দেবতা॥ আহসান ওয়াহিদ এর গল্প

আহসান ওয়াহিদ

সুনয়না হাসপাতাল থেকে নেমে রাস্তায় এসে দেখে গাড়িটা নিয়ে এখনো আসেনি। ড্রাইভার মালেককে ফোন করেছে আর না হলেও বিশ মিনিট হয়েছে। রাপা প্লাজা না কোথায় যেন কার-পাকিং আছে, সেখানেই গাড়িটা রাখে সে। তবুও ওখান থেকে গ্রীণরোডে আসতে তার এত সময় লাগার কথা না। কি হয়েছে কে জানে! গাড়ি চালায় ভালো, কিন্তু ওর আবার অযুহাতের কোন শেষ নাই। এসে হয়তো বলবে, ম্যাডাম, কোনরকমে পলাইয়া আসতে পারছি। গাড়িটা গ্যারেজ থেকে বাইর করতেই শালার সার্জেন্ট কইত্থাইকা যেন সামনে আইসা হাজির!

কিছুই করার নেই। সুনয়না নিজেও অনেকবার স্বচক্ষে দেখেছে। প্রাইভেট কারগুলো যেন পুলিশের ঠিক শত্রু। কারণে অকারণে থামিয়ে বিজ্ঞের মতো কাগজপত্র ঘাটবে। ব্লু বুক, ফিটনেস, ট্যাক্স টোকেন, বীমার কাগজ তন্ন তন্ন করে দেখবে। একটু এদিক-সেদিক হলে কমপক্ষে পাঁচশ’ গচ্চা। ইদানিং আবার নতুন একটা সিস্টেম চালু করেছে। দূর থেকে গোপনে ভিডিও করে অবৈধ পার্কিং দেখিয়ে মামলা ঠুকে কাগজ বাসায় পাঠিয়ে দিচ্ছে। কোথায় কখন অবৈধ পার্কিং করল সুনয়না বুঝতেও পারে না। অথচ জরিমানা গুনতে হয় প্রতিবারে দেড়-দুই হাজার টাকা। কিন্তু রাস্তায় যে কত ছালবাকল ওঠা ভাঙাচোরা ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলছে, লাইসেন্স ছাড়া কতো চ্যাংড়া ছেলেপেলে অবৈধভাবে গাড়ি চালাচ্ছে, যেখানে-সেখানে অবৈধ পার্কিং-এর জন্য যানজটে মানুষ নাকাল হচ্ছে- সেদিকে নজর দেয়ার কোনো সময় নেই।

ব্যাগ হাতিয়ে মোবাইল বের করে সময় দেখে সুনয়না। দুপুর একটা। রোদের প্রচণ্ড তাপ। এই গরমে অসুস্থ ছেলেটাকে নিয়ে রাস্তার ওপর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যায়? আরেকবার রিং করতে যাবে এ সময়ে মালেক গাড়িটা সামনে এনে ব্রেক কষে।

কী ব্যাপার মালেক, এত দেরি করলে কেনো?

সুনয়নার প্রশ্নের জবাব দেয়ার কোন প্রয়োজন মনে করে না মালেক। ড্রাইভিং সিট থেকে নেমে গাড়ির পেছন দিয়ে ঘুরে এসে দরজা খোলে সে, ম্যাডাম উঠেন।

সুনয়না গাড়িতে উঠে বসে বাইরের দিকে তাকাতেই দেখে সেই লোকটি হাত উঁচিয়ে হাসপাতালের গেটের সামনের গলির ভেতর থেকে ছুটে আসছে তার দিকে। মালেক গাড়ি টান দেবে, সুনয়না তাকে থামতে বলে দরজার গ্লাস নামিয়ে বাইরে তাকায়।

লোকটি মধ্যবয়সী, তবে বেশ স্মার্ট। মুখে ফ্র্যাঞ্চকাট দাড়ি। ঠোট দুটি টসটসে গোলাপি লাল, যেন ফেটে রক্ত বেরিয়ে পড়বে এক্ষুণি।

সুনয়নার সঙ্গে লোকটির দেখা হয়েছিল সকালে, যখন সে ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালের বেডে অপেক্ষা করছিল ব্লাড ব্যাগের জন্য। ছেলের শরীরে ব্লাড দিতে হবে। এর জন্য প্রতিমাসেই হাসপাতালে আসতে হয় তাকে। ছেলের রক্তে এডাল্ট হিমোগ্লোবিন তৈরি হয় না, উপরন্তু বাইরে থেকে যা দেয়া হয় তা খুবই দ্রুত ভেঙে যায়। ছেলেকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে এভাবেই ব্লাড দিয়ে যেতে হবে, ডাক্তারদের মত এমনটিই।
ভাই, একটা কথা বলব?

অপরিচিত একটি লোক এভাবে যেচে কথা বলতে চায়! সুনয়না ছেলের সঙ্গে বেডে বসা ছিল, নেমে এলোমেলো ওড়নাটা দ্রুত গায়ে জড়িয়ে লোকটির দিকে তাকালো সে।

আপনার তো এই একটিই সন্তান?

সুনয়নার মুখ মলিন। অনেকটা কাচুমাচু করে বলল, জ্বী।

কবে থেকে অসুখটি ধরা পড়ল?

এই.. ওর যখন একবছর বয়স তখন।

এখন কত হবে বয়স, সাত-আট?

হ্যাঁ, আট বছর।

মাশাল্লাহ্, অন্য রোগিদের তুলনায় আপনার ছেলের স্বাস্থ্য খুবই ভালো। দেখে মনে হয়না কঠিন একটা রোগে ভুগছে সে। যাক, চিন্তা করবেন না। অসুখ যিনি দিয়েছেন, ভালোও তিনিই করবেন।

তারপর লোকটি পকেট থেকে একটা ভিজিটিং কার্ড বের করে সুনয়নার হাতে দিয়ে বলল, আপনি ছেলেটাকে এই ডাক্তারকে একটু দেখাবেন। এনার হাতযশ ভালো। আজগর আলী হাসপাতালে বসেন।
বলেই লোকটি একমুহূর্তও দেরি করে না, দ্রুত পায়ে রোগীভর্তি সামনের বেডগুলো মারিয়ে ওয়ার্ডের বাইরে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়।

সুনয়না বিষয়টি খেয়াল করে না, লোকটার দেয়া কার্ডটিও নেড়েচেড়ে দেখে না। ওর এখন এদিকে মন নেই। গতকাল ব্লাড যোগাড় করে রেখে গেছে। হাসপাতালে আসার পর ব্লাডব্যাগ ফ্রিজ থেকে বের করা হয়েছে। আধঘণ্টা-একঘণ্টা লাগবে ব্লাড নরমাল হতে। তারপর ওয়াশ করবে। তবেই শরীরে দেয়ার উপযোগী হবে। অনেক হাঙ্গামা! কিন্তু কোনো উপায় নেই। প্রতিমাসেই এ কাজটি নিয়মিত করতে হয় তাকে।

আগে দিলীপ করতো। এর জন্য অফিস থেকে তাকে ছুটি নিতে হতো। কয়েকমাস হলো অফিস থেকে একটি গাড়ি পেয়েছে। তারপর থেকে কাজের চাপে দিলীপ আর আসে না, সুনয়নাই দায়িত্বটি নিয়েছে।

লোকটি ফুটপাত থেকে রাস্তায় নেমে খানিকটা ঝুঁকে সুনয়নার দিকে তাকিয়ে বলল, ভাই, আপনি কিন্তু ছেলেটাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবেন। কার্ডটা কি আছে, না হারিয়ে ফেলেছেন?

কার্ডটির কথা সুনয়নার মনেও ছিলো না। আনমনে ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে নাড়াচাড়া করে সে। না, নাই।

লোকটি মুচকি হেসে বলল, পাচ্ছেন না তো! ঠিক আছে আরেকটা দিচ্ছি আমি, এই নিন। বেশি দূর না হাসপাতালটি। গেণ্ডারিয়ায়, ধূপখোলা মাঠের ঠিক কাছে।

সুনয়না হাত বাড়িয়ে ছোট্ট কার্ডখানা নিয়ে একমুহূর্ত চোখ বুলিয়ে মাথা উঁচু করে দেখে লোকটি নেই। জানালা দিয়ে মাথা গলিয়ে ডানে-বায়ে তাকিয়ে কোথাও লোকটির ছায়া পর্যন্ত চোখে পড়ছে না। আশ্চর্য, লোকটা কেমন! মালেক তুমি যাও।

প্রতিমাসে ছেলেকে ব্লাড দেয়া সুনয়না আর দিলীপের জীবনের একটি অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি একজন চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র মাত্র। মানুষ যেমন ডায়াবেটিস রোগের জন্য নিয়মিত অষুধ খায়, ব্যায়াম করে, ইনসুলিন নেয়- ছেলেকে মাসে মাসে ব্লাড দেয়াটাও তেমনি মনে করে নিয়েছে ওরা। ছেলেকে নিয়ে ওরা অনেক ভেবেছে। দেশের বিশিষ্ট হেমাটোলজিস্টদের কাউকেই বাকি রাখেনি দেখাতে। সবার মুখে ওই একই কথা- বাঁচাতে হলে নিয়মিত ব্লাড দেয়াটাই একমাত্র চিকিৎসা। বংশগত রোগ। সন্তানও নেয়া যাবেনা আর। অনেকের পরামর্শমতো কলকাতাও গিয়েছে। কিন্তু ফলাফল একই। পৃথিবীর কোথাও এ রোগের কোনো চিকিৎসা নেই। হ্যাঁ, কে একজন যেন বলেছিলেন, কানাডা না অষ্ট্রেলিয়া কোথায় যেন চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। বোনমেরু প্রতিস্থাপন। তবে এটি বেশ ব্যয়বহুল, আবার চিকিৎসার সময় রোগীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনাও ফিফ্টি ফিফ্টি।

সুনয়না আর দিলীপের মতো এমন নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য এটি আকাশকুসুম কল্পনা। অগত্যা সব চিন্তা-চেতনা বাদ দিয়ে ওরা এভাবেই জীবনটাকে স্বাভাবিক মনে করে নিয়েছে।

প্রথমদিকে সুনয়না ভেঙে পড়েছিল। সারাটা জীবন সামনে। ছেলেটা চোখের সামনে অসুস্থ্য হয়ে পড়ে থাকবে, আর কোনো সন্তানও নেয়া যাবেনা। ওরা না থাকলে ছেলেটারইবা কী হবে! পৃথিবীতে এতো রোগের চিকিৎসা আছে, আর এটা কেমন অসুখ যার কোনো চিকিৎসাও নাই! ভাবতে ভাবতে শুকিয়ে কাঠ হয়ে নিজেই অসুস্থ হয়ে গিয়েছিল। অন্যদিকে ভেতরে কষ্টের আগুনে পুড়লেও দিলীপ খুব শক্ত ছিলো। বলেছিল, সুনয়না, এতে কি আমাদের কোনো হাত আছে? আমরা কষ্ট পেলেও কি এর থেকে নিষ্কৃতি পাবো? বরং শক্ত হতে হবে আমাদের। আমরা যদি ভেঙে পড়ি তবে বাচ্চাটার কী হবে? আমাদের যা আছে অনেকেরতো তা-ও নেই। অনেকে লক্ষ কোটি টাকা খরচ করেও মা-বাবা হতে পারে না, আমরাতো অন্তত মা-বাবা ডাকটা শুনতে পাচ্ছি। সৃষ্টিকর্তার ওপর ভরসা রাখো, উনি আমাদের জন্য যা ভালো মনে করেন তা-ই হবে। তাছাড়া তুমি যদি এমন করো আমি কোথায় যাবো? সৃষ্টিকর্তা মহান, একমাত্র তিনিই রাতকে দিন আর দিনকে রাত করতে পারেন। তিনি যা করেন মানুষের মঙ্গলের জন্যই করেন। আমরা শুধু চেষ্টাই করে যেতে পারি, তিনি যেটা ভেবে রেখেছেন সেটাই হবে।

ধীরে ধীরে শক্ত হয়ে ওঠে সুনয়না। জীবন চলতে থাকে তার নিয়মে।
ছেলেটার নাম সুমন। সবসময়ই হাসপাতাল থেকে ঘরে ফেরার দিনটিতে বাবার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে সে। সুনয়না সেদিন ভালো রান্নবান্না করে। দিলীপ অফিস থেকে ফেরার পথে কেক, চকলেট ইত্যাদি সব গিফট্ নিয়ে এসে দিনটিকে উদযাপন করে। সেদিনও এর ব্যতিক্রম হয়নি। তবে বরাবরের মতো সুনয়নাকে ততটা সপ্রতিভ মনে হচ্ছিলো না দিলীপের কাছে।

তোমার কি মন খারাপ সুনয়না? এ্যানি প্রবলেম্? হাসপাতালের সবকিছু নিশ্চয়ই ঠিকঠাক ছিলো, না হলোতো ফোনে জানাতে আমাকে।

সুনয়না অনেকটা টেনে টেনে বলল, না, সমস্যা কিছু না। তারপর আলমারির ভেতরে রাখা পার্স থেকে ডাক্তারের ভিজিটিং কার্ডটা এনে দিলীপের হাতে দিয়ে বলল, এক ভদ্রলোক আমাকে এটি দিয়েছেন।
অধ্যাপক ডাঃ মঞ্জুর মোরশেদ, হেমাটোলজিস্ট, বিভাগীয় প্রধান, আজগর আলী হাসপাতাল, গেণ্ডারিয়া, ঢাকা।

দিলীপ কার্ডে লেখা ডাক্তারের নাম ঠিকানা অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করে সুনয়নার দিকে মুখ তুলে বলল, তো কি হয়েছে?

সুনয়না যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। বলল, না, কিছু হয়নি। তবে লোকটা বারবার রিকোয়েস্ট করেছেন আমরা যেন সুমনকে ওই ডাক্তারকে একবার দেখাই। তাঁর নাকি অনেক হাতযশ আছে।

দিলীপ মৃদু হাসে। সুনয়না জিজ্ঞেস করে, হাসছো কেনো?

হাসছি এজন্যে যে, কেউ কিছু বললেই তুমি পাগল হয়ে যাও। আমরা কি কম চেষ্টা করেছি? যখন যে যার কথা বলেছে সেখানেই ছুটে গেছি। তোমার মনে আছে কলকাতার হোটেলে একজন বলেছিল সেখানকার বিখ্যাত হোমিও ডাক্তার ভোলানাথ বাবুকে দেখাতে। দেখিয়েছি। বাংলাদেশের বিখ্যাত হোমিও ডাক্তার আলী আহমদ সাহেবকে বছরের পর বছর দেখিয়েছি, কই, কিছু কি কাজ হয়েছে? তুমি বায়না ধরেছিলে হযরত শাহজালাল, শাহপরাণ-এর মাজারে মানত করতে। গিয়েছি, মানত করেছি। কে যেন তোমাকে বলেছিল ইসলামপুরের দুরমুটে কামেল দরবেশ হযরত শাহকামাল-এর মাজারে যেতে, অনেক কষ্ট করে সেখানেও গিয়েছি। আজমীর শরীফ যাওয়ার জন্যও তো বায়না করে রেখেছো। আসলে তোমারতো মায়ের মন, ঠিক আছে কার্ডটা রাখো, সময় করে যাবো একদিন।

সুনয়না বুঝতে পারে দিলীপের কাছে বিষয়টি তেমন গুরুত্ব পায়নি। তারপরও মাস-তিনেক অতিবাহিত হওয়ার পর একদিন কি মনে করে বলল, লোকটা এত করে বলল! কাছেই-তো, চলনা ছেলেটাকে নিয়ে ডাক্তারটার কাছে একটিবার যাই। শোনো, কার অছিলায় কী হয় সেটা কি তুমি-আমি কেউ বলতে পারি?

দিলীপ নরোম স্বরে বলল, তা অবশ্য ঠিকই বলেছো।

সুনয়নার কথাটি এবার মনে ধরে দিলীপের। বলল, ঠিক আছে, এ্যাড্রেসটাতো তোমার কাছে আছে, ফোন করে অ্যাপয়েনমেন্ট নাও।
ডাক্তারের চেম্বার হাসপাতালের ভেতরেই। কাঁচা-পাকা শ্মশ্রুমন্ডিত সৌম্য-শান্ত চেহারার একজন নিপাট ভদ্রলোক। সাদা জামার সঙ্গে কালো টাই পরা। ল্যাপটপ সামনে রেখে সটান বসে আছেন রিভলভিং চেয়ারে। গলায় ঝুলে আছে একটা আয়তাকার ফ্রেমের সোনালী রঙের সরু চশমা। চেম্বারে ঢুকতেই চশমাটি চোখে দিয়ে হাতের ইশারায় টেবিলের সামনে রাখা চেয়ারে বসতে বললেন ওদেরকে।

বলুন, কি সমস্যা।

দিলীপ বলল, ছেলেটাকে নিয়ে এলাম। ও থ্যালাসিমিয়া পেশেন্ট।

আচ্ছা, কাগজপত্রগুলো দিন।

সুমনের পুরো ফাইলটা ডাক্তারের সামনে এগিয়ে দেয় দিলীপ। ডাক্তার ফাইলে রাখা বারডেম, পিজি হাসপাতাল, সিএমএইচ, কোঠারি হাসপাতাল-এর রিপোর্টগুলো গভীর মনোযোগ দিয়ে সময় নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন। তারপর সুমনকে টেবিলের ওপর শুইয়ে দিয়ে মাথার চুল থেকে পা পর্যন্ত নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে চেয়ারে এসে বসেন।

অনেকদিন হলো কোনো ডাক্তারকে দেখাচ্ছেন না দেখছি।

দিলীপ বলল, ডাক্তারের কাছে গিয়ে আর লাভ কি বলুন? যার কাছে গিয়েছি তিনিই বলে দিয়েছেন এ রোগের কোন ট্রিটমেন্ট নাই। নিয়মিত ব্লাড দিতে হবে, এটাই চিকিৎসা। তাই আর যাইনা, শুধু মাসে মাসে গ্রীনরোডে থেলাসিমিয়া হাসপাতালে যাই ব্লাড দেয়ার জন্য।

ডাক্তার বললেন, এটা ঠিক নয় মিস্টার। ব্লাড দেয়াকে ইনজেকশন পুশ করার মতো মনে করলে চলে না। একটু এদিক-সেদিক হলে বিপদের আশঙ্কা থাকে। যাক, আমার কাছে আসলেন কিভাবে?

এবার সুনয়না বলল, তিন-চার মাস আগে হাসপাতালে ব্লাড দেয়ার সময় এক ভদ্রলোক আপনার ঠিকানাটা দিলো।

তার পরিচয় কি জানেন?

না, আমরা জানিনা।

ঠিক আছে। এ ধরণের কেস্ নিয়ে অনেকেইতো আমার কাছে আসেন, হয়তো এদের মধ্য থেকে কেউ একজন হবে। ডাক্তার কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে ফাইল থেকে তথ্যাদি কম্পিউটারে এন্ট্রি দিতে থাকেন। কিছুক্ষণ পর একটা প্রিন্টকপি বের করে দিলীপের হাতে দিয়ে বললেন, ছেলেকে একদিন এই হাসপাতালে রাখতে হবে। তিনটি ইনজেকশন দিতে হবে, তারপর থেকে বাসাতেই ট্রিটমেন্ট চলবে। প্রেসক্রিপশনে লেখা ঔষধগুলো নিয়মিত খাওয়াতে হবে আর ফলোআপ চিকিৎসার জন্য প্রতিমাসে একবার আমার কাছে আসতে হবে। আর হ্যাঁ, আমার পরামর্শ ছাড়া এখন থেকে আর ব্লাড দেবেন না।

ডাক্তারের কথায় সুনয়না আতকে ওঠে, স্যার, ব্লাড বন্ধ করলেই ওর শরীর একেবারে সাদা ফ্যাকাশে হয়ে যায়!

সুনয়নার আশঙ্কার কথায় ডাক্তার সামান্য বিরক্ত হন, আহ্, ভয় পাচ্ছেন কেনো? আমিতো নিষেধ করিনি, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রয়োজন হলে দেবো। তবে আপনাদের ধৈর্য ধরতে হবে, আমার ওপর ট্রাস্ট রাখতে হবে। আল্লাহ্ আপনাদের ওপর সহায় হোন।

দোদল্যমান মন নিয়ে বাসায় ফিরে এসে কাতর কণ্ঠে সুনয়না বলল, এখন কী করবে?

দিলীপ বলল, আমি কিন্তু সাহস পাচ্ছিনা সুনয়না।
তোমার কি মনে হয় জানিনা, ডাক্তারের বডি ল্যাংগুয়েজ আমার কাছে পজেটিভ মনে হচ্ছে। মাত্রতো ব্লাড দিলাম, দেখিনা একটি মাস অপেক্ষা করে।

সুনয়নার মনের জোর দেখে অবাক হয় দিলীপ। ডাক্তারের পরামর্শমতো চিকিৎসা চালাতে থাকে। পনের-বিশ দিন অতিক্রান্তের পর সুমনের শরীরের অনেকটাই উন্নতি লক্ষ করে ওরা। রক্ত পরীক্ষায় দেখা যায় হিমোগ্লোবিন বাড়ছে ক্রমশ। ঘটনার আকস্মিকতায় নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে সুনয়না। ওপরের দিকে দু’হাত তুলে কান্নায় লুটিয়ে পড়ে সে। দিলীপও তাকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদতে থাকে।

সুনয়না কান্না জড়িত কণ্ঠে বলল, জানো, আজ আমার খুব কষ্ট হচ্ছে লোকটার ঠিকানা রাখলাম না। তাঁর পায়ের ধুলোটা পর্যন্ত নিতে পারলাম না। আচ্ছা, তুমিই বলো না লোকটা কে? কেনো গায়ে পড়ে আমাকে ডাক্তারের ঠিকানা দিলো? আমি তাঁকে গুরুত্ব দিলাম না, আবারও দৌঁড়ে নিচে নেমে এসে ঠিকানাটা দিলো। তাঁকে তো এখন আমার খুবই প্রয়োজন। তুমি বলো না কে তিনি, কোথায় পাবো তাঁকে?

দিলীপ ভাঙা গলায় বলল, সুনয়না তুমি কষ্ট পেয়ো না, আমরা কোথাও তাঁকে খুঁজে পাবো না। তিনি স্বয়ং…

সুনয়না প্রায়শই ছেলেকে জাপটে ধরে তার ভেতর সেই লোকটিকে খুঁজে ফেরে। তাঁর পরিচয়টা রাখার প্রয়োজন মনে করলো না কেনো- এ দুঃখ তাকে সর্বক্ষণই তাড়িয়ে বেড়ায়, হয়তো তাড়িয়ে বেড়াবে আমৃত্যু।

জগত বড়ই রহস্যময়। প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়ে দৈত্যাকার জাহাজের ভেতরে হাজার হাজার মানুষের সলিল সমাধি হয়, কিন্তু নবজাতক শিশুটি বেঁচে থাকে অবলীলায়। পৃথিবীতে মানুষের কোনোই ক্ষমতা নেই, সে নিমিত্ত মাত্র। তিনি যখন যা মনে চায় করেন, তাঁর ইচ্ছের বাইরে কারোরই কিছু করার নেই।
০০০

Print Friendly

Related Posts