রেজা মতিন
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি- অমর এ গানের সুরকার শহীদ আলতাফ মাহমুদ। সুর দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে সংশপ্তক যোদ্ধাদের নিরন্তর উজ্জ্বীবিত করেছিলেন শিল্পী আলতাফ মাহমুদ (জন্ম: ২৩ ডিসেম্বর, ১৯৩৩ – অন্তর্ধান: ৩০ আগস্ট, ১৯৭১) ।
প্রকৃত নাম এ.এন.এম আলতাফ আলী। আলতাফ মাহমুদের বাবার নাম নাজেম আলী হাওলাদার এবং মা কদবানুর একমাত্র পুত্র সন্তান আলতাফ মাহমুদ। আলতাফ মাহমুদের বাবা প্রথমে আদালতের পেশকার এবং পরবতীর্তে জেলা বোর্ডের সেক্রেটারি ছিলেন।
আলতাফ মাহমুদকে সবাই ঝিলু নামেই ডাকতেন।
শৈশব থেকেই ছিলেন চঞ্চল স্বভাবের। ছবি আঁকা ও গুনগুন করে গান গাওয়া ছিল তাঁর অভ্যাস। কণ্ঠ ছিল বেশ সুরেলা। বাড়ির পাশে শান বাঁধানো বেঞ্চে বসে রাতের বেলায় খেমচাঁদ, সায়গল, নওশাদ, রাঁইনাদ বড়াল, শঙ্কর জয়কিশান, কানাকেষ্ট, জ্ঞান গোসাই, কে মল্লিক, কমলা ঝরিয়ার মতো শিল্পী ও সুরকারের গান গাইতেন সুর করে।
বরিশাল জিলা স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময় থেকেই বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। বরিশালের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান যেখানে হতো, সেখানেই ঝিলুকে পাওয়া যেত। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দিনটিতে বরিশাল শহরে বেশির ভাগ তোরণ নির্মাণের শিল্পনির্দেশক ছিলেন তিনি। ১৩ আগস্ট রাত ১২টা এক মিনিটে ‘তরুণ মাহফিলের’ পক্ষ থেকে স্বাধীনতা বরণের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রথম গানের কণ্ঠশিল্পী ছিলেন আলতাফ মাহমুদ।
১৯৪৮ সালে বরিশাল জিলা স্কুল থেকে তিনি মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা পাশ করে বিএম কলেজে ভর্তি হন। পরে তিনি চিত্রকলা শিখতে কলকাতা আর্টস স্কুলে ভর্তি হন। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই মাহমুদ গান গাইতে শুরু করেন।
১৯৫০ সালে আলতাফ মাহমুদ ঢাকায় ফিরে ধুমকেতু শিল্পী সংঘে যোগ দেন। পরবর্তীতে তিনি এই সংস্থাটির ‘সঙ্গীত পরিচালকের দায়িত্ব পান। ১৯৫০ সালের দিকে তিনি ভাষা আন্দোলনের পক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্য বিভিন্ন জায়গায় গণসঙ্গীত গাইতেন। গান গাওয়ার মাধ্যমে মাহমুদ এই আন্দোলনকে সর্বদাই সমর্থন যুগিয়েছেন।
২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ সালে আবদুল গাফফার চৌধুরী রচিত আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো শিরোনামের আলোড়ন সৃষ্টিকারী গানটিতে সুর সংযোজন করে খ্যাতির শীর্ষে আরোহণ করেন।গানটির প্রথম সুরকার আব্দুল লতিফ হলেও পরবর্তীতে আলতাফ মাহমুদের সুরটিই গৃহীত হয়। এই সুরটি ১৯৬৯ সালে জহির রায়হান তাঁর চলচ্চিত্র জীবন থেকে নেয়া-তে ব্যবহার করেন।
১৯৫৬ সালে ভিয়েনায় আয়োজিত শান্তি সম্মেলনে যাওয়ার আমন্ত্রণ পেয়ে তিনি করাচি পর্যন্ত গিয়েছিলেন, কিন্তু তৎকালীন পাকিস্তান সরকার তাঁর পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করায় তিনি আর যেতে পারেননি। ওই সময় তিনি দেশে না ফিরে ১৯৬৩ পর্যন্ত করাচিতেই অবস্থান করেন। সেখানে তিনি ওস্তাদ আবদুল কাদের খাঁর নিকট উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে তালিম নেন। কিছুকাল নৃত্যশিল্পী ঘনশ্যাম ও গীতিকার, সঙ্গীত পরিচালক দেবু ভট্টাচার্যের সঙ্গেও তিনি কাজ করেন। ১৯৫৫ সালের দিকে সংগীত পরিচালক দেবু ভট্টাচার্য ছিলেন চলচ্চিত্র সংগীতের উজ্জ্বল নক্ষত্র। আলতাফ মাহমুদের চলচ্চিত্র সংগীতের শিক্ষাগুরু ছিলেন দেবু ভট্টাচার্য।
করাচি থেকে ঢাকায় ফিরে ১৯৬৫ সালের দিকে তিনি চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনার কাজ শুরু করেন এবং জীবন থেকে নেয়া, ক্যায়সে কাহু, কার বউ, তানহা, বেহুলা, আগুন নিয়ে খেলা, দুই ভাই, সংসার, আঁকাবাঁকা, আদর্শ ছাপাখানা, নয়নতারা, শপথ নিলাম, প্রতিশোধ, ক খ গ ঘ ঙ, কুচবরণ কন্যা, সুয়োরাণী দুয়োরাণী, আপন দুলাল, সপ্তডিঙ্গাসহ বিখ্যাত ১৯টি চলচ্চিত্র প্রযোজনা করেন আলতাফ মাহমুদ। অনেক চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনা ছাড়াও মায়ামৃগ, আমরা স্ফুলিঙ্গসহ বেশ কয়েকটি নাটক পরিচালনা করেন তিনি। ছায়াছবিতে সঙ্গীত পরিচালনার পাশাপাশি তাঁর সাংগঠনিক তৎপরতাও অব্যাহত থাকে। এ সময় তিনি ‘ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠী’সহ অনেক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হন এবং বিভিন্ন সভা-সমিতিতে গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন।
আলতাফ মাহমুদ ১৯৬৬ সালের ১৬ অক্টোবর সারা বিল্লাহ’র সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। সারা মাহমুদ ও আলতাফ মাহমুদ দম্পতির একমাত্র সন্তান শাওন মাহমুদ।শাওন মাহমুদ বাবার স্মৃতির প্রতি প্রত্যাশা নিয়ে লিখেছেন, ‘একুশের গানের সুরে ভেসে বেড়াক বাবার ছায়া।’
১৯৭১ সালে আলতাফ মাহমুদ স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে তাঁর বাসায় গোপন ক্যাম্প স্থাপন করেন। কিন্তু ক্যাম্পের কথা ফাঁস হয়ে গেলে ১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট পাকিস্তানি বাহিনী তাঁকে আটক করে। তাঁর ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। তাঁর বাসা থেকে আরো অনেক গেরিলা যোদ্ধা আটক হয়।এদের অনেকের সাথে তিনিও চিরতরে হারিয়ে গেছেন।
ভিন্ন সূত্রে জানা যায় “আলতাফ মাহমুদের ওপর পাশবিক অত্যাচার চলে, তার নখ তুলে ফেলা হয়, হাত-পা সব ভেঙে দেওয়া হয় । সম্ভবত তার চোখ দুটিও পৈশাচিক নির্যাতন থেকে রেহাই পায়নি । পাকিস্তানী নরপশুরা জোর করে কিছু স্বীকারােক্তি আদায় করতে চেয়েছিল, কিন্তু একটি বারের জন্যও আলতাফ মাহমুদের মুখ খােলাতে পারেনি। অমানুষিক অত্যাচারে সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই তাঁর মৃত্যু ঘটে।”
পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে তাঁর দেশাত্মবোধক গান প্রচারিত হতে থাকে যা অগণিত মুক্তিযোদ্ধাকে অণুপ্রারিত করেছিল।
১৯৭৭ সালে আলতাফ মাহমুদকে একুশে পদক প্রদান করা হয়। বাংলা সংস্কৃতি ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদান রাখার কারণে তাঁকে এ পুরস্কার প্রদান করা হয়। সংস্কৃতিক্ষেত্রে অসামান্য আবদান রাখায় শহীদ আলতাফ মাহমুদকে ২০০৪ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার (মরণোত্তর) প্রদান করা হয়।