এস এম সাখাওয়াত হুসাইন
সমাজে পারস্পারিক সহযোগীতা ও সহমর্মীতাকে ইসলামে যে কত বেশী গুরুত্ব দিয়েছে তা আমরা সদাকাতুল ফিতরের বিষয়ে আলোচনা করলে জানতে পারবো।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে যে, হযরত রাসূল (সঃ) রমযান মাসের রোযার ফিতরা এক সা’ পরিমান শুষ্ক খেজুর কিংবা এক সা’ পরিমান যব মুসলমান সমাজের প্রত্যেক স্বাধীন, মুক্ত কিংবা দাস পুরুষ কিংবা স্ত্রীলোকের ওপর ফরয করে দিয়েছেন। (মুসনাদে আহমদ, আবু দাউদ)
হাদীসটিতে রমযান মাসের রোযার ফিতরা সম্পর্কে বলা হয়েছে। শরীয়াতের দৃষ্টিতে ফিতরা বলা হয় এমন পরিমান অর্থ বা সম্পদকে যা যাকাত গ্রহন করতে পারে এমন গরীব ব্যক্তিকে বিশেষ পদ্ধতিতে দেয়া হয়। হিজরতের দ্বিতীয় বছর ঈদুল ফিতরের দুই দিন আসে ইসলামী সমাজে এই ফিতরা সর্বপ্রথম বাধ্যতামূলক ভাবে ধার্য ও প্রচলন করা হয়। রোযা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এটা আদায় করা ওয়াজিব হয়ে যায়।
এটা স্বাধীন মুক্ত পুরুষ, স্ত্রী ও ক্রীতদাস নির্বিশেষে সব মুসলমানের ওপর ওয়াজিব ক্রীতদাস কথাটির এখানে তদানীন্তন আরব সমাজের প্রেক্ষীতে বলা হয়েছে। বর্তমানে স্থায়ী গৃহভৃত্য ইহার স্থলে গন্য হবে এবং বাড়ীর মালিককে তার ফিতরা আদায় করতে হবে। মুসলিম শরীফের হাদীসে বলা হয়েছে : ক্রীতদাসের জন্য মালিককে সদকায়ে ফিতর ছাড়া অন্য কোনো সদকা দিতে হয় না।
সদকায়ে ফিতর মুসলমান মাত্রেরই আদায় করা কর্তব্য। পুরুষদের ব্যপারে তো কোনো অস্পষ্টতা নেই। মেয়েলোক বিবাহিতা হলে স্বামীই তার সদকায়ে ফিতর আদায় করবে। অবিবাহিতা হলেও তার নিজের সামর্থ্য থাকলে সে নিজেই আদায় করবে। তানাহলে তার এবং অন্যান্য নাবালেগদের ফিতরা আদায় করবে তাদের পিতা বা অলী বা অভিভাবক। অবশ্য যার পক্ষে যাকাত গ্রহণ জায়েয ও হালাল, তার পক্ষে ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব নয় বলে বিশেষজ্ঞরা মত প্রকাশ করছেন। কিন্তু নবী করীম (সাঃ) বলেছেন: ফকীর গরীবের পক্ষেও ফিতরা দেওয়া ওয়াজিব। সে যা দিবে আল্লাহ তাকে তার দেওয়া পরিমাণের বেশী ফিরিয়ে দেবেন। আলিমুস্ সুনান।
কিন্তু এটা বধ্যবাধকতামূলক নয়, বরং স্বেচ্ছামূলক ও অধিক সওয়াব পাওয়ার আশায় বান্দার আত্মোৎসর্গের ব্যাপার।
ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব এমন মুসলমানের পক্ষে, যে নিজে রোযা রেখেছে। তার পরিমান হাদীসে বলা হয়েছে এক সা’ সা একটা বিশেষ পরিমাপের ওজন, সা’ দুই ধরণের একটি হিজাযী আর অপরটি ইরাকী। এক হিজাযী সা’ আমাদের দেশে চলতি ওজনে প্রায় পৌনে তিনসের । আর ইরাকী সা’র ওজন প্রায় চার সের। এই ওজনের খাদ্যশস্য কিংবা তার বিক্রয় মূল্যই দেয়।
ফিতরার পরিমাণ সম্পর্কে বহু হাদীস গ্রন্থসমূহে উদ্ধৃত হয়েছে। এই পর্যায়ে আর একটি হাদীস এই ঃ আব্দুল্লাহ ইবনে সা’লাবাতা ইবনে ছুগাইর আল উয়রী তাঁর পিতা (ছুগাইর উল উয়রী) হতে বর্ণনা করেছেন ঃ হযরত নবী করীম (সাঃ) তাঁর এক ভাষনে বলেছেন ঃ তোমরা প্রত্যেক স্বাধীন, ক্রীতদাস, ছোট কিংবা বড়’র তরফ হতে অর্ধ সা’ গম কিংবা এক সা’যব কিংবা এক সা’ খেজেুর ফিতরা বাবদ আদায় কর। (আবু দাউদ, আব্দুর রাজ্জাক, দারে কুতনী, তাবারানী, হাকেম)
ফিতরার লক্ষ্য: হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে তিনি বলেছেন: রাসূল করীম (সা) ফিতরার ’যাকাত’ রোযাদারদের বেহুদা অবাঞ্চনীয় ও নির্লজ্জতামূলক কথাবার্তা বা কাজকর্মের মলিনাতা হতে পবিত্র করার এবং গরীব মিসকিনদের (অন্ততঃ ঈদের দিনের উত্তম) খাবারের ব্যবস্থা করার উদ্দেশ্যে অবশ্য আদায়যোগ্য বলে ঘোষণা করেছেন। যে লোক তা ঈদের নামাযের আগে আদায় করবে, তা ওয়াজিব যাকাত বা সদকা হিসাবে আল্লাহর নিকট গৃহীত হবে। আর যে লোক তা ঈদের নামাযের পর আদায় করবে তা তার সাধারণ দান রূপে গণ্য হবে। আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ।
এই হাদীসটিতে সদকায়ে ফিতর এর আধ্যাত্মিক, নৈতিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক কল্যাণের কথা বলা হয়েছে। তার নৈতিক ও আধ্যাত্মিক কল্যাণ এই যে, প্রথমত ফিতরা আদায়কারী ব্যক্তি শরীয়ত লংঘনকারী কোনো কাজে লিপ্ত হবে না ও অর্থের অপচয় করবে না। আর যদি অসতর্কতার কারণে কোনো শরীয়াত বিরোধী কাজ হয়ে যায়, কোনো অশ্লীল কথা মুখ হতে বাহির হয়ে যায় বা কোনো পাপ কাজ করে ফেলে, তবে আল্লাহ তা’য়ালা এই সদকার দৌলতে তা মাফ করে দেবেন। আর সামাজিক অর্থনৈতিক কল্যাণ এই যে, এর দরুণ সমাজের গরীব মিসকিন লোকেরা সাময়িকভাবে হলেও এমন পরিমাণ অর্থ পেতে পারে যার দ্বারা তাদের ও পরিবারবর্গের ঈদের দিনের ভালো কিংবা সাধারণ মানের খাওয়া পরার ব্যবস্থা করা সম্ভব হতে পারে।
হাদীসটি হতে এটাও জানা গেল যে, সাদকায়ে ফিতর আদায় করার সঠিক সময় হল ঈদের নামাযের আগে। আর ঈদের নামাজের আগে বলতে ঈদের দিনের সকাল বেলাও বুঝায়। একদিন দুইদিন আগের সময়ও বুঝায়। এই সময় আদায় করলে তা সঠিকরূপে যথার্থভাবে আদায় করা হল মনে করতে হবে। আর নামাযের পরে আদায় করলে তা সাধারণ দান পর্যায়ে গণ্য হবে। হযরত ইবনে উমর (রা) বর্ণিত একটি হাদীসের শেষাংশের ভাষা হল : নবী করীম (সা) সদকায়ে ফিতর আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন লোকদের ঈদের নামাযের জন্য বের হবার আগে। (বুখারী, মুসলিম।)
এই নির্দেশ যে অবশ্য পালনীয় তা নিঃসন্দেহ। হযরত ইবনে উমর বর্ণিত অপর একটি হাদীসে সাহাবীদের সম্পর্কে বলা হয়েছে: সাহাবায়ে কিরাম সদকায়ে ফিতর ঈদের একদিন বা দুই দিন আগেই আদায় করে দিতেন। (বুখারী)
এটা উত্তম এই জন্যও যে, একদিন বা দুইদিন আগে এই অর্থ গরীব মিসকীনদের হাতে আসলে তারা তা দ্বারা ঈদের দিনের খাওয়া পরার ব্যবস্থার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারে।
এস এম সাখাওয়াত হুসাইন : ইসলামী চিন্তাবিদ