সচেতনতাই পারে হাজার হাজার শিশুকে অন্ধত্ব থেকে বাঁচাতে

কর্মশালায় বক্তারা

ঢাকা, ১৪ ডিসেম্বর: প্রতি বছর হাজার হাজার শিশুর দৃষ্টিশক্তি রক্ষায় শিশু অন্ধত্বের অন্যতম কারণ রেটিনোপ্যাথি অব প্রিম্যাচুরিটি (আরওপি) নিয়ে গণসচেতনতামূলক প্রচারণা চালানোর পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ, নবজাতক বিশেষজ্ঞ, শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ এবং চক্ষু বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলেছেন, সাধারণ মানুষ এমনকি অনেক চিকিৎসকও আরওপি’র ঝুঁকি, এর পরিণতি ও সঠিক ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সচেতন নন, যা এ রোগ প্রতিরোধে একটি বড় বাধা।

রাজধানীর হলিডে ইনে আয়োজিত দুই দিনব্যাপী এক ‘আরওপি বিষয়ক ওয়ার্কশপ’-এ প্রধান অতিথির বক্তব্যে চিকিৎসকরা এ পরামর্শ দেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ)নিওনাটোলজি বিভাগ এবং অরবিস ইন্টারন্যাশনাল এই কর্মশালার আয়োজন করে, যা শেষ হয় বৃহস্পতিবার।

আরওপি এমন একটি রোগ যা অপরিণত অবস্থায় জন্ম নেওয়া এবং কম ওজনের নবজাতকের রেটিনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। সময়মতো অর্থাৎ জন্মের ২০ থেকে ৩০ দিনের মধ্যের শনাক্ত এবং দ্রুত চিকিত্সা না করা হলে এটি দ্রুত অন্ধত্বের পর্যায়ে যেতে পারে।

সরকারি তথ্যে দেখা যায়, বাংলাদেশে বছরে ৩০ লাখেরও বেশি শিশুর জন্ম হয়, যাদের প্রায় ১২ দশমিক ৫ শতাংশ বা ৪ লাখ নির্দিষ্ট সময়ের আগেই জন্মগ্রহণ করে। এসব শিশুর আরওপি হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

কর্মশালায় প্রধান অতিথি ছিলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক দেশের একজন প্রখ্যাত শিশু সার্জন অধ্যাপক মো. আবু জাফর। সভাপতিত্ব করেন বিএসএমএমইউ’র নিওনাটোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান।

বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনসের প্রেসিডেন্ট নবজাতক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ, প্রবীণ শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নাজমুন নাহার, বাংলাদেশ প্রিনেটাল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট গাইনোকোলজিস্ট অধ্যাপক লায়লা আরজুমান্দ বানু, নবজাতক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবিদ হোসেন মোল্লা, বিএসএমএমইউ অফথালমোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তারিক রেজা আলী, বাংলাদেশ নিউনেটাল ফোরামের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক মুনির হোসেন অনুষ্ঠানে এবং মহাসচিব অধ্যাপক সঞ্জয় কুমার দে অন্যান্যের মধ্যে অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন।

সারাদেশের মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের প্রসূতি, নবজাতক, শিশুরোগ এবং চক্ষুবিদ্যা বিভাগের চিকিৎসক ও অন্যন্য অংশীজনরা কর্মশালায় অংশ নেন।

এসব মেডিকেল কলেজ ও চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ছিল বিএসএমএমইউ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ, রংপুর মেডিকেল কলেজ, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ, কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ, পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল ঢাকা, বারডেম জেনারেল হাসপাতাল, বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট, চট্টগ্রাম মা-ও-শিশু হাসপাতাল, কক্সবাজার জেনারেল হাসপাতাল, ডা. এম আর খান শিশু হাসপাতাল ও শিশু স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, আশুলিয়া মহিলা ও শিশু হাসপাতাল, দীপ আই কেয়ার ফাউন্ডেশন, রংপুর এবং শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, মাতুয়াইল।

কর্মশালায় বক্তৃতাকালে অধ্যাপক আবু জাফর বলেন, আরওপি রোগী শনাক্ত ও চিকিৎসার জন্য চক্ষু বিশেষজ্ঞ, নবজাতক বিশেষজ্ঞ ও নার্সদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। তিনি বলেন, আরওপি পরীক্ষা ও চিকিৎসাকে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে আরও বেশি মানুষকে এর আওতায় আনতে।

সচেতনতা সৃষ্টির উপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, “সচেতনতা, বিশেষ করে চিকিত্সকদের মধ্যে সচেতনতা আরওপি প্রতিরোধের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ তারা এই রোগ সম্পর্কে তারাও ভালভাবে সচেতন নন।”

অধ্যাপক শহীদুল্লাহ বলেন, আরওপি পরীক্ষার দায়িত্ব শুধুমাত্র চক্ষু বিশেষজ্ঞদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা উচিত নয়, এটি নবজাতক বিশেষজ্ঞ, শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ এবং রেটক্যাম্প নার্সদের দিয়েও করানো যায়।

তিনি বলেন, “আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে আরওপি পরীক্ষার জন্য উপযুক্ত একটি অপরিণত বা কম ওজনের শিশুও যেন পরীক্ষা থেকে বাদ না পড়ে।”

অধ্যাপক নাজমুন নাহার বলেন, অরবিস পরিহারযোগ্য অন্ধত্ব প্রতিরোধে অসাধারণ কাজ করছে, তবে আরও বেশি শিশুকে এ রোগের পরীক্ষার আওতায় আনতে তাদের কর্মসূচি আরও প্রসারিত করা প্রয়োজন। এছাড়া অপরিণত শিশুদের আরওপি পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে তারা প্রচারাভিযান পরিচালনা করতে পারে।

তিনি বলেন, “যখন আমরা ডাক্তাররাই আরওপি সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন নই, তখন সাধারণ মানুষ কীভাবে এটি সম্পর্কে জানবেন। মায়েরা তাদের অপরিণত শিশুদের আরওপি স্ক্রিনিংয়ে আগ্রহী হবেন না যতক্ষণ না তারা এর ঝুঁকি সম্পর্কে জানবেন।”

এ রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে চিকিত্সকদের জন্য একটি আরওপি স্ক্রিনিং ও ব্যবস্থাপনা প্রোটোকল প্রণয়ন প্রয়োজন বলেও মত দেন তিনি।

অধ্যাপক লায়লা আরজুমান্দ বলেন, বাংলাদেশে টেস্টটিউবের মতো প্রজনন সহায়ক প্রযুক্তির মাধ্যমে জন্ম নেওয়া শিশুর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় আরওপি পরীক্ষা ও চিকিৎসা দিন দিন আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। কারণ এর মাধ্যমে জন্ম নেওয়া শিশুদের বেশিরভাগ নির্দিষ্ট সময়ের আগে জন্মগ্রহণ করে।

তিনি বলেন, প্রতিটি স্বাস্থ্য কেন্দ্র যেখানে টেস্টটিউব শিশুর জন্ম হয় এবং প্রতিটি সর্বোচ্চ স্তরের হাসপাতালে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ, শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ, নবজাতিক বিশেষজ্ঞ এবং চক্ষু বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি কমিটি থাকা উচিত।

তিনি বলেন, আরওপি প্রতিরোধ ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে একটি নির্দেশিকা প্রণয়ন করা প্রয়োজন এবং অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য গণমাধ্যমে প্রচারণা চালানো উচিত।

অধ্যাপক মুনির হোসেন বলেন, পুরনো সব মেডিকেল কলেজে আরওপি পরীক্ষা ও ব্যবস্থাপনা সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।

অধ্যাপক সঞ্জয় কুমার বলেন, স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার উন্নতির ফলে নবজাতকদের মৃত্যুহার কমেছে তবে অপরিণত ও স্বল্প ওজনের শিশুদের মানসম্পন্ন জীবনের জন্য তাদের সবাইকে আরওপি পরীক্ষার আওতায় আনা প্রয়োজন।

অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, আরওপি পরীক্ষার জন্য হাসপাতালের ডাক্তারদের লিখিত পরামর্শ সত্ত্বেও, সচেতনতার অভাবে অনেক বাবা-মায় সময়মতো তাদের অপরিণত শিশুদের পরীক্ষা থেকে বিরত থাকেন।

রুমি/ঢাকা

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts