সৌমিত বসু
বাংলা কবিতায় আটের দশক সম্ভবত সবচেয়ে স্পর্ধার দশক। এই সময়ের কবিরা বাংলা কবিতার প্রচলিত ভাবনাগুলির ভিতর সাধ্যমত ভাংচুর করেছেন। সে ছন্দ বিন্যাস বা চিত্রকল্প সর্বক্ষেত্রে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শিল্প সাহিত্যের বিভিন্ন আন্দোলন পর্বে কবি শিল্পীরা কমবেশি গোষ্ঠীবদ্ধ। বিশেষ মতবাদ প্রতিষ্ঠা কিংবা আঙ্গিকের নবতম প্রবর্তনার জন্য গোষ্ঠীবাদ অনিবার্য। বাংলা কবিতায় পঞ্চাশের কবিরা যথার্থ গোষ্ঠীবাদের প্রবর্তক। এবং তা সদর্থক অর্থে অর্থাৎ পরস্পরের পাশে দাঁড়ানো।
ষাটের দশকে কয়েকটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠী গড়ে উঠলেও সেগুলোর একাত্মতা ছিলো স্বল্পকালীন। সাধারণভাবে দশকটি ছিলো পরস্পর বিচ্ছিন্ন অসহিষ্ণু এবং নির্বান্ধব। কারণ হিসেবে এই সমস্ত কবিদের শৈশবে স্বাধীনতা আসে। তাদের ভিতর স্বাধীনতার উত্তেজনা কিংবা রোমাঞ্চ ছিলো না। তারা দেখেছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দেশ বিভাগ, ছিন্নমূল মানুষ, সুবিধাবাদের রাজনীতি, মূল্যবোধের মৃত্যু এবং হারিয়ে ফেলা বিশ্বাস। ফলশ্রুতি অনুযায়ী তারা বিছিন্ন।
৭০ এর কবিদের ভেতর প্রত্যক্ষ ছাপ পড়ে পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সংগ্রাম। চাকরিহীনতা ও নিরাপত্তাহীনতা ছিলো এই সময়ের কবিদের সবচেয়ে বড় সমস্যা। ফলে অধিকাংশ কবির কবিতায় উঠে এসেছে দেশপ্রেম, সমাজ ও রাজনৈতিক মনস্কতা। অবচেতন মানসের কবিতা। ঠিক এই সময় আটের দশকের কবিদের আবির্ভাব। সত্তরের কবিদের ভেতর সংঘবদ্ধতার যে চেরো স্রোত বইছিলো সেই প্রবনতা তীব্র আকার নিলো আটের দশকের কবিদের ভেতর। তৃতীয় বিশ্বে তখন গণতন্ত্রের প্রকৃত পচন শুরু হয়ে গেছে। অর্থ হয়ে উঠেছে সর্ব নিয়ন্ত্রক। আখের গুছিয়ে নিচ্ছেন বুদ্ধিমানেরা আর কিছু বিবেকবান অন্যায় ভাবে শুধু দেখছে এইসব। তাই প্রয়োজনার্থেই হয়তো এই দশকের কবিরা সংঘবদ্ধ। বিভিন্ন সামাজিক প্রক্রিয়া উচ্চকণ্ঠ, নতুন সমাজ নির্মানের জন্য কিংবা নিজের বিশ্বাস, চিন্তা ও উপলব্ধি অন্যের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে। একটি চূড়ান্ত অবক্ষয়ের সামনে দাঁড়িয়ে এই দশকের কবিরা অস্ত্র হিসেবে হাতে তুলে নিলেন ব্যাঙ্গ এবং প্রতিবাদ। বিক্ষুব্ধ এই কবিদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য চরিত্র হলো সম্মান সচেতনতা।
এই প্রথম দুই বাংলার প্রায় পাঁচশো কবি লিখতে এলেন-যাদের প্রত্যেকের হাতে একটি করে সম্পাদিত পত্রিকা। তাই হয়তো এই প্রজন্ম হার স্বীকার না করার কৌশল গোপনে রপ্ত করে ফেলেন এবং অগ্রজ স্তুতির যে ধাপ বাংলা কবিতায় প্রচলিত ছিলো তার সামনে প্রাচীর হয়ে ওঠেন। আসলে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার গল্প যতো পছন্দের হোক না কেন ক্ষমতাবান অগ্রজ কিংবা ঈশ্বরও তাতে অপছন্দতা লেপে দেন। তাই বানিজ্যিক পত্রপত্রিকা বা সরকারি পুরস্কারের তালিকায় আশির কবিদের সংযুক্তি এতো কম। এটাই ভবিতব্য।
ভবিতব্য নিয়ে হাতজোড় করে বসে থাকার পাত্র এই দশকের কবিরা ছিলেন না। ক্রমাগত উপেক্ষার সুঁইয়ে ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত কবিরা নিজেরাই পরস্পরকে দিলেন লেজে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে চাঁদ খাবার প্রস্তাব। ফলে নিজের কথা নিজের মতো করে বলার একদল কবির জন্ম হলো বাংলা কবিতায়। আর তাদের ভিতর থেকে যে তরুণটি বাংলা কবিতার সেই সময়ের মারাদোনা হয়ে ওঠার সম্ভাবনা নিয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠলেন তিনি কবি শাহীন রেজা। কবিতা যার কলমে কথা বলে। কি লিখতে হবে তার চেয়ে অনেক বেশী গুরুত্ব দেন তিনি কোথায় থামতে হবে। ‘এই চোখ দীঘি হয়ে যায়’ জলপূর্ণ কবিতায় যেন দ্বীপের মতন জেগে থাকে। খুব সুচারুভাবে, অসীম সতর্কতায়, অতি সাধারণ প্রক্রিয়ায় ব্যবহার করেন, ‘শূন্যতায়’। এ অনেক সাধনার ফল। সর্বোপরি ‘দীঘি হয়ে যায়’ বলে থেমে যাওয়া। আমরাও হাত পা গুটিয়ে স্থির হয়ে বসি।
কবিতাটির একেবারে শেষপ্রান্তে তার উচ্চারণ-
‘আমি এখন কেবলি ধূসর আঁকি, ভেজাই শরীর অফুরান ঘাসজলে।
একটি আধূলি সিকির জন্য এ হৃদয় আজ শ্রাবণ পালক, মায়াবি কোর্তার বুকে
স্মৃতির পকেট হয়ে বেঁচে থাকা নিয়তি আমার।’
সচেতন পাঠক খেয়াল করুন ‘কেবলি ধূসর আঁকি’ বাক্যংশের ব্যবহার। এবং তা অফুরান ঘাসজলে। অফুরান অর্থে অসীম। আমাদের সামনে পিছনে বিস্তৃত মহাজগত কথার হাতছানি। অন্যকিছু করার অমোঘ টান থেকে পরম সংযম দেখিয়ে তা থেকে বিরত থাকেন শাহীন রেজা। এই গভীরতন প্রতিফলনের টান আদৃত হবে ভেবে কবিরা ভাবনার প্রতিফলন ঘটান (এখনও আঁকি,এখনও ইত্যাদি ইত্যাদি) যা ধ্বনি মাধুর্যের ঝোঁকে কোনো কোনো কাব্যের প্রবচন হয়ে ওঠার সম্ভাবনা লুকিয়ে থাকলে তা সচেতন ব্যবহারের মাধুর্যে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে কিন্তু এর কোনোটিই বিচ্যুত করতে পারেনা শাহীন রেজাকে।
প্রথম ব্যবহারে তিনি রবাহুত হয়ে ওঠার ইঙ্গিত দেন। ঠিক ওইটুকুই। তাই প্রক্ষিপ্ত ভাবনায় তিনি বলে ওঠেন,
‘একটি আধুলি সিকির জন্য, হৃদয় আজ শ্রাবণ পালক।’
তার ৩৫ বছরের কাব্যচর্চার জীবনে তিনি মেতে রয়েছেন কাব্যভাষা আবিষ্কারের আনন্দে। ‘তামাদি মার্বেল’ কবিতায় তিনি বলেন-
‘একদিন কাছে আসতেই তোমার মার্বেল চোখ আমাকে ছোবল দিয়েছিলো’।
‘ছোবল’ শব্দটি দিয়ে মার্বেল চোখের আক্রমন এই প্রথম দেখলো বাংলা কবিতা।
শাহীন রেজা সেই জাতের কবি যিনি নিজের উত্তরণের সাথে গুরুত্ব দেন ভূমির, পরিপার্শ্বের, তরুণতম কবিদের এক জগত নির্মানের। যিনি জনপ্রিয় কবিতা প্রতিনিধিদের খারিজ করে পাঠকের সামনে তুলে ধরতে চান ধ্রুপদী চিন্তাকে, বাংলা কবিতার প্রকৃত ধারণ ভূমিকে।
তিনি ‘হাইফেন’ কবিতায় বলেন-
‘প্রতিটি পরকীয়ার মধ্যে একটি হাইফেন থাকে,
মেঘ ও তারাদের মধ্যে যেমন।
এক অক্সিজেনের সাথে দুই হাইড্রোজেন না মিললে তার পরিণতি যেমন
জল নয়, তেমনি জন্মনিরোধক সঙ্গম কখনো তৃপ্তির পালে আঁকে না জোয়ার।’
এই কবিতায় তিনি পাঠক কিংবা পরবর্তীদের চিনিয়ে দিতে সাহায্য করেন মূলস্রোত কবিতার অভিমুখ। সস্তা জনপ্রিয়তার নাগাল এড়িয়ে খুব ক্ষীনশব্দে বয়ে চলা বাংলা আবহমান কবিতার পদশব্দটিকে। তার এই স্বতন্ত্র চিন্তাকে একদিন ইতিহাস বলে চিহ্নিত করবে তার পরিপার্শ্ব, তার সময়।
শাহীন রেজার কবিতার একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো তার শব্দ ব্যবহার। নতুন নতুন শব্দ আবিষ্কারের চেষ্টায় না থেকে তিনি নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন যে কুশলতায় তা হলো প্রচলিত শব্দকে ঘষে মেজে পরিস্কার করে দুটি শব্দের ভেতর আমূল দক্ষতায় বসাতে, যাতে কাব্যের উজ্জ্বল্য এক বর্ণময়তার সূচনা করে। তিনি ভাবনার ব্যপ্তিতে না গিয়ে তার গভীরে ডুব দিয়ে তুলে আনতে চেয়েছেন অনিবার্য প্রকাশ ভঙ্গিমা।
‘কুসুম ছোঁয়া রোদ’ কবিতায়-
‘কাঠরঙ দিনের শেষে গোমড়ামুখো নদী নিজেই হারালো তার উর্মি সৌষ্ঠব।’
‘হাইফেন’ কবিতায়-
‘কোনো প্রেম পাপ নয় শুধু প্রেমহীন দেহবাস অযোগ্য ঘৃণার।’
প্রথম পংক্তিতে ‘গোমড়ামুখো’ এবং দ্বিতীয়টিতে ‘প্রেমহীন’ শব্দদুটি এক আমূল দক্ষতায় নির্মাণ। ধ্রুপদী আবিষ্কারকেই ভালোবেসে তার ভূমিতেই মগ্ন রইলেন শাহীন রেজা।
এমন অজস্র মনিমুক্তো ছড়িয়ে রয়েছে শাহীন রেজার কবিতায় পরতে পরতে। হিসেবহীনতা তাকে শিখিয়েছে জীবন চিনতে, প্রজ্ঞা তাকে চিনিয়েছে প্রকৃত তূণের ব্যবহার। জনপ্রিয় কবিতাকে সযত্নে খারিজ করে দীর্ঘ তিন দশক ধরে শাহীন রেজা বুনে চলেছেন যে স্বপ্নবীজ, আগামী দিনে আবেগ ঝরে যাবার পর কবিতা চিনতে শেখা যুবক যুবতীর ঝোলায় তিনি যে অবশ্যপাঠ হয়ে উঠবেন এ আমাদের আন্তরিক বিশ্বাস।
আশির দশকের প্রতিনিধিত্বশীল কবি শাহীন রেজা ১৯৬২ সালের ২৯ মে পিরোজপুর জেলার পুখরিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ২৯।