সিয়াম-সাধনার মাসে মুমিনের করণীয়

আতিকুর রহমান নগরী

প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য চেষ্টা করতে হয়। চেষ্টা-সাধনা ছাড়া কোন কিছু অর্জন করা সম্ভব হয় না। ঠিক তেমনিভাবে মহান আল্লাহর সান্নিধ্য পাওয়ার জন্যও প্রয়োজন যথাসাধ্য প্রচেষ্টা। এজন্য মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে কতিপয় কাজ নির্ধারণ করে দিয়েছেন এবং কেবল তাঁর ইবাদতের আদেশ দিয়েছেন। এর মধ্যে একটি বিশেষ ইবাদত হ’ল রামাযানের সিয়াম, যা আল্লাহ তাঁর বান্দার উপর ফরয করেছেন।

আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর সিয়াম ফরয করা হল, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীগণের উপর ফরয করা হয়েছিল, যাতে তোমরা সংযমশীল হতে
পার’ (বাক্বারাহ ১৮৩)। রামাযানের সিয়াম আল্লাহর পক্ষ হতে তাঁর বান্দাদের জন্য একটি বিশেষ নেয়ামত। আর তা পালনের অফুরন্ত প্রতিদানও মহান আল্লাহর নিকটে রয়েছে।

হাদীছে এসেছে, মহান আল্লাহ বলেন, ‘সিয়াম স্বতন্ত্র, তা আমারই জন্য। আর আমিই তার প্রতিদান দিব’। তাই রহমত, বরকত ও মাগফিরাতে পরিপূর্ণ এ মাসে আমাদের কিছু করণীয় রয়েছে। মাহে রামাযানের কার্যাবলীকে সাধারণত দুই ভাগে ভাগ করা যায়, যেমন- ১. আত্মিক কার্যাবলী ২. বাহ্যিক কার্যাবলী।

নিম্নে এগুলো সম্পর্কে আলোকপাত করা হল- ১. আত্মিক কার্যাবলী :

(ক) আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আকাঙ্খা : প্রত্যেক ছায়েমের উচিত শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য সিয়াম পালন করা। কারণ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করা না হ’লে তা কবুল হবে না। রামাযানের সিয়াম পালন প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের সাধনা। কেননা এ ইবাদতে লোক দেখানোর অহেতুক অভিলাষ থাকে না। তাই আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে সিয়াম পালন করার মাধ্যমেই বান্দা তার কাঙ্খিত পুরস্কার লাভ করতে পারে। রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, করার জন্য একদিন সিয়াম পালন করবে, আল্লাহ জাহান্নামকে তার নিকট হত একশত বছরের পথ দূরে সরিয়ে দিবেন’।

(খ) আত্মশুদ্ধি অর্জনের প্রচেষ্টা : রামাযান মাস হচেছ আত্মশুদ্ধি অর্জনের মাস। সকল পাপাচার- অনাচার দূরে ঠেলে দিয়ে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করার মাধ্যমে নেকী অর্জনের মাস। কেননা মাহে রামযানের মূল আবেদনই হল সর্বোত্তমভাবে আল্লাহমুখী হওয়া। তাই প্রত্যেক ঈমানদারের অবশ্য কর্তব্য হ’ল এ মাসে আত্মশুদ্ধি ও আল্লাহভীতি অর্জনের চেষ্টায় লিপ্ত হওয়া।

আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের উপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে যেন তোমরা তাক্বওয়া অর্জন করতে পার’ (বাক্বারাহ ১৮৩) । রামাযান মাস হচ্ছে অধিক নেকী অর্জনের মাস। তাই প্রত্যেক ঈমানদারের উচিত এ মাসে বেশী বেশী নফল গালাত আদায় করা এবং পুণ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি করা। কেননা মানবজাতি শয়তানের ধোঁকায় পড়ে ইবাদতে অত্যন্ত গাফেল থাকে; কিন্তু এ মাসে শয়তান মানুষকে ধোঁকা দিতে পারে না। কারণ আল্লাহ এ মাসে শয়তানকে শৃংখলাবদ্ধ করে রাখেন।

রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, ‘রামাযানের আগমন ঘটলে জান্নাতের দরজা সমূহ খুলে দেয়া হয়, জাহান্নামের দরজা সমূহ বন্ধ করে দেয়া হয় এবং শয়তানকে শৃঙ্খলিত করা হয়’। তাই প্রত্যেক মুসলিমের জন্য অবশ্যই কর্তব্য এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য এ মাসে বেশী বেশী নফল সালাত আদায় করা ও নিজের জন্য জান্নাতের দ্বার খুলে নেয়া। পবিত্র কুরআন হচ্ছে মানব জাতির জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে শ্রেষ্ঠ উপহার। এটি নাযিল হয়েছে রামাযান মাসে। ফলে রামাযান মাস বিশেষ মর্যাদা লাভ করেছে।

মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি রামাযান মাসে কুরআন অবতীর্ণ করেছি মানব জাতির হিদায়াতের জন্য ’ (বাক্বারাহ ১৮৫) । তাই কুরআন নাযিলের মাস হিসাবে সকলের উচিত এ মাসে বেশী বেশী কুরআন তেলাওয়াত করা।
রজব-শাবান থেকে মহান আল্লাহ তাআলার দরবারে বরকত কামনা করে আমরা মুসলিম উম্মাহর ইবাদতের বসন্তকাল পবিত্র মাহে রমজানে পৌছেছি। ফরজ-নফল ইবাদতে মনোনিবেশের পাশাপাশি সেহরি-ইফতারও আমরা সেই পালনকর্তার হুকুম পালনার্থে তাঁর দেয়া রিযিক দ্বারা সেরে থাকি। সাহরি ও ইফতার রমজানের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ সাহরি ও ইফতার রমজানের আবহ তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। মানুষের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে এটি এক বিশেষ নিয়ামত। এটি পালন শুধু কর্তব্য নয়, আনন্দও বটে। এতে আল্লাহর প্রতি বান্দাহর আনুগত্যের দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়। সাহরি ও ইফতারের আনুগত্যের এ দৃষ্টান্ত সত্যিই প্রশংসনীয়। তবে সাহরি ও ইফতার কোনোটিই মানুষের মনগড়া বিধান নয়। পবিত্র কুরআন ও হাদিসে এর যথেষ্ট তাকিদ রয়েছে।

সাহরি খাওয়া প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা রাতের অন্ধকার প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত পানাহার কর।’ (বাকারা-১৮৭) সাহরি চৈন্তিক দৃষ্টিতেই কেবল গুরুত্বের দাবি রাখে না, বরং তা আল্লাহর রাসূল (সা.) এর সুন্নত। এতে বরকত রয়েছে, রয়েছে অনেক ফজিলতও। সাহরি খাওয়া সম্পর্কে হজরত রাসূলে করিম (সা.) বলেন, ‘তোমরা সাহরি খাও, কেননা সাহরি খাওয়ার মধ্যে রয়েছে বরকত।’ হোক না সামান্য একটু পানি, রুটি, খেজুর কিংবা শরবত। তবুও রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর এ মহান সুন্নত থেকে বিমুখ না হওয়ার তাকিদ এসেছে। এমনকি
কেউ যদি যেকোনো কারণে সময়মত উঠে সাহরি না খেতে পারে তার জন্যও রাসূল (সা.)-এর বাণী, ‘তোমাদের কেউ যখন ফজরের আজান শোনে, আর এ সময় তার হাতে খাদ্যের পাত্র থাকে, সে যেন আজানের কারণে খাদ্যগ্রহণ বন্ধ না করে, যতক্ষণ না সে স্বীয় প্রয়োজন পূর্ণ করে।’ (আবু দাউদ)

রোজাদারদের প্রতি আল্লাহতায়ালা কঠিন কোনো নীতি গ্রহণ করেননি। বরং রোজাদারদের যাতে কষ্ট না হয় সেজন্য তিনি দেরি করে সাহরি এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গেই ইফতার করার নির্দেশ করেছেন। ইফতার রোজাদারের জন্য একটি আনন্দঘন মুহূর্ত। ইসলামি পরিভাষায় সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার, কামাচার ও পাপাচার থেকে বিরত থেকে সূর্যাস্তের পর কিছু খেয়ে বা পান করে রোজা সমাপ্ত করার নামই ইফতার। সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গেই ইফতার করা সুন্নত। এর আগমুহূর্তে খাবার সামনে নিয়ে বসে থাকাও মুস্তাহাব। তবে সময় হয়ে গেলে দেরি না করে দ্রুত ইফতার গ্রহণ করাই উত্তম। খেজুর বা খোরমা দিয়ে ইফতার করা সুন্নত। না হলে অন্য কোনো ধরনের মিষ্টি জাতীয় দ্রব্য বা শুধু পানি দিয়ে হলেও ইফতার করা যায়।

এর ফজিলত ও তাকিদ দিয়ে রাসূল (সা.) এরশাদ করেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষ দ্রুততার সীমা রক্ষা করে ইফতার করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তারা সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে।’ অন্য হাদিসে তিনি বলেন, মানুষ ততদিন কল্যাণের পথে থাকবে, যতদিন তারা দ্রুত ইফতার করবে।’ (বুখারি)

সাহরি দেরিতে করা উত্তম। নবী করিম (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামেরও এমনটিই আদত-অভ্যাস ছিল। যদি কেউ আগেভাগে সাহরি খেয়ে ফেলে তবে সে নিজের পক্ষ থেকেই রোজার সময় বাড়িয়ে নিল। এতে তার অনেক কষ্টও হতে পারে। অবশ্য আল্লাহতায়ালা এমনটি নির্দেশ দেননি। তার এ মনগড়া অভ্যাসের জন্য সে গুনাহগার হবে। ইফতারের এ বিধান ইসলাম ধর্মেরই অনন্য বৈশিষ্ট্য। ইফতারের এ আনন্দ, তৃপ্তি ও পরম সুখ অনুভব অন্য যেকোনো ধর্মের জন্য ঈর্ষণীয় ব্যাপার। ইফতারে ভ্রাতৃত্ববোধ, অন্তরনিঃসৃত ভালোবাসার ছোঁয়া এবং আধ্যাত্মিক ভাবের যে প্রতিফলন ঘটে, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। ইসলামে রোজার জন্য ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত একটা সময়সীমা বাধা আছে। কেউ যদি বেশি ফজিলত পাবার আশায় বিলম্বে ইফতার করে, তবে সে ভুল করবে। কেননা বিলম্ব করে নিজেদের ইচ্ছেমতো ইফতার করে ইহুদি-খ্রিস্টানরা। এজন্য তারা বঞ্চিত হয়েছে ইফতারের বরকত ও আল্লাহর রহমত থেকে। কেননা সাহরির মতো ইফতারেরও অনেক ফজিলত রয়েছে, এমনকি অন্যকে ইফতার করানোর মধ্যেও রয়েছে সীমাহীন পুণ্য। ইফতারের আগমুহূর্তে আল্লাহতায়ালা মানুষের দোয়া কবুল করেন। তাই এ সময় আল্লাহর কাছে দোয়া করে উভয় জাহানের কল্যাণ অর্জনের বিকল্প নেই।

লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts