ফারিহা হোসেন
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আজ নানারকম হুমকিতে রয়েছে শিশুরা। নানারকম সংকট, সমস্যা, শঙ্কা নিয়ে বেড়ে ওঠছে তারা। আগামী দিনে যাদের কান্ডারি হিসেবে দেশ ও জাতির নেতৃত্ব দেয়ার কথা, তাদের স্বাভাবিক বেড়ে ওঠার পথ যদি কন্টকাকীর্ণ, বিপদসংকুল হয় তাহলে একটি দেশ, একটি জাতি সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার আশংকা থাকে। ভবিষ্যতের কান্ডারি এসব শিশুদের ভবিষ্যৎ যদি শঙ্কাগ্রস্ত হয় তাহলে ক্ষতিগ্রস্থ হবে পুরো বিশ্ব।
দারিদ্র, যুদ্ধ, বৈষম্য, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বাস্তুচ্যুত, পাচার, ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম, সহিংসতা, নির্যাতন, নীপিড়নের কারণেই বিশ্বের দেশে দেশে শিশুর জীবন হুমকির মুখে। এটা কালো, সাদা, ধনী, গরিব নির্বিশেষে সকল দেশে, সকল গোত্রে, সকল ধর্মের শিশুর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তবে সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও মোটামুটি বিশ্বের অর্ধেক শিশু ১২০ কোটি (প্রায়) শিশু ঝুঁকিতে রয়েছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশসহ পুরো বিশ্বসম্প্রদায়কে শিশুর বেড়ে ওঠার পথকে নিরাপদ, কন্টকমুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, বৈষম্যহীন, যুদ্ধাবস্থা থেকে দূরে রেখে তাদের সুন্দর, নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেয়া জরুরি। এ জন্য স্থানীয়, আন্তর্দেশীয়, আঞ্চলিক, উপ-আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক উদ্যোগ অপরিহার্য্য।
এটাও মনে রাখা উচিত বর্তমানে প্রযুক্তির এই যুগে অনেক শিশু এখন তাদের পরিবারেই নিরাপদ নয়। যেখানে পরিবারেই অনেক শিশু ঝুঁকিতে থাকে সেখানে স্থানীয়, রাষ্ট্রীয়, বৈশ্বিক উদ্যোগ শিশু সুরক্ষায় তাদের, নিরাপদ পরিবেশে বেড়ে ওঠার নিশ্চয়তা কোথায়, তাই শিশুর জীবন সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকাকে খাটো করে দেখার কোনো উপায় নেই। এ অবস্থা শুধু যে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ঘটে তা নয়, পুরো বিশ্বের চিত্রই অনুরূপ।
সম্প্রতি শিশু অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনেও এ ধরনের উদ্বেগজনক তথ্য প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে বিশ্বে ১২০ কোটি শিশু দারিদ্র, বৈষম্য, যুদ্ধের মতো ভয়াবহ এই তিনটি ঝুঁকিতে আছে। এর মধ্যে ১৫ কোটি ৩০ লাখ শিশু একসঙ্গে তিনটি ঝুঁকির মুখে রয়েছে। প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে গত এক বছরে বাংলাদেশ বেশ উন্নতি করেছে। বাল্যবিবাহ, কিশোরী বয়সে গর্ভধারণ, শিশুমৃত্যু, শিশুশ্রম, অপুষ্টি, শিশুর প্রতি সহিংসতাসহ আটটি সূচককে বিবেচনায় নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, ৭০১ পয়েন্ট নিয়ে বাংলাদেশ ১৭৫টি দেশের মধ্যে ১৩০তম স্থানে রয়েছে।
গত এক বছরে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর তুলনায় শিশুর অধিকার রক্ষায়, বাংলাদেশের এই অগ্রগতি ঈর্ষণীয়। বিশেষকরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারে একক প্রচেষ্টায়, জনসচেতনতা, শিক্ষাসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে শিশুর অধিকার রক্ষায় বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ সফলতা অর্জন করেছে। তবে এই অর্জনকে টেকসই করতে হলে প্রয়োজন এর ধারাবাকিতা রক্ষা আর কার্যকর উদ্যোগ। প্রতিবেদনে বাংলাদেশের পেছনে রয়েছে নেপাল ১৩৮তম, পাকিস্তান ১৪৯তম, আফগানিস্থান ১৬০তম। বাংলাদেশের আগে রয়েছে শ্রীলঙ্কা ৬০তম, মিয়ানমার ১০৭তম, ভারত ১১৩তম। সার্বিক অগ্রগতি হলেও বাংলাদেশের প্রান্তিক শিশুরা বিশেষ করে প্রতিবন্ধী শিশুরা বিভিন্নভাবে বঞ্চনার শিকার হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক শিশুদিবস উপলক্ষে সম্প্রতি বৈশ্বিক এ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে সেভ দ্য চিলড্রেন। সংস্থাটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চরম দারিদ্র্য, যুদ্ধ বা সংঘাত ও লিঙ্গবৈষম্যের বিষয়গুলো কিভাবে শিশুদের কাছ থেকে তাদের শৈশব ছিনিয়ে নিচ্ছে, তা নিয়ে গবেষণা চালিয়েছে। দারিদ্র্যকবলিত দেশগুলোতে ঝুঁকির মুখে বাস করছে প্রায় ১০০ কোটি শিশু। যুদ্ধ ও সংঘাত ২৪ কোটি শিশুর জীবনকে প্রভাবিত করছে। নারীদের বিরুদ্ধে বৈষম্য স্বাভাবিক বিষয় এমন দেশে ৫৭ কোটি ৫০ লাখ কন্যাশিশু রয়েছে ঝুঁকির মুখে। এসব শিশুর শৈশব ও ভবিষ্যতের সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ।
বিশ্বে ১৭৫টি দেশের মধ্যে ৯৫টিতে শিশুদের পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তবে অবনতি ঘটেছে ৪০ দেশে। শিশুরা কতটুকু মৃত্যুঝুঁকির মুখে আছে, অপুষ্টি, শিক্ষার অভাব, বাল্যবিবাহ এবং শিশুশ্রমের ওপর ভিত্তি করে দেশগুলোর সূচক নির্ধারণ করা হয়েছে। সূচক অনুসারে শিশুদের অবস্থার সবচেয়ে বেশি উন্নতি হয়েছে সিঙ্গাপুর ও সোভেনিয়াতে। এই দুটি দেশ র্যাংকিংয়ের শীর্ষে যৌথভাবে অবস্থান করছে। এর পরে রয়েছে নরওয়ে, সুইডেন ও ফিনল্যান্ড। সূচকের একেবারে নিচের সারিতে রয়েছে নাইজার, মালি ও সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক। তালিকার একেবারে নিচের দশটি দেশের মধ্যে আটটিই পশ্চিম ও সেন্ট্রাল আফ্রিকার।
প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়েছে, সংঘাত ও নিপীড়নের কারণে বিশ্বে প্রতি মিনিটে ২০ জন মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। সম্প্রতি ঢাকায় সেভ দ্য চিলড্রেন এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বৈশ্বিক প্রতিবেদন তুলে ধরে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। তবে, বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশের বেশি শিশু যাদের বয়স ৫ বছরের কম তারা অপুষ্টিতে ভোগে, ৪৪ শতাংশ কিশোরী মেয়েদের ২০ বছরের আগে বিয়ে হয়ে যায় এবং ৩.৫ ভাগ শিশু ৫ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগেই মারা যায়।
বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী শিশুদের মধ্যে প্রায় ২০ শতাংশ শিশু স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পায়। বাকি শিশুদের স্কুলমূখী করতে সরকারের নিরন্তর প্রচেষ্টা রয়েছে। অচিরেই বাংলাদেশ নিক্ষরমুক্ত দেশ গড়ার অংশ হিসেবে দেশের সকল শিশুকে শিক্ষার আওতায় আনা হবে। স্কুলের বাইরে থাকা শিশুদের মধ্যে ৫৩ শতাংশের দৃশ্যমান প্রতিবন্ধীতা রয়েছে। প্রতিবন্ধীতার শিকার শিশুদের স্কুলে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টির জন্য বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি একীভূত শিক্ষা বিস্তারের জন্য জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় সংগঠনগুলোর সঙ্গে যৌথভাবে কাজের সমন্বয় প্রয়োজন।
খুশির খবর, বাংলাদেশ প্রয় সব সূচকে উন্নতি করেছে। বিশেষ করে শিশুদের বিদ্যালয়ে পাঠানোর ক্ষেত্রে। স্কুল ফিডিং কর্মসূচি, শিক্ষা বৃত্তি-উপবৃত্তিসহ নানা রকম সুযোগ সুবিধা বিদ্যমান থাকায় দিন দিন দেশে শিক্ষার প্রতি আগ্রহ ও উপস্থিতি দুটোই বাড়ছে। তাছাড়া শিশু ও মাতৃমৃত্যু কমিয়ে আনা, স্কুলে ঝরে পড়ার হার হ্রাস, নারী শিক্ষার প্রসার ও নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ বিশ্বে রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। এখন সরকারের পক্ষে এসব কর্মকান্ডের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা প্রয়োজন। প্রত্যাশা বর্তমান সরকার এ দিকে গুরুত্ব দেবেন। পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে শিশুর জীবন হুমকিতে পড়ে এমন কর্মকান্ড বন্ধে আরো কার্যকর ভূমিকা নেবে সরকার।
ফারিহা হোসেন: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক।