সিগারেটের প্যাকেটে ‘সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ’ থাকে। সেখানে সিগারেট খেলে কী কী রোগবালাই হতে পারে, তার ভয়াবহ বর্ণনা থাকে। এর পরেও কেউ যদি সিগারেট খেতে চায়, তাকে সেটা নিজের দায়িত্বে খেতে হয়। আমি একটা সেমিনারের কথা জানি, যেখানে বক্তা তার সেমিনার দেওয়ার আগে ‘সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ’ করে নিয়েছিলেন—অর্থাৎ শ্রোতাদের বলে নিয়েছিলেন যে তিনি যে বিষয় নিয়ে কথা বলতে যাচ্ছেন সেই বিষয়ে বিশেষ কিছু জানেন না, তাই ভুলভাল কিছু বলে ফেললে তার দায়িত্ব নিতে রাজি নন! আজকে ওয়ার্ল্ড কাপ নিয়ে এই লেখাটি লিখতে শুরু করার আগে আমার মনে হচ্ছে পাঠকদের উদ্দেশে আমার ‘সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ’ করে নেওয়া দরকার। কারণ আজকে যে বিষয়টি নিয়ে লিখতে বসেছি, আমি মোটেও তার এক্সপার্ট নই। বিষয়টি কত গুরুতর, সেটি একটি কথাতেই বুঝিয়ে দেওয়া সম্ভব। সারা পৃথিবী যখন ওয়ার্ল্ড কাপের উন্মাদনায় উন্মত্ত, তখন আমি এখন পর্যন্ত একটি খেলাও দেখিনি।
খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে, আমি তাহলে কেন এ বিষয় নিয়ে লিখতে বসেছি? কারণটি খুবই সহজ, ওয়ার্ল্ড কাপ খেলা শুরু হওয়ার পর আমার চারপাশের মানুষগুলো যেভাবে প্রতিক্রিয়া করছে তাতে আমার ধারণা, ওয়ার্ল্ড কাপ খেলা থেকে সেটি মোটেও কম চমকপ্রদ নয়। সেটি নিয়ে আমি তো লিখতেই পারি।
আমার ধারণা, এই দেশের মোটামুটি সবাই জেনে গেছেন জার্মান দেশের ভক্ত একজন নিজের জমি বিক্রি করে এই ওয়ার্ল্ড কাপ খেলা উপলক্ষে প্রায় সাড়ে পাঁচ মাইল লম্বা একটি ফ্ল্যাগ তৈরি করেছেন। পথে-ঘাটে আমরা হয়তো এ রকম কয়েক মাইল লম্বা ফ্ল্যাগ অহরহ দেখি না; কিন্তু নানা দেশের নানা সাইজের ফ্ল্যাগ যে দেখি তাতে কোনো সন্দেহ নেই। হঠাৎ করে কেউ এ দেশে হাজির হলে এটি কোন্ দেশ, সেটি নিয়ে বিভ্রান্ত হতে পারে। একজন মানুষ একটা নির্দিষ্ট দেশের ফুটবল খেলার ভক্ত হতেই পারে; কিন্তু ঢালাওভাবে সেই দেশের ফ্ল্যাগ টানালে নিজের দেশকে একটুখানি হলেও অসম্মান করা হয়। অন্য সবকিছুকেই হালকাভাবে নেওয়া যায়; কিন্তু জাতীয় পতাকা বা জাতীয় সংগীতকে হালকাভাবে নেওয়া যায় না। মনে আছে, গতবারের ওয়ার্ল্ড কাপ খেলার সময় যশোরের ডিসি মাইকে ঘোষণা দিয়ে অন্য দেশের পতাকা নামিয়ে দিয়েছিলেন। আমার ধারণা, তারপরও যদি কেউ তার প্রিয় ফুটবল টিমের দেশটির পতাকা টানাতে চায়, তাহলে তার ওপর বাংলাদেশের একটি ফ্ল্যাগ টানিয়ে রাখতে পারে। কেউ স্বীকার করুক আর নাই করুক, জাতীয় সংগীত যে রকম শুধু কিছু শব্দ আর কিছু বাক্য নয়, আরো অনেক বড় কিছু; জাতীয় পতাকাও সে রকম শুধু সেলাই করা দুই টুকরো কাপড় নয়, আরো অনেক বড় কিছু। নিজের দেশের জাতীয় পতাকার প্রতি ভালোবাসা দেখানোর জন্য যশোরের সেই ডিসি এখনো আমার প্রিয় মানুষ রয়ে গেছেন।
যাই হোক, শুধু জাতীয় পতাকা নিয়ে বাড়াবাড়ির কথা বলার জন্য আমি আজকে লিখতে বসিনি, ওয়ার্ল্ড কাপের মৌসুমে আমার অন্য অভিজ্ঞতাটুকুও ভাগাভাগি করে নিতে পারি। এটা কেউ অস্বীকার করবে না যে খেলা দেখার সময় কেউ যদি কোনো একটা টিমকে সাপোর্ট করে, তবে খেলা উপভোগ করার আনন্দটুকু শতগুণ বেড়ে যায়।
তাই আমি দেখি, আমার আশপাশে যাঁরা আছেন, তাঁরা প্রায় সবাই কোনো না কোনো টিমের ভক্ত। আমি যেহেতু নির্দিষ্ট কোনো টিমের ভক্ত নই, তাই যদি কখনো খেলা দেখতে বসি, তাহলে অবধারিতভাবে দুর্বল টিমটির জন্য মায়া জন্মে যায়, তখন নিজের অজান্তেই মনে মনে সেই দুর্বল টিমটিকে সাপোর্ট করতে থাকি। দেখা যায় সাধারণত আমার সেই দুর্বল টিম খেলায় হেরে যায় এবং আমি আশাভঙ্গ নিয়ে ভগ্ন হৃদয়ে খেলা দেখা শেষ করি। টিমটির জন্য যত না দুঃখ হয়, তার চেয়ে শতগুণ বেশি দুঃখ হয় সেই টিমের সাপোর্টারদের জন্য। তাই আমার জন্য প্রায় সব খেলাই হচ্ছে মনে দুঃখ পাওয়ার খেলা। (এই বছর যেহেতু এখনো খেলা দেখিনি তাই, মনে দুঃখ পাওয়া এখনো শুরু হয়নি।)
তবে আমার চারপাশে যাঁরা আছেন এবং যাঁরা নিয়মিত খেলা দেখছেন, তাঁরা বলেছেন, এই বছর নাকি দুর্বল টিম আর শক্তিশালী টিম বলে কিছু নেই। ছোট-বড় সব টিমই নাকি অসাধারণ খেলা খেলছে এবং এই ওয়ার্ল্ড কাপ হচ্ছে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ওয়ার্ল্ড কাপ খেলা। কাজেই যে টিম হেরে যাচ্ছে মনে হচ্ছে, মায়াবশত তাকে সাপোর্ট করলে আশাভঙ্গ হওয়ার কারণ নেই, শেষ মুহূর্তে গোল দিয়ে তারাও নাকি হিসাব গোলমাল করে দিচ্ছে। আমার পরিচিত বোদ্ধা দর্শকদের কথা বিশ্বাস করে আমি হয়তো এক-দুটি খেলা দেখার চেষ্টা করতেও পারি, যদিও বলতে দ্বিধা নেই মূল খেলা থেকে দর্শকদের অভিব্যক্তি দেখতেই আমার অনেক বেশি মজা লাগে!
ওয়ার্ল্ড কাপ খেলা শুরু হওয়ার পর আমার পরিচিত বন্ধুবান্ধব যখনই একত্র হয়, তারা ফুটবল নিয়ে কথা বলে। আমি খুব আগ্রহ নিয়ে তাদের কথা শুনি, আমার কাছে ফুটবলের জন্য তাঁদের এই ভালোবাসার ব্যাপারটুকু অসাধারণ মনে হয়। লক্ষ করছি, সবাই সব খেলোয়াড়ের নাড়িনক্ষত্রের খবর রাখেন, কোন্ টিম কোন্ খেলায় কী করেছে তার খুঁটিনাটি তারা বিস্ময়কর রকম নিখুঁতভাবে বর্ণনা করেন। তাঁরা খেলা দেখে আনন্দ পান এবং আমি তাঁদের আনন্দ পাওয়া দেখে আনন্দ পাই।
এই দেশে সব টিমেরই ভক্ত খুঁজে পাওয়া যায়; তবে আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের ব্যাপারটা অন্য রকম। যারা এই টিম দুটির ভক্ত, কোনো একটি অজ্ঞাত কারণে তাদের মাঝে এক ধরনের রেষারেষি রয়েছে। আগে ভেবেছিলাম, এটি বুঝি শুধু আমাদের দেশের জন্য সত্যি। কিন্তু মিডিয়াতে দেখেছি, এটি পৃথিবীর সব দেশের সব ভক্তের জন্য সত্যি। শুধু নিজের টিমকে ভালোবাসলেই আনুগত্য পুরো হয় না, অন্য টিমকে রীতিমতো অপছন্দ করতে হয়। এই রেষারেষি যদি শুধু কৌতুকের পর্যায়ে থাকত, তাহলে বলার কিছু ছিল না। কিন্তু খবরের কাগজে দেখছি এই নিয়ে রীতিমতো মারামারি, এমনকি খুনোখুনি পর্যন্ত হয়ে যাচ্ছে। তার চাইতেও ভয়ংকর ব্যাপার ঘটে, যখন ফেভারিট টিম হেরে যাওয়ার পর কেউ আত্মহত্যা করে ফেলে। কী ভয়ানক! খেলাটি মানুষের আনন্দের জন্য, এটি যদি মানুষের মনকে বিষাক্ত করে দেয়, তাহলে কেমন করে হবে।
তবে সব সময় যে মনকে বিষাক্ত করে দেয়, তা নয়। খবরের কাগজে দেখেছি, জাপানের খেলোয়াড়রা যে রকম ভদ্র, তাদের দর্শকও সে রকম ভদ্র। জাপান এই ভদ্রতার কারণে পরবর্তী রাউন্ডে এসেছে এবং তাদের দর্শকও খেলার মাঠ থেকে বিদায় নেওয়ার আগে গ্যালারিটি ঝেড়েপুছে পরিষ্কার করে রেখে যাচ্ছে। শেষ মুহূর্তে নিজের টিম হেরে যাওয়ার পরও কেউ যদি আশাভঙ্গের বেদনা বুকে চেপে রেখে গ্যালারির নিজের অংশটুকু ঝেড়েপুছে আসতে পারে, সেটি খুব কম কথা নয়। সেদিন আমার একজন সহকর্মীর কাছে শুনেছি, মাছের বাজারে মাছ বিক্রেতা যখন জানতে পেরেছে যে আমার সহকর্মীটি মাছ বিক্রেতার মতোই আর্জেন্টিনার সমর্থক, তখন ঝপ করে মাছের দাম কমিয়ে দিয়েছে। কী মজা!
ক্যাম্পাসে আমার বাসাটি মেয়েদের হলের খুব কাছে। কোনো কারণে ছাত্রীরা হলে চেঁচামেচি করল, আমি বাসা থেকে শুনতে পাই। সেদিন আর্জেন্টিনা ও ফ্রান্সের মাঝে খেলা হচ্ছে, আমার বাসায় টেলিভিশন নেই, তাই খেলা দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু তাতে খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না, ছাত্রীদের চিৎকার থেকেই খেলার গতিবিধি টের পাচ্ছি। এর মাঝে একটা গগনবিদারী চিৎকার শুনে বুঝতে পারলাম আর্জেন্টিনা একটি গোল দিয়েছে। পুরো খেলার মাঝে আমি এ রকম তিন-তিনটি গগনবিদারী চিৎকার শুনে বুঝতে পারলাম, একটি বা দুটি নয়, আর্জেন্টিনা তিন-তিনটি গোল দিয়ে দিয়েছে। আমার স্ত্রী ঘুমিয়ে ছিল, ঘুম থেকে উঠে আমার কাছে জানতে চাইল খেলার কী খবর? আমি বললাম আর্জেন্টিনা জিতে গিয়েছে; একটি নয়, দুটি নয়, তিন-তিনটি গোল দিয়ে দিয়েছে। মেয়েদের চিৎকার শুনে টের পেয়েছি! একটু পর আমার স্ত্রী তার ল্যাপটপ চালু করে চমকে উঠে বলল, আর্জেন্টিনা নয়, ফ্রান্স জিতেছে। আর্জেন্টিনা তিনটি গোল দিয়েছে, ঠিক আছে। কিন্তু ফ্রান্স যে পাল্টা চারটি গোল দিয়েছে, সেটা টের পাওনি? বলা বাহুল্য, সেটি টের পাইনি। প্রতিবার আর্জেন্টিনা গোল খাওয়ার পর মেয়েরা যে পুরোপুরি নিঃশব্দে বসে থাকবে, সেটি কে জানত?
সেদিন একজন আমাকে জিজ্ঞেস করেছে, স্যার আপনি কি ব্রাজিল নাকি আর্জেন্টিনা? কোরবানি ঈদের সময়ও এভাবে জিজ্ঞেস করা হয়, আপনি কি গরু না খাসি? একজন মানুষ একটা দেশের সমর্থক হতে পারে, কিন্তু নিজেই দেশ হতে পারে কি না আমি সেই বিতর্কে গেলাম না। তাকে বললাম, আমি বাংলাদেশ!
মানুষটি ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। আমতা আমতা করে বলল, কিন্তু বাংলাদেশ তো ওয়ার্ল্ড কাপে খেলছে না। আমি বললাম, তাতে কী হয়েছে? একসময় বাংলাদেশ ক্রিকেট খেলাতেও ওয়ার্ল্ড কাপে খেলত না, তখন ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেছি। এখনো তাই।
কেউ হয়তো লক্ষও করেনি, ওয়ার্ল্ড কাপের উন্মাদনায় যখন সারা পৃথিবী উন্মত্ত, তখন আমাদের বাংলাদেশের মেয়েরা ক্রিকেট খেলায় আয়ারল্যান্ডকে হারিয়ে দিয়ে সিরিজ জিতে নিয়েছে। ওয়ার্ল্ড কাপের খবর দিতে ব্যস্ত খবরের কাগজগুলো। কিন্তু আমাদের দেশের মেয়েদের বিজয়ের খবরটুকু পর্যন্ত ঠিক করে দিয়েছে কি না, সন্দেহ আছে! একজন ওয়ার্ল্ড কাপে তার ফেভারিট টিম জিতে যাওয়ার পর যেটুকু আনন্দ পায়, আমি আমার বাংলাদেশের মেয়েদের টিম জিতে যাওয়ার পর সেই একই আনন্দ পাই! আনন্দ পাওয়ার জন্য সবাই খেলা দেখে, আমি যদি এভাবেই আনন্দ পাই, ক্ষতি কি?
জানি, সবাই আমাকে নিয়ে আড়ালে হাসাহাসি করে। করুক।
লেখক : অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।