শাহ মতিন টিপু
বিংশ শতাব্দীর জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের দশম প্রয়াণ দিবস আজ। তার লেখা পাঠকের কাছে ছিলো বিশেষ আকর্ষনের। তিনি যাই লিখতেন, তাই পাঠকের কাছে সমাদৃত হতো। তাকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক বলে গণ্য করা হয়।
এই যাদুকর সাহিত্যিক ২০১২ সালের ১৯ জুলাই আমাদের ছেড়ে যান। মরণব্যাধি ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৬৪ বছর বয়সেই তিনি প্রয়াত হন। মৃত্যুর পর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে লাখো মানুষের অশ্রু পুষ্পতে সিক্ত হন তিনি। তাকে নুহাশপল্লীর লিচুতলায় চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়।
প্রয়াণের ৯টি বছর পার হলেও এই কিংবদন্তি আজো বেঁচে আছেন লক্ষ পাঠকের হৃদয়ে।
করোনা পরিস্থিতির কারণে কিংবদন্তি এই লেখকের প্রয়াণ দিবসে এবার আনুষ্ঠানিক তেমন কোনো আয়োজন থাকছে না। তবে সীমিত পরিসরে গাজীপুরের নুহাশপল্লীতে কিছু আয়োজন থাকছে আজ।
নুহাশ পল্লীর ম্যানেজার সাইফুল ইসলাম বুলবুল জানান, আজ সকালে নুহাশপল্লীতে কুরআন খতমের আয়োজন করা হয়েছে। এরপর হুমায়ূন আহমেদের মাজারে ফুল দেওয়া হবে। প্রতিবছর এতিম বাচ্চাদের খাওয়ানোর যে আয়োজন হয় তা এ বছর হচ্ছে না। এই বাবদ যে টাকা খরচ হয় তা এবার গরিব মানুষদের মধ্যে বিতরণ করা হবে। ঈদের আগেই সেই টাকা বিতরণ হবে। হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওন সকালে নুহাশপল্লীতে যাবেন বলেও জানা গেছে।
নেত্রকোনার কেন্দুয়ায় ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন হুমায়ূন আহমেদ। কে জানতো নেত্রকোনার এই সন্তানটি একদিন হয়ে উঠবেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান জননন্দিত কথাশিল্পী, নাট্যকার ও চলচ্চিত্র নির্মাতা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগের একজন অধ্যাপক নন্দিত নরকে, লীলাবতী, কবি, শঙ্খনীল কারাগার, গৌরিপুর জংশন, নৃপতি, বহুব্রীহি, এইসব দিনরাত্রি, দারুচিনি দ্বীপ, শুভ্র, নক্ষত্রের রাত, কোথাও কেউ নেই, আগুনের পরশমণি, শ্রাবণ মেঘের দিন, জোছনা ও জননীর গল্প, এমন ঝড় তোলার মতো উপন্যাস লিখে ফেলবেন কে জানতো! আবার সে বইয়ের সংখ্যা তিন শতাধিক ছাড়িয়ে যাবে, কে জানতো!
হুমায়ূন আহমেদ এমন ঘরানার সাহিত্যিক, যিনি ছোটগল্প লিখে আলোড়ন তুলেছেন, উপন্যাস দিয়ে মোহগ্রস্ত করেছেন। সৃজনশীলতার প্রায় সব শাখায় পাঠক ও দর্শকদের নিয়ে বিশাল সাম্রাজ্য গড়েছিলেন।
বিজ্ঞানের ছাত্র হুমায়ূন আহমেদ প্রথম উপন্যাসেই যে সাড়া ফেলেন, আর পেছন দিকে তাকাবারও প্রয়োজন হয়নি। হুমায়ূনের উপন্যাসের নাট্যরূপ ধারাবাহিকভাবে টেলিভিশনে প্রচারিত হলে সেখানেও দর্শকদের সাড়া। হুমায়ূন যখন চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন তা দেখতে শহর ভেঙে পড়ে। হুমায়ূন আহমেদ চলচ্চিত্র আগুনের পরশমণি, শ্যামল ছায়া, শ্রাবণ মেঘের দিন, দুই দুয়ারী, চন্দ্রকথা, নয় নম্বর বিপদ সংকেত ও ঘেটুপুত্র কমলা সবগুলোই ছিল দর্শকপ্রিয় ও ব্যবসা সফল।
চলচ্চিত্র বা নাটকের জন্য হুমায়ূন আহমেদ গান লিখেছেন, আবার তাতে সুরও দিয়েছেন, তা সমাদৃত হয়েছে।
‘যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো’, ‘চাঁদনী পসরে কে’, ‘ও আমার উড়াল পঙ্খীরে’, ’এক যে ছিল সোনার কন্যা’, ‘আমার ভাঙ্গা ঘরে ভাঙ্গা বেড়া ভাঙ্গা চালার ফাঁকে’, ‘চাঁদনী পসর রাইতে যেন আমার মরণ হয়’ হুমায়ূন আহমেদের লেখা এসব গান আজো মানুষের মুখে মুখে ফেরে।
বিস্ময়কর সত্য এই য়ে, টেলিভিশন নাটকে তার সৃষ্ট চরিত্রের শাস্তি যেন না হয়, তার জন্য বাংলাদেশের একাধিক জায়গায় মিছিল হয়েছিল। ধারাবাহিকের বিশেষ একটি পর্ব প্রচারিত হওয়ার পরের দিনই মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল ‘তুই রাজাকার’ বাক্যটি। লেখায় ও লেখার উপস্থাপনায় এমনই অসাধারণ সক্ষমতা ছিল হুমায়ূন আহমেদের।
বাংলা সাহিত্যে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক ‘একুশে পদক’ লাভ করেন। এছাড়া তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৮১), হুমায়ুন কাদির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯০), লেখক শিবির পুরস্কার (১৯৭৩), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৯৩ ও ১৯৯৪), বাচসাস পুরস্কার (১৯৮৮) লাভ করেন।
হুমায়ূন আহমেদ এর ডাকনাম কাজল। বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ ও মা আয়েশা ফয়েজের সন্তান তিনি। বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা, আর মা ছিলেন গৃহিণী। তিন ভাই দুই বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। কথাসাহিত্যিক জাফর ইকবাল তাঁর ছোট ভাই। সবার ছোট ভাই আহসান হাবীব নামকরা কার্টুনিস্ট ও রম্যলেখক।