বিশ্বসভায় রবীন্দ্রনাথ

ফাইজুস সালেহীন
১৯৩৫ সালে সাপ্তাহিক নাগরিক পত্রিকার জন্যে লেখা চেয়ে রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লিখলেন কাজী নজরুল ইসলাম। ক’দিন বাদে ডাকে এলো নজরুলকে লেখা কবিগুরুর উত্তর। রবি কবির সেই চিঠি পড়ে আবেগাপ্লুত নজরুল লিখে ফেললেন তীর্থপথিক শিরোনামে দারুন এক কবিতা। কবিতাটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি। বিশ্বকবির উদ্দেশে রচিত সেই কবিতার মাঝখান থেকে কয়েকটি লাইন;
” তুমি নন্দন কল্পতরু যে, তুমি অক্ষয় বট;
বিশ্ব জুড়ায়ে রয়েছে তোমার শত কীর্তির জট।
তোমার শাখায় বেঁধেছে কুলায় নভোচারি কত পাখি
তোমার স্নিগ্ধ শীতল ছায়ায় জুড়াই ক্লান্ত অাখি।”
এই কবিতায় রবীন্দ্রনাথকে নজরুল কল্পনা করেন বিশাল এক বটবৃক্ষরূপে। এই মহীরুহের শাখায় বাসা বাঁধে অসংখ্য পাখি। এখানে পাখি বলতে তাঁদের কথা বলা হয়েছে, যারা রবীন্দ্রনাথকে আত্মস্থ করে শিল্প সাহিত্যের ভুবনে যুক্ত করেন নব-নতুন মাত্রা।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে বাঙালির জীবনে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব অতুলনীয়, বলা যায় অমোচনীয়। কিন্তু কেন?
এর কারণ নিহিত রয়েছে রবি কবির মানসভূমিতে। কবির মনের এই জমিনটি এমনভাবে তৈরি হয়েছে যা অবলীলায় ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালি মননে সঞ্চারিত করেছে এক অবিমিশ্র বেগবান ধারা। এই বিষয়ে সহজ একটি ব্যাখা পাওয়া যায় জেমস জে নোভাকের লেখায়।
Bangladesh : Reflections On The Water এই লেখকের এক অতলস্পর্শী গবেষণাগ্রন্থ। বাঙালির মন ও মননের পরিচয় তুলে ধরতে খুবই প্রাসঙ্গিকভাবে তিনি আলোক সম্পাত করেন রবীন্দ্রলোকে । তিনি বলছেন, মুসলমানের ভ্রাতৃত্ববোধ, তার আধ্যাত্মচেতনা, শ্রী চৈতন্য এবং কবীরের ভক্তিবাদের নির্যাস নিয়ে গঠিত এই ঋষি কবির মনোজগৎ। সহজাত প্রতিভা, কাণ্ডজ্ঞান এবং ঈশ্বর সচেতনতা রবীন্দ্রনাথকে পৌঁছে দেয় এক অনন্য উচ্চতায়। ইংরেজি ভাষায় তাঁর অাধ্যাত্ম চেতনাঋদ্ধ কাব্যগ্রন্থ গীতাঞ্জলীর(Song Offerings) আংশিক অনুবাদ প্রকাশিত হলে তিনি নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন।
নোভাকের বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৯৩ সালে। তার আশি বছর অাগে ইংরেজি গদ্যে গীতাঞ্জলীর অনুবাদ পড়ে বিমোহিত কবি ডব্লিউ বি ইয়েটস উইলিয়াম রথেনস্টাইনকে লেখা চিঠিতেও রবীন্দ্রনাথের স্রষ্টায় সমর্পণ ও ধ্যানমগ্নতা ব্যাখ্যা করেন। তিনি অাবিষ্কার করেন এই বাঙালি কবির অাধ্যাত্মচেতনার নান্দনিক তাৎপর্য।
এ প্রসঙ্গে বলা বাঞ্ছনীয় যে ইংরেজি গদ্যে গীতাঞ্জলির অনুবাদ না হলে রবীন্দ্রালো বিশ্বসভায় পৌঁছাতে হয়তো আরও কিছুটা সময় লাগতো। আর,বিশ্বলোকে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যাওয়ার অনুঘটক শিল্পী রথেনস্টাইন, এ কথা প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়।
উইলিয়াম রথেনস্টাইনের সাথে রবীন্দ্রনাথের দেখা না হলে এই মহান কবির নোবেল প্রাপ্তি বিলম্বিত হতে পারতো। সাহিত্যের বিশ্বসভায় তাঁর অভিষেকের ইতিহাসটাও হয়ে যেতে পারতো অন্যরকম। এ বিষয়ে অবনীন্দ্রনাথের মেয়ের ঘরের নাতি মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের বর্ণনা থেকে জানা যায়, ইংল্যান্ডের সেই সময়ের বরেণ্য চিত্রকর ও লেখক স্যার উইলিয়াম রথেনস্টাইন হঠাৎ একদিন এসে উপস্থিত জোড়াসাঁকোর বাড়িতে। উদ্দেশ্য, গগনেন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথের অাঁকা ছবি দেখা। কবি তখন ছিলেন পাশের বাড়িতে। তাঁকেও খবর দিয়ে আনা হলো। পরিচয় হলো। রথেনস্টাইন যখন জানলেন যে, ইনি বাংলার অনেক বড় কবি, তখন তিনি দুঃখ করে বললেন, আমি তো বাংলা জানি না, তোমার কবিতার স্বাদ নেবো কেমন করে? তবে দুজনের মধ্যে আলাপ জমেছিলো খুব। রথেনস্টাইন স্বদেশে যাবার পর চিঠিতে দুজনের যোগাযোগ হতো নিয়মিত। এরই মধ্যে রবীন্দ্রনাথ নিজেই ইংরেজিতে অনুবাদ করে ফেললেন গীতাঞ্জলির একশটি কবিতা। তার কিছুদিন পর কবি ইংল্যান্ড গেলেন। দেখা হলো আবার দুই বন্ধুতে। রথেনস্টাইন নিজের ভাষায় রবি ঠাকুরের কবিতা পড়ে বিমুগ্ধ। তিনি কবিতার খাতাটি পড়তে দিলেন কবি ইয়েটসকে। তিনিও পড়ে চমৎকৃত। পরে ইংরেজ কবি- সাহিত্যিকদের এক আড্ডায় রবীন্দ্রনাথ পড়ে শোনালেন কয়েকটি কবিতা। বাহ বা দিলেন সবাই। তারপরেই বই হয়ে বেরুলো গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ।
মোহনলাল গঙ্গপাধ্যায়ের ভাষায়, ‘তারই ফলে ঘটল কত্তাবাবার কপালে নোবেল প্রাইজ প্রাপ্তি।’
২৫ বৈশাখ এই মহান ঋষি কবির জন্মজয়ন্তী। আজকের এই দিনে সমর্পিত কবির স্মৃতির প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা। কামনা করি তাঁর পুণ্যাত্মার চির প্রশান্তি।
# মোহনলাল কবিকে কত্তাবাবা বলে ডাকতেন।
* William Rothenstein বাংলায় উইলিয়াম রোদেনস্টাইন বা রদেনস্টাইনও উচ্চারণ করা হয়। মোহনলাল রথেনস্টাইন লিখেছেন।

 

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts