তখন তাঁর বয়স ছিল ৮৪ এবং আমার ছিল ৬৪। ১০ এপ্রিল, ২০০৮। নেপালের সংবিধান পরিষদ ঐতিহাসিক নির্বাচনের দিনে বাংলাদেশ মানবাধিকার সমন্বয় পরিষদ (বামাসপ) পর্যবেক্ষক দল ৩টি ভাগে ভাগ হয়ে পাহাড়ি এলাকাঘেরা ভক্তপুর, কাঠমুন্ড ও ললিতপুর জেলার মোট ২৫ টি ভোটকেন্দ্র সরাসরি পর্যবেক্ষণ করি।
ললিতপুর জেলার পটন দরবার স্কয়ার ভোট কেন্দ্রে কার্টার সেন্টারের প্রধান ও আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের সঙ্গে আমাদের সাক্ষাত হয়। স্কয়ার বারান্দায় জিমি কার্টারকে দেখে এগিয়ে গিয়ে পরিচিত হলাম। বাংলাদেশ থেকে আমরা বামাসপ পক্ষ থেকে এসেছি, আমি বামাসপ’র প্রেসিডেন্ট। ও-তুমি প্রেসিডেন্ট! ভাল-ওয়েলকাম, এই কথা বলে হ্যান্ডসেক করলেন। মত বিনিময়ে আন্তরিকতার সঙ্গে আমাদের দেশের ড. ইউনূসসহ অনেককেই চিনেন। ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশে এসেছিলেন এসব বললেন। এছাড়া তিনি নিজ থেকেই প্রশ্নবোধক বাক্যে সহাস্যে বাংলাদেশর নির্বাচন বিষয়ে খোঁজ খবর নেন। আমি বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনের সময় পর্যবেক্ষণে আসবেন দাওয়াত দিলাম। তিনিও আসবেন বলে আশাবাদ ব্যাক্ত করেন।
এ ফাঁকে পটন দরবার ভোট কেন্দ্র দেখে বের হয়ে এসে দেখলাম নিচতলার বারান্দায় পর্যটন দৃষ্টিতে দাড়িয়ে জনাব জিমি কার্টার। বেরুতে বেরুতে আমি বল্লাম, স্যার, দেখা হবে আবার আশা করি। এই বলে আমরা চার জনের টিম এগিয়ে যেতেই থামিয়ে বললেন, হ্যালো-প্রেসিডেন্ট, ওয়েট, আস তোমার সাথে একটি স্মৃতি-ছবি তুলি। তাঁর সাথে অনেক সহযোগী ছিল, তন্মধ্যে একজন ছবি নিলেন। আমাদেরও আ হ ম ফয়সল ক্যামেরা দিয়ে ছবি নিলেন। জিমি কার্টার নিজেই আমার কাঁধে হাত রেখে হাসিমুখে দাঁড়ালেন-পোজ দিলেন। মূহুর্তেই আমার বামাসপ’র সঙ্গীরা এডভোকেট কাশেম, এডভোকেট শামছুদ্দীন ও প্রেমা আপা আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন, ফটোসেশন শেষ। একে অপরের দিকে তাকিয়ে আবার কোলাকোলি করে অন্য কেন্দ্র পথে আমরা গাড়ীতে উঠলাম। দেখলাম তাঁর গাড়ীবহরে তা ৬/৭ টা গাড়ী হবে, ফ্লাগসহ বিশেষ প্রোটোকলে তাঁরাও পথ চললেন।
নির্বাচনের আগের দিন ৯ এপ্রিল, ২০০৮ সন্ধ্যা ৫টায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার মিস্টার ভোজরাজ ফোখরেল একজন মহিলাসহ ৫ সদস্য বিশিষ্ট নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে নির্বাচন সংক্রান্ত প্রেস ব্রিফিং আয়োজন করেন। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক এবং সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দেন। সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সকলের সহযোগিতা কামনা করেন। এই ব্রিফিং এ জিমি কার্টারকে সরাসরি প্রথম দেখি, প্রথম সারিতে তাঁর একজন পরের চেয়ারে আমিও ছিলাম, তিনি কোন প্রশ্ন বা মন্তব্য করেননি। আমি বরং প্রধান নির্বাচন কমিশনার ভোজরাজকে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলাম, মাওবাদীদের অস্রের রাজ্যে আমরা বিদেশী পর্যবেক্ষকরা কিভাবে নিরাপদে থাকবো? উত্তরে মি. ভোজরাজ বলেন, নির্বাচনী দায়িত্ব নিয়ে আমি সব দল-গ্রুপের সাথে আলোচনা করি। তারা সকলেই আমাকে অভয় দিয়েছেন, অঙ্গীকার করেছেন। তারা পূর্ণাঙ্গ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াই অংশ গ্রহণ করবেন ও মাঠে থাকবেন। তাই আপনারাও নিশ্চিন্তে নির্দ্বিধায় যেকোন স্থানে-কেন্দ্রে যান, কোন অসুবিধা হবেনা।
সংবিধান পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে নেপালের নির্বাচন কমিশন সকল প্রকার প্লানিং কনডাকটিং, মনিটরিং এবং কন্ট্রোল করার দায়িত্বে নিয়োজিত। রাজতন্ত্রের অবসান ও মাওয়াবাদীদের সঙ্গে সংগঠিত পরিস্থিতিতে ২০০৬ সালে সকল পক্ষের শান্তি চুক্তির মাধ্যমে আয়োজিত এই নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে বাংলাদেশ মানবাধিকার সমন্বয় পরিষদ- বামাসপ দেশের ১২টি সদস্য সংগঠনের ৭ জন মহিলা এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা জনাব এম. হাফিজ উদ্দিন খানসহ মোট ১৯ জন প্রতিনিধি, আমি টীম লিডার, নেপালে যাই।
১১ এপ্রিল নির্বাচনের পরের দিন। পর্যায়ক্রমে কার্টার সেন্টার, নেপালের এশিয়া ফাউন্ডেশনসহ দেশি-বিদেশী অন্যান্য সংস্থাও মতবিনিময় ও প্রেস ব্রিফিং করেন। এখানে জিমি কার্টার আমাকে দেখে হাসি হাসি ভাবে বলেন, হ্যালো মি. নোমান আবারো দেখা হলো তোমার সাথে। কি ও কেমন দেখলে জিজ্ঞাসা করলে বললাম, নেপালের সংবাদপত্রে নির্বাচন কমিশনের উদ্বৃতিতে দেখা যায় ভোট দানের হার ৭০%। নেপালের জনগণ আনন্দ ও উৎসব মুখর পরিবেশে এই নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশ গ্রহণ করেছেন। আমরা যে ২৫ টি ভোট কেন্দ্র পর্যবেক্ষণ করেছি সেখানে কোন প্রকার বিশৃঙ্খলা দেখা যায়নি। একটি কেন্দ্রে দেখলাম মাওবাদী এক তরুণ যার প্রয়োজন তাকে পানি পান করাচ্ছেন। সারাদেশে শুধু একটি নির্বাচনী এলাকায় একজন প্রার্থী প্রতিপক্ষের আক্রমণে খুন হয়।
পর্যবেক্ষণ শেষে দেশে ফিরে এসে বামাসপ ঢাকাস্থ রিপোটার্স ইউনিটি হলে প্রেস ব্রিফিং করি। ‘নেপালের নির্বাচন শেখার আছে অনেক’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখি যা পত্রিকায় ছাপা হয়।
নেপালের ৩ দিনের বিভিন্ন ইভেন্টস-এ মি. কার্টার’র চলনে বলনে আচরণে মানবিকতা এবং পত্র-পত্রিকার বিভিন্ন লেখালেখি থেকে যৎসামান্য যা অর্জন করতে পেরেছি সে আলোকে তাঁর সম্পর্কে পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু উপস্থাপন করলাম।
১ অক্টোবর ১৯২৪ এ জন্ম নেয়া যুক্তরাষ্ট্রের ৩৯তম প্রেসিডেন্ট কার্টারের ১০০ বছরের বর্ণিল জীবন সমাপ্তি ঘটল। তিনি ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪ তারিখে ঈশ^রের কাছে চলে যান। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টদের মধ্যে জিমি কার্টার সবচেয়ে দীর্ঘ শত বছর জীবন পেয়েছিলেন। ২০২৪, গত বছরের ১ অক্টোবর তার শততম জন্মদিন উদযাপন করা হয়। তিনি সাধু স্বত্ত্বার প্রতিবিম্ব, কবিতার শক্তি, ঔপন্যাসিক, মানব প্রেমিক ও শৈল্পিক। জর্জিয়া বাসিন্দা প্লেইনস গ্রামের চিনাবাদামচাষী ও ব্যবসায়ী পরিবার থেকে উঠে আসা, জর্জিয়ার গভর্নরও ছিলেন। তাঁর জন্মকালের ৭ শত জনের বসতির জর্জিয়াতেই তাকে সমাহিত করা হয়।
নিজের রাজনৈতিক ও ধর্ম বিশ্বাসের বিষয়ে কার্টার বলেছিলেন,‘আপনি ধর্ম বিশ্বাস ও পাবলিক সার্ভিসকে আলাদা করতে পারেন না। আমি কখনোই ঈশ^রের ইচ্ছা আর আমার রাজনৈতিক দায়িত্বের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখিনি। আপনি একটা ‘লঙ্ঘন করলে আরেকটাও লঙ্ঘিত হবে’। প্রেসিডেন্ট থেকে বিশ^মানবতাবাদী রাষ্ট্রনায়ক জিমি কার্টারের সহজ-সরল জীবনধারা এবং ন্যায়পরায়ণ আচরণ, খোলা মন তাঁকে আরো বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছিল। কার্টার তার নির্বাচন প্রচারণায় বলেছিলেন, ‘আমি আপনাদের সঙ্গে কখনো মিথ্যা কথা বলব না’। এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি একজন সৎ, নম্র ও খোদাভীরু ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেন। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রে মানবাধিকারের গুরুত্ব তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের নৈতিক বোধ আমাদের এমন একটি সমাজ গড়ে তুলতে সহায়তা করবে, যেখানে সবাই ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রতি অবিচল শ্রদ্ধা প্রদর্শন করবে’। তার প্রতিশ্রুতি ছিল, তিনি আমেরিকান জনগণের মতোই ‘সৎ, উদার ও ভালোবাসাপূর্ণ’ একটি সরকার পরিচালনা করবেন।
১৯৭৬ সালের ডেমোক্রেটিভ কনভেনশনে তাঁর দলের মনোনয়ন গ্রহণ করে সাধারণ অথচ বলিষ্ঠ ভাষায় ঘোষনা দেন ‘আমার নাম জিমি কার্টার এবং আমি প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী’। এপ্রেক্ষিতে ছোটবেলা থেকে একটা কথা শুনে এসেছি যে, ‘বাপের নামে আধা, দাদার নামে গাধা, নিজের নামে শাহাজাদা’। এখানেও আমি জিমি কার্টারের সাদামাটা পরিচিতি বক্তব্যটা তাঁর নিজের উপর আস্থা ও বিশ^াসকে ফুটিয়ে তোলারই নামান্তর। কার্টার হোয়াইট হাউজে এসে তার পূর্বসূরিদের চর্চা করা ‘অনৈতিক রাজনৈতিক’ বিষয় থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে উদ্যোগী ছিলেন।
কার্টার, ১৯৭৭ সালে দায়িত্ব গ্রহণ করে ১৯৮১ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব শেষে ১৯৮২ সালে ‘কার্টার সেন্টার’ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি শান্তি স্থাপন, সকলের জন্য সমান অধিকার নিশ্চিতকরণ, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, রোগ নিরাময় ও দারিদ্র বিমোচনে নিজেকে নিয়োজিত করেন। তার প্রতিষ্ঠিত কার্টার সেন্টার ৪০ টিরও বেশি দেশে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছে এবং বিভিন্ন দেশে জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে অসামান্য ভূমিকা রেখেছে। তিনি তাঁর স্ত্রী রোজালিনের (মৃত) সঙ্গে দীর্ঘ ৭৭ বছর বিবাহিত জীবনে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করেছেন। রোজালিনের পাশেই ৯ জানুয়ারি ২০২৫ তাঁকে সমাহিত করা হয়। তিনিই প্রথম বিশ্বনেতা যিনি জলবায়ু পরিবর্তনকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তিনি ইসরাইলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের উপর আক্রমণের অভিযোগ করেন। আন্তর্জাতিক সংঘাতের শান্তিপূর্ণ সমাধান, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের অগ্রগতি এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন কাজের জন্য তাকে ২০০২ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।
জিমি কার্টারের মৃত্যুতে শোক জানিয়ে জো বাইডেনকে লিখা চিঠিতে ড. ইউনূস শেষ লাইনে লিখেন, ‘মানবাধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতি তাঁর অবিচল অঙ্গীকার আমাকে সব সময় উৎসাহিত করেছে’। আমার আন্দাজ নোবেল বিজয়ী বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ‘কার্টার সেন্টারে’ এ উৎসাহিত হয়ে ‘ইউনূস সেন্টার’ প্রতিষ্ঠা করেছেন। আমার মনে হয় তিনি নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে অন্যকে উৎসাহিত করাটাকেই পছন্দ করতেন। তিনি সব সময় পরের তরে। নেপালের নির্বাচনের দিনগুলোতে তাঁর সঙ্গে যতবারই দেখা হয়েছে তিনি ছিলেন হাস্যোজ¦ল। তাঁর ঈশ্বরের উপর অগাধ বিশ্বাস ও মানুষের প্রতি ভালবাসা ও উদার মনের জন্যই তিনি শতবর্ষ আয়ু পেয়েছেন। হ্যালো প্রেসিডেন্ট, হ্যান্ড সেক, কোলাকুলি এবং হাস্যোজ¦ল মুখের ৩ দিনের ৩ বারের স্মৃতি নিয়েই আমি মনের প্রশান্তিতে আছি। তিনি স্বর্গবাসী হউন, কামনা করি।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা র্ডপ ও গুসি আন্তর্জাতিক শান্তি পুরষ্কার বিজয়ী।
email: nouman@dorpbd.org