শাহ মতিন টিপু ॥ বাংলাদেশের প্রবন্ধ, গবেষণা ও কথাসাহিত্যে বিশেষ অবদান রাখার জন্য এ বছর ‘অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার-১৪২৫’-এ ভূষিত হলেন লেখক-গবেষক ড. আকিমুন রহমান।
ড. আকিমুন রহমানের জন্ম নারায়ণগঞ্জে, ১৯৬০ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে পিএইচডি করেছেন বহুমাত্রিক লেখক ড. হুমায়ুন আজাদের তত্ত্ববধানে। গবেষণাপত্রটি ‘আধুনিক বাংলা উপন্যাসে বাস্তবতার স্বরূপ (১৯২০-’৫০)’ নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় বাংলা একাডেমি থেকে।
তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহের মধ্যে রয়েছে: বিবি থেকে বেগম, আধুনিক বাংলা উপন্যাসে বাস্তবতার স্বরূপ, সোনার খড়কুটো, পুরুষের পৃথিবীতে এক মেয়ে, রক্তপুঁজে গেঁথে যাওযা মাছি, এইসব নিভৃত কুহক, জীবনের পুরোনো বৃত্তান্ত, নিরন্তর পুরুষ ভাবনা, পৌরাণিক পুরুষ, বাংলা সাহিত্যে বাস্তবতার দলিল (১৩১৮-১৩৫০ বঙ্গাব্দ), সাক্ষী কেবল চৈত্রমাসের দিন আদিপর্ব, যখন ঘাসেরা আমার বড়, অচীন আলোকুমার ও নগণ্য মানবী ইত্যাদি। লেখালেখির পাশাপাশি বর্তমানে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনারত।
অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে আকিমুন রহমান বলেন, সাধনার বিকল্প কিছু নেই একজন লেখকের জন্য। পৃথিবীতে যদি প্রকৃতি বা রাজনীতি বা সমাজনীতি পড়ার বিষয় হয়, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাঠের বিষয় হলো পুরুষ। পুরুষকে ধর্ম, পুরাণ ও তার নির্মিত সমাজ থেকে পাঠ নিতে হয়। আমার সাহিত্যদৃষ্টি সেই পাঠের দিকেই প্রসারিত।
পুরস্কার প্রদান-পর্বে আকিমুন রহমানের হাতে সনদ তুলে দেন কবি আসাদ চৌধুরী, উত্তরীয় পরিয়ে দেন অধ্যাপক বেগম আকতার কামাল ও অতিথিদের নিয়ে ১ লক্ষ টাকার চেক ও ক্রেস্ট তুলে দেন অনন্যা-সম্পাদক তাসমিমা হোসেন।
পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি আসাদ চৌধুরী বলেন, আমাদের দেশে প্রাচীন কাল থেকে এ পর্যন্ত সমাজ, মানুষ, দেশ সম্পর্কে চমৎকার সৃষ্টি আমাদের উপহার দিয়েছেন আকিমুন রহমান। তাঁর অনুসন্ধান এক জায়গায় সীমিত না। চিন্তার অনেকগুলো দরজা তিনি খুলে দেন।
বিশেষ অতিথি বেগম আকতার কামাল বলেন, আকিমুন রহমান যথার্থ লেখক হিসেবে অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার পেলেন। তিনি দায়িত্ব নিয়ে সমাজবাস্তবতার নানাদিক নিয়ে লেখেন। আকিমুন পুরাণমনষ্ক মানুষ, তবে তিনি পুরাণের পুরুষ নির্মিতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তাঁর লেখায়। চাঁদের অন্ধকার দিকটা তাঁর সাহিত্য-অন্বেষণের বিষয়। ধর্ম, সমাজ ও পুরুষ নির্মিত সিস্টেমে যে নারী, তাঁকে আকিমুন রহমান নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে চেয়েছেন তাঁর গল্প-উপন্যাস, প্রবন্ধ ও গবেষণায়। তাঁর বইগুলো আমাদের দৃষ্টি খুলে দেয়।
অনুষ্ঠানে সভাপতি তাসমিমা হোসেন বলেন, অনন্যা সাহিত্যপুরস্কার দেওয়া হচ্ছে যে কারণে, নারীদের মধ্য থেকে সত্যিকার শিল্পীসত্তা আবিষ্কার ও মূল্যায়ণ করা, সেটা সম্পূর্ণভাবে এবার অনন্যা করতে পেরেছেন বলে আমি মনে করি। নারী লেখকদের জন্য প্লাটফর্ম তৈরি করার লক্ষ্য নিয়ে আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে এই পুরস্কার প্রবর্তন করা হয়। আজ আর পেছন ফিরে তাকাতে চাই না, আমি আগামীর দিকে তাকিয়ে, যে মেয়েরা লিখতে আসছেন, সমাজ ভাঙতে আসছেন তাদের জন্য এই পুরস্কারকে চালু রাখতে চাই।
উল্লেখ্য, বাংলা ১৪০১ সন (১৯৯৩ সাল) থেকে অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার প্রবর্তন করা হয়েছে। প্রতিবছর একজন নারী-সাহিত্যিককে সাহিত্যে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ এ পুরস্কার প্রদান করা হয়। এ-পর্যন্ত যাঁরা এই পুরস্কার পেয়েছেন, তাঁরা হলেন সেলিনা হোসেন, রিজিয়া রহমান, নীলিমা ইব্রাহিম, দিলারা হাশেম, রাবেয়া খাতুন, সন্জীদা খাতুন, শহিদ জননী জাহানারা ইমাম (মরণোত্তর), নূরজাহান বেগম, রাজিয়া খান, রুবী রহমান, পূরবী বসু, আনোয়ারা সৈয়দ হক, মকবুলা মনজুর, ঝর্ণাদাশ পুরকায়স্থ, সালেহা চৌধুরী, নূরজাহান বোস, মালেকা বেগম, কাজী রোজী, নিয়াজ জামান, জাহানারা নওশিন, সোনিয়া নিশাত আমিন, বেগম আকতার কামাল ও বেগম মুশতারী শফি।
৫ জানুয়ারি বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে আনুষ্ঠানিকভাবে ড. আকিমুন রহমানকে এই পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন কবি আসাদ চৌধুরী ও বিশেষ অতিথি প্রাবন্ধিক অধ্যাপক বেগম আকতার কামাল। সভাপতিত্ব করেন অনন্যা সম্পাদক তাসমিমা হোসেন।
উপস্থাপনা করেন কথাশিল্পী ঝর্না রহমান।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই পুরস্কৃত লেখকের উপর নির্মিত তথ্যচিত্র প্রদর্শিত হয়। তথ্যচিত্রটি নির্মাণ করেন চলচ্চিত্র পরিচালক লেখক তাপস কুমার দত্ত অদ্বয়।
তথ্যচিত্রটি দেখুন :