চলে গেলেন সালাম সালাম হাজার সালাম গানের রচয়িতা ফজল-এ-খোদা

আহমাদ মাযহার

 

রোববার (৪ জুলাই) কোভিড উনিশের বৈশ্বিক মহামারি কেড়ে নিল ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’সহ অসংখ্য জনপ্রিয় গানের বাণীকার সর্বজন শ্রদ্ধেয় গানের মানুষ ও বেতারকর্মী ফজল-এ-খােদাকে। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮১ বছর।

বেতার-টেলিভিশনের বহু অনুষ্ঠানের পরিকল্পক, লেখক ও নির্দেশক এই মানুষটির গর্ব ছিল, তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, স্বাধীন বাংলাদেশে বেতার বিষয়ক পত্রিকা ‘বেতার বাংলা’ ও ‘BANGLADESH BETAR’-এর তিনি ছিলেন প্রথম সম্পাদক। বেতার বিভাগের ছােটদের পত্রিকা শাপলা শালুক-এরও উদ্যোক্তা এবং সম্পাদক ছিলেন তিনি। পত্রিকাটিকে ঘিরে শিশু-কিশাের সংগঠন ‘শাপলা শালুকের আসর’-এর তিনি ছিলেন পরিচালক ‘মিতাভাই’। কবি ও শিশুসাহিত্যিক হিসেবেও রয়েছে তাঁর বিশেষ পরিচিতি।

এই গুণী মানুষটির জন্ম ১৯৪১ সালের ৯ মার্চ, পাবনার বেড়া থানার বনগ্রামে।

ফজল-এ-খােদার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা প্রায় চল্লিশটি। তাঁর বইগুলো হচ্ছে, ‘সূর্য স্বর্ণ দ্বীপ’ [কবিতা] (১৯৬৮),‘মােক্তারপাড়া [নাটক] (১৯৭০), ‘সঙ্গীতা’ [গান] (১৯৭৩), ‘বিতর্কিত জ্যোৎস্না’ [কবিতা] (১৯৭৩), ‘সানাই’ [ছড়া] (১৯৭৬), ‘ইসলামী গান’ [ভক্তিমূলক গান] (১৯৮০), ‘প্রাসঙ্গিকী’ [শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কিত প্রবন্ধ পুস্তিকা] (১৯৮৩), ‘নামে যার কেঁপে ওঠে’ [কবিতা] (১৯৯০), ‘মন্দিরা’ [দেশপ্রেমের গান] (১৯৯৭), ‘গান’ [নির্বাচিত গান] (১৯৯৭), ‘বন্দেগি’ [ইসলামি গান] (২০০২), ‘তাড়া করে অশুভ সময়’, [কবিতা] (২০০৮), ‘কাজল মাটির গান’ [লােকধারার গান] (২০১২), ‘সংগীতভাবনা’ ‘প্রবন্ধ’ (২০১২),‘নির্জন পঙ্‌ক্তিমালা’ [কবিতা] (২০১৪)।

এ ছাড়াও বিপুল অভিজ্ঞতার ভাঁড়ার থেকে মাঝে মধ্যেই হাজির করেছেন স্মৃতিমেদুর গদ্যরচনা। সেসব রচনার সংকলন ‘আলোছায়ার জোয়ার-ভাটা’ (২০১৫) তাঁর সময়ের জাজ্জ্বল্যমান স্মৃতিদলিল।

তাঁর রচিত ছোটদের বইও রয়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায়। সেগুলো হচ্ছে, ‘মিতাভাইয়ের আসর’ [গীতি-নৃত্য-নাট্য] (১৯৭৭), ‘ফুলপাখিদের গান’ [ছােটোদের গান] (১৯৮৬), ‘যমযম’ [আরবি অক্ষরভিত্তিক ছড়া] (১৯৮৯), ‘আড়ি’ [ছড়া] (১৯৯০), ‘টুনটুনি’ [ছড়া] (১৯৯০), ‘নাটক নাটক’ [দুটি নাটকের সংকলন] (২০০০), ‘জয় মুক্তিযুদ্ধ’ [ছড়া-কবিতা] (২০০৭), ‘রবীন্দ্র নজরুল বঙ্গবন্ধু জয়নুল’ [চার মহাজীবনের গল্প] (২০০৭), ‘জাগল বাঙালি জাগল’ [কবিতা] (২০১০), ‘নটে গাছটি মুড়লাে’ [ছড়া-কবিতা] (২০১০), ‘রয়েল বেঙ্গল’ [বড়াে গল্প] (২০১১), ‘জয় ছড়ার জয়’ [ছড়া] (২০১২), ‘আড়ং’ [ছড়া-কবিতা] (২০১২), ‘ছড়াকলাকার’ [ছড়াকারদের নিয়ে ছড়া] (২০১৩),‘বাংলার ছড়া বাঙালির ছড়া’ [ছড়া] (২০১৪)।

এ ছাড়াও রয়েছে তাঁর সম্পাদিত দুটি বই ‘প্রেম পিরীতি’ [পঁচিশ বছরের প্রেমের কবিতা] (১৯৯৬)

‘ঈদের গান’ [ঈদভিত্তিক গান] (২০০৪)। দেশপ্রেম ছিল কবিতায় তাঁর প্রধান উপজীব্য। বঙ্গবন্ধুকে নিয়েও লিখেছিলেন বেশ কিছু রচনা। ছোটদের জন্য লেখা তাঁর ছড়া ও কবিতায় ছিল লোকজ সংস্কৃতির প্রভাব।

১৯৬০ দশকের প্রায় মাঝামাঝি সময় থেকে পরবর্তী পঞ্চাশ বছর ছিল তাঁর সৃষ্টিশীলতার কাল। অসংখ্য দেশাত্মবোধক, আধুনিক, লোক সংগীত ও ইসলামি গানে তাঁর সৃষ্টিসম্ভার সমৃদ্ধ। ১৯৬৩ সাল থেকেই তিনি বেতারের তালিকাভুক্ত গীতিকার। গীতিকার হিসেবে ১৯৬৪ সালে ঢাকা টেলিভিশন কেন্দ্রের জন্মলগ্ন থেকেই তালিকাভুক্ত তিনি। তাঁর লেখা ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ গানটি ১৯৭১ সালে যুদ্ধ চলাকালে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দীপ্ত করেছে। উল্লেখ্য, ফজল-এ-খোদার লেখা এবং মোহাম্মদ আবদুল জব্বারের সুর ও কণ্ঠে করা ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ গানটি ২০০৬ সালে বিবিসি’র সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাংলা গানের সেরা ২০টি গানের তালিকায় ১২তম (দ্বাদশ) স্থান পায়। এ ছাড়া ১৯৭১-এ অসহযোগ অন্দোলন চলাকালে তাঁর লেখা গণ সংগীত ‘সংগ্রাম, সংগ্রাম, সংগ্রাম চলবে, দিন রাত অবিরাম’ গানটি তৎকালীন ঢাকা টেলিভিশন কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়।

ফজল-এ-খোদার অনেকগুলো গানই দীর্ঘকাল ধরে জনপ্রিয়। ‘যে দেশেতে শাপলা শালুক ঝিলের জলে ভাসে’,‘ভালোবাসার মূল্য কত আমি কিছু জানি না’,‘কলসি কাঁধে ঘাটে যায় কোন রূপসী’, বাসন্তী রং শাড়ি পড়ে কোন রমণী চলে যায়’, আমি প্রদীপের মতো রাত জেগে জেগে’,‘প্রেমের এক নাম জীবন’,‘ভাবনা আমার আহত পাখির মতো পথের ধুলোয় লুটোবে’–এইসব গানের প্রথম চরণের উল্লেখ করা হলে অনেকেরই সে কথা মনে পড়বে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার শিকার হলে তাঁর দুঃখ এবং ক্ষোভ প্রতীকী ব্যঞ্জনায় গানের মাধ্যমে প্রকাশ করেন। বশীর আহমদের সুরে শিল্পীবন্ধু মোহাম্মদ আবদুল জাব্বারের গাওয়া ফজল-এ-খোদার সেই গানটি হলো, ‘ভাবনা আমার আহত পাখির মতো/ পথের ধুলোয় লুটোবে/ সাত রঙে রাঙা স্বপ্ন-বিহংগ/ সহসা পাখনা লুটোবে/ এমন তো কথা ছিলো না’। গানটি ১৯৭৬ সালে ঢাকা রেকর্ড প্রকাশ করে। ঢাকা বেতার থেকেও বহুবার প্রচারিত হয় গানটি।

তাঁর লেখা গান গেয়েছেন বশীর আহমেদ, আবদুল জাব্বার, মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী, রথীন্দ্রনাথ রায়ের মতো বিখ্যাত শিল্পীরা। তাঁর অনেক গানে সুর করেছেন আজাদ রহমান, আবদুল আহাদ, ধীর আলী, সুবল দাস, কমল দাশ গুপ্ত, আবেদ হোসেন খান, অজিত রায়, দেবু ভট্টাচার্য ও সত্য সাহার মতো শ্রদ্ধেয় সুরকারেরা।

বেশ কিছুকাল ধরে তিনি ডায়াবেটিক এবং কিডনি রোগ ছাড়াও ডিমেনশিয়ায় ভুগছিলেন। দুঃখজনক যে, দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা ফজল-এ-খোদাকে রাষ্ট্রীয় কোনো সম্মানও জানানো হয়নি।

ব্যক্তিগত ভাবেও আমি তাঁর স্নেহ-ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছি। ছোটদের জন্য লেখা তাঁর ছড়ার বই ‘ছড়াকলাকার’ ছিল ব্যতিক্রমী এক ছড়া-সংকলন। বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন ছড়ালেখককে নিয়ে লেখা তাঁর ছড়া দিয়ে বইটি গড়ে উঠেছে। এই বইয়ে অন্তর্ভুক্ত একটি ছড়া তিনি লিখেছেন আমাকে নিয়েও। আজ তাঁর বিয়োগকালে অশ্রুসজল চোখে সে-কথা স্মরণ করছি।

ফজল-এ-খোদার জ্যেষ্ঠ পুত্র আমাদের বন্ধু ওয়াসিফ-এ-খোদা সহ তাঁর শোক সন্তপ্ত পরিবারের সকলকে আমার সমানুভূতি জানাই। আশা করি এই দুর্বহ শোক তাঁরা কাটিয়ে উঠবেন। কামনা করি কোভিড উনিশে আক্রান্ত তাঁর স্ত্রী মাহমুদা সুলতানা যেন দ্রুত আরোগ্য লাভ করেন।

** পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, কিছুদিন আগে ফজল-এ-খোদার বড় ছেলে করোনায় আক্রান্ত হন। এরপর গত ২৯ জুন করোনা পরীক্ষায় ফজল-এ-খোদা ও তার স্ত্রীর রিপোর্ট পজিটিভ আসে। প্রথমে বাসা থেকেই চিকিৎসা নিচ্ছিলেন তারা। শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়ায় চিকিৎসকের পরামর্শে গত ৩০ জুন হাসপাতালে ভর্তি করা হয় প্রখ‌্যাত এ গীতিকারকে। রোববার (৪ জুলাই) ভোর ৪টার দিকে মারা যান তিনি। রোববার (৪ জুলাই) সকাল ১১টার দিকে নগরীর রায়ের বাজার কবরস্থানে সমাহিত করা হয় তাকে।

 

আহমাদ মাযহার-এর ফেসবুক পেজ থেকে

Print Friendly

Related Posts