বিডিমেট্রোনিউজ ॥ পারভিন এখন আজিমপুর মাতৃসদনে । পারভিনের ধকল যাচ্ছে আয়া সাহেদার ওপর দিয়ে। সাহেদাকে সাসপেন্ড করা হয়েছে কিন্তু যে ডাক্তার ও নার্সরা চিকিৎসা না দিয়ে পারভিনকে হাসপাতাল থেকে বের করে দিলো তদন্তে তাদের কোনো দোষ ধরা পড়েনি। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও মিটফোর্ড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যে দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে সেটিও ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। অন্তঃসত্ত্বা অসহায় পারভিনকে কেনো তারা হাসপাতালে ভর্তি করল না তা দেখারও যেন কেউ নেই।
এ দিকে পারভিনের পাশে কেউ নেই। তার কোনো স্বজন নেই, বন্ধু-বান্ধব, শুভাকাঙ্খী নেই, এমনকি না খাওয়া অসুস্থ শরীরে তিল তিল করে গর্ভে যে সন্তানটি ধারণ করেছিল সেটিও নেই। এখন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষেরই জিম্মায় পারভিন। তারা বলছে, পারভিনের চিকিৎসা চলছে। অথচ ওই হাসপাতালেই এক দিন আগে কোনো চিকিৎসা না পেয়ে পারভিন হাসপাতালের সামনের রাস্তায় সন্তান প্রসব করে। কর্তৃপক্ষ বলছে, সুস্থ হয়ে উঠলে পুলিশের মাধ্যমে তাকে আত্মীয়স্বজনের কাছে হস্তান্তর করা হবে। গতকাল সাংবাদিকদের পারভিনের সাথে দেখা করতে দেয়া হয়নি।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলেছে, রক্তশূন্যতা ও শারীরিক দুর্বলতায় ভুগছে পারভিন। গত মঙ্গলবার তিন হাসপাতালে ঘুরেও সেবা না পেয়ে রাস্তায় সন্তান প্রসব করে পারভীন নামের এই কিশোরী মা। প্রসবের পর শিশুটি মারা যায়। তখন প্রত্যক্ষদর্শী পথচারীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এরপরই বাধ্য হয়ে আজিমপুর মাতৃসদন ও শিশুস্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ পারভিনকে সেখানে ভর্তি করে। সেখানকার চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, পারভীনের রক্তে হিমোগ্লোবিন কম। তাকে রক্ত দিতে হবে। তা ছাড়া, সে তিন বেলা ঠিকমতো খেতে পারত না। তাই শারীরিক দুর্বলতাও দেখা দিয়েছে। পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার পর তাকে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেয়া হবে।
হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, পারভিনকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া যুবক সোহেল গত সোমবার থেকেই ম্যাটারনিটির বারান্দায় বসে তার (পারভীনের) সুস্থতার প্রহর গুনছেন। ঘটনার পর থেকে তিনি পারভিনকে দেখতে চাইলেও একটিবারের জন্য তাকে দেখতে দেয়নি চিকিৎসকেরা। তিনি বলেন, পারভিন আমার আপন বোন না হলেও বোনের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। তাকে নিয়ে তিন হাসপাতালে ঘুরাঘুরি করেছি। দায়িত্ব থাকা সত্ত্বেও কেউ এগিয়ে আসেনি। দুর্ঘটনাটির পর ম্যাটারনিটি কর্তৃপক্ষ নিজেদের পাপ মোচনের জন্য এখন দায়সারা চিকিৎসা দিচ্ছে। আমি একাধিবার দেখতে চাইলেও কর্তৃপক্ষ দেখতে দেয়নি। বরং পুলিশ ও সাংবাদিকদের বিষয়টি জানানোর কারণে তারা প্রতিনিয়ত আমাকে হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। বলছে, পুলিশে দেবে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অবহেলায় যেহেতু পারভিন তার নবজাতক শিশুটিকে হারিয়েছে সেহেতু কর্তৃপক্ষের উচিত পারভিনকে ক্ষতিপূরণ দেয়া, বললেন সোহেল। পারভিনের পারিবারিক ও আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় তাকে নিয়ে শঙ্কিত সোহেল। তার মতে, পারভিন সুস্থ হয়ে কোথায় যাবে? তার তো নির্দিষ্ট কোনো ঠিকানা নেই!
এই প্রসঙ্গে ম্যাটারনিটির তত্ত্বাবধায়ক ডা: ইশরাত জাহান বলেন, ওই এলাকায় সমাজসেবা অধিদফতরের আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে। আমি পারভিনকে ব্যক্তিগতভাবে বলেছি, সে চাইলে ওই সব আশ্রয়কেন্দ্রে তাকে পাঠানো হবে।
রাস্তায় সন্তান প্রসব : রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট
এদিকে রাজধানীর তিন হাসপাতাল ঘুরেও সেবা না পেয়ে রাস্তায় সন্তান প্রসব এবং নবজাতকের মৃত্যুর ঘটনায় এক নারীকে কেন উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। পাশাপাশি ওই নারীকে চিকিৎসা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় দোষীদের বিরুদ্ধে কেন আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে না তাও রুলে জানতে চাওয়া হয়েছে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত ওই ঘটনার খবর নজরে নিয়ে বিচারপতি কাজী রেজাউল হক ও বিচারপতি মাহমুদ উল্লাহর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট ডিভিশন বেঞ্চ আজ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এ রুল জারি করেন।
স্বাস্থ্যসচিব, আইজিপি, সমাজকল্যাণ সচিব, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক, আজিমপুর শিশু মাতৃসদনের সুপারিন্টেন্ডেন্ট, মাতৃসদনের চিকিৎসক নিলুফার, ঢাকার জেলা প্রশাসক ও লালবাগ থানার ওসিকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
এছাড়া ঘটনা তদন্ত করে সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক এবং আজিমপুর শিশু মাতৃসদনের সুপারকে ঘটনার তদন্ত করে ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
আগামী ৫ নভেম্বর এ বিষয়ে পরবর্তী আদেশের জন্য দিন ধার্য করেছেন আদালত।
রাস্তায় প্রসব ও নবজাতকের মৃত্যুর ঘটনাকে অত্যন্ত দুঃখজনক বলে উল্লেখ হাইকোর্ট বলেছেন, গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন আদালতের নজরে এসেছে। এটি আমাদের মতো একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সভ্যতার ওপর কালিমা লেপন। আমাদের স্বাস্থ্যসেবায় গরিব জনগোষ্ঠী অত্যন্ত নিগৃহীত। তাদের চিকিৎসার অবহেলার এই দৃষ্টান্ত, সম্মুখ ব্যবস্থা গ্রহণে সরকারের আরো সচেতন হওয়া আবশ্যক বলে মনে করেন আদালত।
পারভিন আক্তার (২৬) নামের এক নারী গত মঙ্গলবার প্রসব বেদনা ওঠার পর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এবং সবশেষ আজিমপুর শিশু মাতৃসদনে গিয়েও চিকিৎসা পাননি। পরে রাস্তার ওপরেই ওই নারী সন্তান প্রসব করেন, কিন্তু তার কিছুক্ষণ পরই নবজাতকের মৃত্যু হয়।