নাজনীন মহল অঞ্জনা
সৈয়দ ইসমাইল হোসেন শিরাজী ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার মহান পুরুষ। তিনি ১৯৩১ সালের ১৭ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন। জন্মেছিলেন ১৮৮০ সালের ১৩ জুলাই সিরাজগঞ্জ শহরে, সম্ভ্রান্ত অবস্থাসম্পন্ন পরিবারে। পিতা সৈয়দ আবদুল করিম মাতা নুরজাহান খানম।
সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি শাখায় বিচরণ ছাড়াও উপ মহাদেশে প্রথম বাঙালি কারাদন্ডিত কবি শিরাজী, অনল প্রবাহ কাব্যগ্রন্থের জন্য বৃটিশ সরকার তাঁকে দু’বছর সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত করেন। শিরাজী ছিলেন সাংবাদিক, বাগ্মী, সৈনিক, রাজনীতিক, সমাজ সংস্কারক ও নারী জাগরণব্রতী। জাতীয় জাগরণ ও স্বাধীনতা আন্দোলনের অকুতোভয় এই দেশপ্রেমিক সম্পর্কে বিপিন চন্দ্র পাল বলেন, ‘স্বদেশী আন্দোলনের যুগে প্রাণবন্ত মুসলমানদের মধ্যে সৈয়দ ইসমাইল হোসেন শিরাজী সর্বাগ্রে গণ্য। এরূপ তেজস্বী পন্ডিত ও হৃদয়বান ব্যক্তি মুসলমান সমাজে আমি তো দ্বিতীয়টি আজ পর্যন্ত দেখি নাই। … দেশের মঙ্গলের জন্য সর্বরকম লাঞ্ছনা বরণ করার মত শক্তি তাঁহার ছিল। প্রাণময়ী বাগ্মিতা ও রাজনীতির ক্ষেত্রে দৃঢ় মতই তাঁহাকে স্মরণীয় করিয়া রাখিবে।’
শিরাজী ছিলেন মুসলিম পুনর্জাগরণের অগ্রদূত। ষড়যন্ত্রের বেড়াজালে আটকে পড়া পঞ্চাৎপদ মুসলমানের মৃতদেহে প্রাণ সঞ্চারে অতীত গৌরব, ঐতিহ্য, ইতিহাস উন্মোচন করে আত্মবিশ্বাস, আত্মমর্যাদাবোধ জাগাতে সঞ্জীবনী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। সেদিন শিরাজীর বজ্রকণ্ঠ আপামর সাধারণের প্রানে জাগিয়েছিল নব জাগরণের জোয়ার। কবি গবেষক আবদুল কাদির বলেন ‘কাজী নজরুল ইসলামের আর্বিভাবের পূর্বে সৈয়দ ইসমাইল হোসেন শিরাজীর উদাত্ত আহ্বানে বাঙালী মুসলমানের জীবনে জেগেছে সাড়া। বিংশ শতাব্দির ভীতসস্ত্রস্ত বাঙালী মুসলমানের কানে তিনি শুনিয়েছেন অভয় জীবন মন্ত্র। অজ্ঞানতা ও নৈরাশ্যের অন্ধকারে জ্বালিয়েছেন আশার অম্লান আলোক বর্তিকা’ নিজ ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া অন্য ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ নয়!
শিরাজী বলেন, ‘হিন্দু-মুসলিম তোরা দুটি ভাই/ তবে কেন বল রবি ঠাঁই ঠাঁই/আর্য বংশ হিন্দু সন্তান/ ভূবন বিজয়ী বীর মুসলমান/ উভয়ে আমরা একত্র হলে/ কার হেন সাধ্য এ ভব ম-লে/ এ হেন সাহস বল কার বুকে/ দাঁড়াইতে পারে মোদের সম্মুখে? ‘কলকাতা এলবার্ট হলে আহুত শোকসভায় নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু বলেন, ‘হিন্দু-মুসলমানের অন্তরে সমভাবে দেশপ্রেম সৃষ্টির কাছে যাহারা আমাদের পথ প্রদর্শন করিয়াছেন, নিঃসন্দেহে শিরাজী সাহেব তাঁহাদের অগ্রণী। … আপনি আচরি ধর্ম জীবেরে শিখায় এই কথাটি শিরাজী সাহেব সম্পর্কে নিখুঁতভবে খাটে’
আধুনিক ও প্রগতিশীল চিন্তাবিদ শিরাজী বলেন, ‘মুসলমানকে দক্ষিণ হস্তে কুরআন আর বাম হস্তে বিজ্ঞান গ্রহণ করিতে হইবে ‘বিজ্ঞান যে মানুষের সর্বাপেক্ষা আলোচ্য এবং আবশ্যকীয় বিষয়, বিজ্ঞানই যে অজ্ঞান মানবের উন্নতি, পথ প্রদর্শক, স্পেনীয় মোসলেমগণই এই মহা সত্য বর্বর ইউরোপীয় মস্তিস্কে প্রবিষ্ট করাইয়া দিয়াছিল…’। এই উদার, আধুনিক সংস্কারককে শ্রদ্ধা জানাতে হাবিবুল্লাহ বাহার বলেন, ‘জগতের চলমান জাতির সঙ্গে স্বদেশবাসীকে চালাইবার সাধনায় কি অপরিসীম সাধনাই না শিরাজী করিয়াছেন। সুদুর তুরস্কে যাইয়াও তাঁহার সুযশের কথা শুনিয়া আমাদের বুকের পাটা ফুলিয়া উঠিয়াছে। হিন্দু সমাজের বিবেকানন্দ, বঙ্কিম, সুরেন্দ্রনাথ প্রভৃতির জন্য যে গৌরব নির্ধারিত রহিয়াছে, আমাদের গর্বের কথা যে, শিরাজীর একক জীবনে জাতির জন্য সেই গৌরবের অমৃত ধারা সঞ্চিত রহিয়াছে। আমরা শিরাজী প্রতিভার মধ্যাহ্ন আলোকে আঁখি মেলিয়াছিলাম, তাই আমাদের অন্তরে দুর্বলতার সৃষ্টি হয় নাই, ইসমাইল হোসেন শিরাজী ছিলেন সত্যনিষ্ঠ, মানবতাবাদী, আপোষহীন, প্রতিবাদী, কুসংস্কারমুক্ত, উদার প্রগতিশীল ধর্মপ্রাণ মুসলমান। চারণ কবি মুকুন্দ দাস বলেন, ‘ধর্ম ও মঙ্গলের বার্তাবাহী রূপে এই মরজগতে দাদার (শিরাজী) সুভাগমন হইয়াছিল। হাজারীবাগ জেলে দীর্ঘ দেড় বছর দাদার চরণ সেবার সুযোগ পাই। … শুধু হিন্দু-মুসলমান নয়, সমস্ত বাঙালী জাতি তাহার নিকট ঋণী। … এমন চেহারা, এমন জ্ঞান, পান্ডিত্য, কবিত্ব, তেজঃবীর্য সাহস আর তো কাহারও দেখি নাই!… তিনি সঙ্গীতজ্ঞ ও সঙ্গীতপিপাসু ছিলেন। … সারাদেশ খুঁজিয়া দেখিলাম তাহার মত উদার প্রাণ হাতেম দেল, দাতাকর্ম আর একটিও নাই।… তাহার ঋণ কেমন করিয়া শোধ করিব?‘
শিরাজী ‘অনলপ্রবাহে‘ জাগরণের যে অনলোদগার করেছিলেন সেই গিরিমুখ থেকে নিঃসৃত স্ফুলিঙ্গেই বেজে উঠেছিল পরবর্তীতে বিদ্রোহী নজরুলের “অগ্নিবীণা”। নজরুল নিজেই বলেছেনÑ‘শিরাজী সাহেব ছিলেন আমার পিতৃতুল্য… তার সমগ্র জীবনই ছিল অনলপ্রবাহ, আমার রচনায় সেই অগ্নিফুলিঙ্গেরই প্রকাশ। শিরাজী স্বাধীনতা বন্দনা কবিতায় বলেন, মোর দক্ষিণ করে দীপ্ত কৃপাণ/বামে শোভিছে বিজয় নিশান, তিনি প্রাণদানে আহ্বান করেন “গো মেষ দুম্বা ছাগে করিলে কোরবাণী/পোহাবে না কভু এ দুঃখ রজনী/ বিধি যে নিষ্ঠুর শক্ত /চাহেরে তাদের রক্ত/ চাহে তিনি লক্ষ শিরা লক্ষ প্রাণ দান/ তবে পাবি স্বাধীনতা সুচির কল্যাণ।’
১৮৯৯ সালে ‘অনলপ্রবাহের উচ্চারিত সত্যেরই অর্জন ‘৪৭ এবং ‘৭১,র সূচির স্বাধীনতা শেরে বাংলা একে ফজলুল হক বলেছিলেন একদিন না একদিন এদেশ পরাধীনতার নাগপাশ হইতে মুক্ত হইবেই, সেইদিন ইসমাইল হোসেন শিরাজীর প্রতি জাতির কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সত্যিকার সুর্যোগ আসবে। তাই স্বাধীন দেশে মহান এই বিজয়ী বীরের যথার্থ মূল্যায়ন জাতির একান্ত কামনা।