আতাতুর্ক কামাল পাশা
মিজান রহমান একজন সিনিয়র সাংবাদিক। ঝুঁকি নিয়ে অনেক দায়িত্বপূর্ণ সংবাদ লেখেন তিনি। এ বইটির আগে তাঁর আর একটি বই বের হয়েছিল। বড় সংবাদ। বইটিতে বিশেষ দিনের বড় সংবাদ লিখতে গিয়ে কতটা কঠিন পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে এগুতে হয়, সংবাদের কোন দিকটি গুরুত্বপূর্ণ, এসব বিষয়ের ওপর আলোকপাত করেছেন।
এবার পুরো একটি সাহিত্য আমাদের হাতে তুলে দিলেন। উপন্যাস। স্বপ্নগুলো আকাশে উড়লো। মাত্র আশি পৃষ্ঠার একটি উপন্যাস, তবে ফন্টগুলো নিসন্দেহে বারোর উপরে হবে না।
খুব সাদামাটা গল্প নিয়ে এ উপন্যাস। পল্টু বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা ফারহা ম্যাডামের বেশ প্রিয় হয়ে ওঠে। পল্টুর বয়স মাত্র চৌদ্দ আর ফারহা ম্যাডামের বয়স পঁচিশ বছর। কিন্তু পল্টু মনে মনে ম্যাডামকে ভালবেসে ফেলে। ম্যাডাম বুঝতে পারে, মাঝে মাঝে পল্টুর অতিশয় আব্দারে সে নিজেও চমকে ওঠে, কিন্তু তবুও পল্টুর বাড়ি পর্যন্ত খবর নেয়। ওর বাবা নিতান্ত দিনমজুর, তার মা ও তাকে নিয়ে বস্তিতে থাকে। ফারহা পল্টুকে বড় মানুষ গড়ে তুলতে সবধরণের সহযোগিতা করে। তাদের সম্পর্ক হয়ে ওঠে বন্ধুত্বের। এ সময়ে পত্রিকায় চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার বিজ্ঞাপন প্রকাশ হয়। ফারহা পল্টুকে তাতে অংশগ্রহন করতে বলে, প্রতিযোগিতার জন্য ছবি আঁকতে প্রশিক্ষণ দিতে থাকে।
পল্টুর মা বাড়ির পাশে বড় লোকের ছেলে মিকিদের বাড়িতে কাজ করে। সেই মিকিকে ছবি আঁকতে প্রশিক্ষণ দিতে থাকে অন্য আর একজন শিক্ষক তন্ময়। পল্টুকে আর্ট একাডেমিতে পৌঁছে দিয়ে রেস্টুরেন্টে অপেক্ষা করার সময় ফারহা ও তন্ময়ের পরিচয় হয় এবং সখ্যতা গড়ে ওঠে দু’জনের। প্রতিযোগিতায় পল্টু প্রথম ও মিকি হয় তৃতীয়।
এ সময়গুলোতে ফারহা ও তন্ময়ের মধ্যে প্রেম আরো ঘনীভুত হতে থাকে। ক’দিন পর পল্টু ও মিকিকে জাপানে আন্তর্জাতিক ছবি আঁকা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তাদের নিয়ে যাবে ইউনিসেফ। দু’জনেরই ছবি আঁকা প্রশিক্ষণ, পাসপোর্ট, ভিসা এসব কাজ শেষ হলে তারা ফারাহ ও তন্ময়কে সাথে নিয়ে টোকিও যায়।
টোকিওতে ইউনিসেফ কর্মকর্তারা ফারাহকে তাদের অফিসে কাজ করতে বলে। তিন মাস সময় নিয়ে এসে ফারাহ তার এনজিওর অফিসে পদত্যাগপত্র দেয়। মাস্টার্স পরীক্ষা শেষে ফারাহ টোকিও চলে যায়। কিছুদিন পর ফারহা তন্ময়ের জন্য একটি কোম্পানিতে চাকরি যোগাড় করে তাকে জাপান আসতে কাগজপত্র পাঠায়। তন্ময় উড়োজাহজে উঠে বসে। আর এভাবেই, “তাদের স্বপ্নগুলো যার যার মতো করে আকাশে উড়লো।” (পৃ-৮০)।
. . . . যা হোক, ফারাহ জীবনের অনেকগুলো স্বপ্ন দেখেছিল এবং অনেকগুলো স্বপ্ন তার জীবনে পূরণ হয়েছে, এ হিসেবে উপন্যাসের নামকরণের সার্থকতা খুঁজে পাওয়া যায়। শুরুতেই বলা হয়েছে বেশ সাদামাটা গল্প। এ ধরণের উপন্যাস তো অনেকেই লেখে। কিন্তু কেন মিজান রহমান তাদের থেকে কিছুটা স্বকীয় হতে পারেন ?
প্রারম্ভে উল্লেখ করা হয়েছিল, মিজান রহমান একজন প্রবীণ সাংবাদিক, সুতরাং তার কাছে মজবুত লেখা আশা করা যায়। এ-ও উল্লেখ করা হয়েছিল, মাত্র আশি পৃষ্ঠার একটি উপন্যাস, তবে ফন্টগুলো নিঃসন্দেহে বারো। এ কারণে যে লেখক একজন সাংবাদিক, তার উপন্যাসে অধিকাংশ বর্ণনা, অধিকাংশ কথা বা যুক্তি খুব সাবলিলভাবে বাস্তবতার fabrication-য়ে লেখা হবে, সেটাই দেখা গেছে।
“তন্ময় প্রতিদিন মিকির বাসায় এসে মিকিকে পড়িয়ে যান। মিকি দামী চেয়ার টেবিলে বসে পড়াশোনা করে। ভালো ভালো বই-খাতা ব্যবহার করে আর কলমটাও বেশ দামি। মিকির যে কলম, এই কলমটার যে দাম, সেই টাকা দিয়ে পল্টুদের এক মাসের ভালোভাবে সংসার খরচ চলে যাবে। মিকির বাবা, মিকির টিচার তন্ময়কে যে বেতন দেন সেটি দিয়ে পল্টুদের মতো এক পরিবারের এক মাসের ভরণপোষণের ব্যবস্থা হয়ে যায়।” (পৃ-১৫)। এমন ধরণের সহজ অথচ গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচিত কিছু শব্দকুঞ্জ দিয়ে, সামান্য কিছু বাক্য ব্যবহার করে তিনি একই সাথে দুটি পরিবারের এমনকি তিনটি পরিবারের ইনফরমেশন দিতে পেরেছেন বেশ স্বল্পায়তনে। কখনো কখনো মিজান রহমানের ম্যাটেরিয়ালিস্টিক ইনফরমেশান আরো সহজ ও সুসংহত হয়েছে।
“আবার ফারহা বলল- যদি কখনো মিথ্যাটাকে সত্যি করা সম্ভব হয়- তো সেদিন করব। আর যদি বন্ধু হিসেবে আমাকে তোমার প্রয়োজন হয়- তবে সংকোচ করো না। যতটুকু সম্ভব হয় ততটুকু তোমার জন্য সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেব।” এ যৌক্তিক বাক্যে (proposition) জীবনের বিভিন্ন সময়ের রিয়েলিস্টিক বাস্তবতা ঔপন্যাসিক মিজান রহমান বেশ সুন্দরভাবে সেলাই করতে পেরেছেন। এ কারণে উপন্যাসটি পাঠ করতে কোনো monotony আসে না।
কিন্তু তাই বলে তার যে কিছু childlike কথন বেরিয়ে আসেনি এমনটা নয় কিন্তু। এমনকি তা আমার বিরক্তির মতো মনে হয়েছে। যেমন, “পল্টুর আর অনেক দূরে যাওয়া হলো না। -কথায় বলে না রাখে আল্লাহ মারে কে? ট্রেন পল্টুকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেল।” এখানে ‘-কথায় বলে না রাখে আল্লাহ মারে কে?’ ঔপন্যাসিকের নিজস্ব একটি কমেন্ট দেয়া হয়েছে যা উপন্যাসের গাম্ভীর্য অনেকখানি কমিয়ে আনে।
“আর ঠান্ডা চা-টা গফ করে পানির মতো গিলে খেলেন। তন্ময় ফারহানাকে দেখে পুরো দিওয়ানা হয়ে গেছেন।” (পৃ-৩৮), “-সোনার চাঁন আমি জামে আট্কা একটু দেরি করো।” (পৃ-৬৩), ইত্যাদি। এ বাক্যগুলো যদি উপন্যাসটির পোস্টমডার্ন চিত্র ফুটিয়ে তোলার কাজ করে তাহলে বলার কিছু নেই, তবে কোন লেখকের দ্বিতীয় গ্রন্থটি যখন পাঠক পড়বেন, তখন তারা লেখকের ম্যাটেরিয়ালিস্টিক রিয়েলিটিকে অবশ্যই খতিয়ে দেখবেন।
তবুও উপন্যাসটি এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলা যায়। এটিই বা কম কি! মুদ্রণ প্রচ্ছদ বাঁধাই মোটামুটি।
স্বপ্নগুলো আকাশে উড়লো : মিজান রহমান
প্রকাশক : দোয়েল, সিদ্ধেশ্বরি, ঢাকা
প্রচ্ছদ : দোয়েল
প্রকাশ : একুশে বইমেলা, ২০১৮
মূল্য : ২০০ টাকা