মো. হারুন অর রশিদ
মহান ২১ ফেব্রুয়ারি। ভাষা শহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। জাতীয় ইতিহাসের এই দিনটি একদিকে স্মরণের অন্যদিকে উজ্জীবিত হওয়ার। আমাদের জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, একুশের চেতনা ও স্বাধীনতার চার মূল স্তম্ভকে যারা অস্বীকার করে, তারা একুশের শত্রু, স্বাধীনতার শত্রু। এদের মোকাবিলা করার জন্য আমাদের নতুন প্রজন্মের মধ্যে একুশের চেতনা ছড়িয়ে দিতে হবে। তিনি স্বাধীনতার শত্রুদের মোকাবিলায় নতুন প্রজন্মের মধ্যে একুশের চেতনা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন।
একুশ আমাদের শিখিয়েছে মাথা নত না করা। একুশ আমাদের শিখিয়েছে কীভাবে নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করা যায়, নিজের মাতৃভাষাকে রক্ষা করা যায়। সাথে সাথে নিজের সংস্কৃতি, শিক্ষা, ঐতিহ্য সবকিছুকেই রক্ষা করা ও তার মর্যাদা দেয়া যায়। আসুন, আমাদের মাতৃভূমিকে আমরা গড়ে তুলি। আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের ঐতিহ্য নিয়ে বিশ্বে যেন অনন্য মর্যাদা নিয়ে চলতে পারি। স্বপ্নের ক্ষুধামুক্ত দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা দেশ গড়তে পারি।
বাংলার মায়ের ভাষাকে ছিনিয়ে আনার জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা। মাতৃভাষা বাংলার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দাবিতে ‘৫২ সালের মহান ২১ ফেব্রুয়ারির এই দিনে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার প্রমুখ আত্মোৎসর্গ করেছিলেন। তাদের সে আত্মদানের কথা আজ সারা বিশ্বে স্বীকৃতি লাভ করেছে। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের স্বীকৃতির ফলে কার্যত ভাষা শহীদরাও বিশ্বব্যাপী সম্মান ও স্বীকৃতি লাভ করেছেন।
১৯৫২ সালের সেই ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের ভেতর দিয়ে বাঙালি জাতিসত্তায় জন্ম নিয়েছিল একুশের চেতনা। পরবর্তী প্রতিটি গণআন্দোলনের চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে ভাষা আন্দোলন। এই আন্দোলনের ভেতর দিয়ে সেদিন পূর্ব বাংলার অধিকার-বঞ্চিত মানুষের প্রথম সংগঠিত সংগ্রামের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল। পরবর্তীকালে প্রতিটি গণআন্দোলনের প্রেরণাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে ওই আন্দোলন।
একুশের চেতনার তাৎপর্য বহুমুখী। প্রথমত, বাঙালির জাতীয় চেতনাকে একুশ দিয়েছে স্ফটিকস্বচ্ছতা। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা বাঙালির ওপর যে জাতিগত শোষণ ও নিপীড়ন চালিয়েছিল তার বিরুদ্ধে জাতীয় চেতনায় সংগঠিত হতে একুশ আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছে। আমাদের সচেতন, সক্রিয় ও প্রাণিত করেছে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক চেতনায়। একুশের চেতনা ক্রমেই পরিণতি লাভ করেছিল স্বাধীনতার চেতনায়। সেই চেতনা আমাদের এই মর্মে সচেতন করেছে যে, আমরা বাঙালি। আমরা জেনেছি, বাংলা ভাষা আমাদের অস্তিত্বের অঙ্গীকার, বাংলাদেশ আমাদের দেশ।
একুশের ফসল আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর অনন্য গান : ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?’। এ গান আমাদের চেতনার বিকাশে উজ্জীবনী মন্ত্রের প্রেরণা। বায়ান্নের মহান ভাষা আন্দোলনের হাত ধরে অর্জিত একুশে ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের গৌরবের পতাকা ওড়াচ্ছে বিশ্বময়।
যেকোনও জাতির জন্য তার মাতৃভাষা নিঃসন্দেহে বিশাল গুরুত্ব বহন করে। মাতৃভাষার জন্য আমাদের ভালবাসার অনেক। প্রতিবছর একুশ এলে হাতে হাতে শ্রদ্ধার ফুল আর শোকের কালো পোশাকে সে ভালবাসা দেখতে পাই। তবে শোক ও শ্রদ্ধার এই বন্ধনকে আমরা সারা বছর লালন করিনা। শহরের বাংলা ভাষি অনেক মা-বাবারাই আজ ঘরে শিশুর ইংরেজি বলার দক্ষতা বাড়াতে বাংলার বদলে অনবরত ইংরেজি বলে যাচ্ছে। তাই এই শিশুর কাছে আমাদের জাতীয় ফল কাঁঠাল হয়ে উঠছে জ্যাকফ্রুট। বাংলা ভাষা আজ তাই এফএম বেতার ও টিভিসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রভাবে হিন্দি, উর্দু, ইংরেজি মিলিয়ে মিশ্র একটি ভাষারূপ অর্জনের পথে অনেকদূর অগ্রসর হয়েছে। কেউ কেউ এর নতুন নামকরণের বিষয়ও উল্লেখ করেছেন। বাংলা ভাষার মর্যাদার জন্য এটা খুব সুখকর নয় তা বলাই বাহুল্য। ভাষা তার স্বাভাবিক নিয়মেই পরিবর্তিত হবে, কিন্তু জোর করে বা চাপিয়ে দেয়া মেনে নেয়া যায় না।
বিশ্ববাজারের দ্রুত সম্প্রসারণ অথবা মুক্ত বাজার অর্থনীতির টাইফুন ঝড়ে আজ দেশীয় ঝালমুড়ি, চানাচুরের মোড়কগুলোও পাল্টে গেছে। দেশি ফলের গন্ধ ও স্বাদের সাথে যুক্ত হয়েছে- ম্যাঙ্গো ফ্লেবার। ইংরেজি নাম ছাড়া যেন মুখে স্বাদ লাগবেনা। আমাদের অহেতুক বিদেশি ভাষা প্রীতির কারণে আজ বাংলা নামের খাদ্য মানেই অখাদ্য যেন। সরকারি অফিস আদালত, বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, হোটেল রেস্তোরাঁ সবখানেই বাংলা হরফে ইংরেজি অথবা ইংরেজি হরফে বাংলা লেখা। ক্রমাগত বাড়ছে এই প্রবণতা। টিভি নাটক, চলচিত্রের নামকরণেও আজ ইংরেজির আধিপত্য। অথচ শুধু ফেব্রুয়ারি এলেই শুরু হয় আমাদের ভাষাপ্রেম।
এ কথাও সঠিক যে একুশের ওপর প্রভাবমুক্ত বেশ কিছু সময় এ দেশের রাজনীতি মোটামুটি সঠিক পথ ধরেই চলেছে। আর তারুণ্যে বা অন্যত্র ‘একুশ আমার গর্ব, একুশ আমার অহংকার’ এমন বাহ্যিক উচ্চারণই প্রধান হয়ে থাকে। সশস্ত্র যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবর্বরতার বিরুদ্ধে বিজয়ে অর্জিত বাংলাদেশে ধর্মীয় রক্ষণশীলতা ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অবাঞ্ছিত প্রকাশ, যা কখনো কখনো নানা অজুহাতে সহিংসতারও প্রকাশ ঘটায়, উগ্র ধর্মীয় জঙ্গিবাদের প্রচারণা চালায়, সঙ্গে নাশকতা, বোমাবাজি। আর সেই সঙ্গে নানামাত্রিক নাশকতা।
একাত্তরের সংগ্রাম যে জাতিরাষ্ট্রের প্রত্যয় তুলে ধরেছিল, তা এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। তাই একুশের চেতনা, একাত্তরের চেতনা, উনসত্তরের গণজাগরণের ঢেউ সত্তে¡ও স্বাধীন বাংলাদেশে ফসলের পরিপুষ্টি নিয়ে বিস্তার লাভ করেনি। একাত্তরে সংঘটিত গণহত্যা ও নারী নির্যাতনের পাশবিকতা আমরা এত সহজে ভুলে যেতে বসেছি।
একুশ এবং মহান ভাষা আন্দোলন আমাদের সাহসী হতে শেখায়, ঔপনিবেশিক ও জান্তা শক্তিগুলোর অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে শেখায়। একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তার অবিসংবাদিত নেতৃত্বেই আমরা পেয়েছি একটি মুক্ত-স্বাধীন দেশ, বাংলাদেশ। প্রিয় এই বাংলাদেশ এখন আর ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ নেই, এটি বরং সম্পদে পরিপূর্ণ একটি বিস্ময়কর ঝুড়ি। আমাদের মানুষ আমাদের অন্যতম সম্পদ।
ভাষার জন্য জীবন দিয়ে বিশ্বে ইতিহাস সৃষ্টি করেছি আমরা। প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি এলেই সবার প্রাণে স্পন্দন আসে শহীদদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য। কিন্তু এই সম্মান শুধু বাহ্যিকভাবে প্রদর্শন না করে আত্মিক অনুভবের জাগরণ ঘটাতে হবে। এই চেতনা শুধু ভাষার মাসেই ধারণ করলে চলবে না। মনে-প্রাণে লালন পালন করতে হবে। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার্থে সচেষ্ট থাকতে হবে।
লেখক: রাজনীতিক, বেগমগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য।