এম মনজুরুল ইসলাম
‘চলে গেলে- তবু কিছু থাকবে আমার/আমি রেখে যাব আমার একলা ছায়া, হারানো চিবুক, চোখ, আমার নিয়তি!’ এমন অসংখ্য কাব্যকথা বলা সত্তুর দশকের রোমান্টিক কবি আবুল হাসান মাত্র আটাশ বছর বয়সে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিলেন দুরারোগ্য হার্ট এনলার্জে আক্রান্ত হয়ে। শিশুবেলার রিউম্যাটিক জ্বরই যে কবির হৃৎপিণ্ডকে তিলতিল করে ক্ষয় করবে- সে ভাবনা কারোরই ছিল না। তাছাড়া রাতের পর রাত জেগে থাকা, অপরিমিত খাওয়া দাওয়ার বদ অভ্যাসই তার জীবনাচারকে তিরিশটা বসন্ত পেরুতে দেয়নি।
কে জানত- ক্ষণজন্মা এই কবি সাহিত্যপ্রেমীদের হৃদয়ে খুব কম সময়েই জায়গা করে নিতে পারবেন! তিনি নিঃসঙ্গতা ও একাকীত্বকে একটু বেশিই ভালোবাসতেন বলে দক্ষ হাতে তা তুলে ধরতেন তার কবিতার বুননে। উড়নচণ্ডী স্বভাবের এই মানুষটি জীবন সম্পর্কে খুব একটা সচেতন ছিলেন না। তাই বোধ হয় দুরারোগ্য ব্যাধি তাকে খুব সহজে অল্প বয়সেই গ্রাস করে ফেলেছিল। পড়ালেখাও খুব একটা ভালো লাগত না তার। তারপরেও তিনি মেধাবী ছিলেন।
১৯৬৫ সালের কথা তখন। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা চলছিল বরিশাল বিএম কলেজ কেন্দ্রে। জীববিজ্ঞান দ্বিতীয়পত্র পরীক্ষা ছিল সেদিন। হালকা পাতলা গড়নের আবুল হাসান মূল খাতা বাদ দিয়ে পাশের সিটের ওপর নিশ্চিন্ত মনে কবিতা লিখছিলেন। এভাবে এক ঘন্টা শেষ হয়ে যাওয়ার পর পরবর্তী দুই ঘন্টা মনোযোগ সহকারে পরীক্ষা সম্পন্ন করেছিলেন সেদিনকার আবুল হাসান। অবশ্য কৃতিত্বের সাথে দ্বিতীয় বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে অনার্সে ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংলিশ ডিপার্টমেন্টে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েই কবি গভীরভাবে কবিতার দিকে ঝুঁকে পড়েন। এ সময় তিনি তখনকার নামকরা তরুণ কবিদের গা ঘেঁষা হতে থাকেন। আস্তে আস্তে তিনি এগোতে থাকেন লেখালেখির বলিষ্ঠ চিলেকোঠায়। সেসময়কার ঘটনা আরও বিস্তর, আরও রোমান্টিক।
ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপিকা ড. সুরাইয়া খানম দেখতে ছিলেন চরমমাত্রার রূপবতী। সুন্দরের সব গুণাবলি তাঁকে সবদিক থেকে স্পর্শ করেছিল। তাকে একনজর দেখার জন্য ক্লাস না থাকলেও ছাত্র/ছাত্রীরা ডিপার্টমেন্টের সামনে অকারণে ঘোরাফেরা করত। সবাই তাকে ভালোবাসতে চাইত। কিন্তু তিনি ভালোবাসতেন সত্তুর দশকের রোমান্টিক কবি ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র আবুল হাসানকে। তিনি ছাত্রর প্রেমে পড়েছিলেন। মানে আবুল হাসানের। তার রোমান্টিক কবিতাগুলো সুরাইয়া ম্যাডামকে আকৃষ্ট করেছিল ভীষণভাবে। ব্যাপারটা তখনকার সবাইকেই বিনোদিত করত।
একবার কবি আবুল হাসান লাইব্রেরিতে বসে সবার সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছিলেন। কবি মাকিদ হায়দারও ছিলেন সেখানে। সদ্য চাকরি পেয়েছেন মাকিদ হায়দার তখন। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা গাড়ি এসে থামল। সুরাইয়া ম্যাডামের গাড়ি। আবুল হাসানকে সেখান থেকে উঠিয়ে নিলেন গাড়িতে। লং ড্রাইভে বের হবেন তিনি। মাকিদ হায়দার আবুল হাসানের হাতে গোপনে দশ টাকা গুজে দিয়েছিলেন। ছাত্র-শিক্ষিকার দারুণ রসায়ন ছিল ওটা। হয়তোবা ইতিহাসও!
সুরাইয়া খানম আবুল হাসানকে তার উড়নচণ্ডী জীবন থেকে বশে আনতে চাইতেন। আর তাই আবুল হাসানের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু কবি নির্মলেন্দু গুণকে সহ্য করতে পারতেন না। কারণ সুরাইয়া খানম ভাবতেন- কবির সঙ্গে কবির বন্ধুত্ব চিরকাল ভবঘুরেদের বহিঃপ্রকাশ। একসময় আবুল হাসান ও নির্মলেন্দু গুণের বন্ধুত্বে চিড় ধরেছিল সুরাইয়া খানমের জন্যই। এখান থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে- যুগে যুগে কবিতা-গল্প মানুষের মনের খোড়াক ছিল, মনকে আকৃষ্ট করার ব্যতিক্রমী পন্থা ছিল।
চাপা স্বভাবের কবি হাসান তাঁর একটা কবিতায় লিখেছিলেন- ‘যেখানেই যাই সেখানেই রাত/স্টেডিয়ামে খোলা আকাশের নিচে রেস্তোরাঁয়, অসীমা যেখানে তার অত নীল চোখের ভিতর, ধরেছে নিটোল দিন নিটোল দুপুর, সেখানে গেলেও তবু আমার কেবলই রাত/আমার কেবলই শুধু রাত হয়ে যায়!’
তবে কি আবুল হাসান সুরাইয়া খানমকে ভালোবেসেছিলেন? ভালোবেসে কষ্ট পেয়েছিলেন খুব? তিনি তো জীবন সম্পর্কে উদাসীন ছিলেন! কবির কষ্ট পাওয়াটা অমূলক ছিল না হয়তোবা!
১৯৭০ সালে এশিয়াভিত্তিক কবিতা প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করা কবি আবুল হাসান সম্পর্কে কবি ও সাহিত্য সমালোচক আবু হেনা মোস্তফা কামাল বলেছিলেন- ‘যদি চূড়ান্ত ব্যবচ্ছেদ করা যায় আবুল হাসানকে, তাহলে তার ভেতরে মায়া-মমতা এবং মানুষের জন্য দুঃখবোধ ব্যতীত আর কিছুই পাওয়া যাবে না!’
কবি শামসুর রাহমান আবুল হাসানকে মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত একজন কবি, কবি এবং কবি ছাড়া কিছুই ভাবতেন না।
কবি আবুল হাসানের প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা খুব বেশি ছিল না। তিনটি কাব্যগ্রন্থ, একটি গল্প সংকলন, একটি কাব্যনাট্য। এটুকুই আবুলকে করে তুলেছিল সবার কাছে গ্রহণযোগ্য। ১৯৬৯ সালের গণ অভ্যুত্থানের বিপর্যস্ত সময়ে তিনি অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা শেষ না করেই ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে বের হয়ে দৈনিক ইত্তেফাকের বার্তা বিভাগে যোগ দেন। তখন কবি কবিতা ছাড়া আর কোনো কিছুই ভাবতে পারতেন না বলেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। নিজেকে সম্পূর্ণভাবে ঢেলে দিয়েছিলেন কবিতার মাঝেই। এরপর একে একে যোগ দেন গণবাংলা পত্রিকা, গণকন্ঠ ও জনপদ পত্রিকায়। তবে কোনো পত্রিকাতেই তিনি একটানা বেশিদিন কাজ করেননি।
১৯৭০ সাল ছিল কবি আবুল হাসানের জন্য একটি বিশেষ বছর। এই বছর বাংলা ভাষায় প্রকাশিত ‘পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিতা’ শীর্ষক গ্রন্থে তদানিন্তন পাকিস্তানের একমাত্র প্রতিনিধি কবি আবুল হাসানের কবিতা স্থান পায়। তিনি বিশেষ পুরস্কার লাভ করেন। পরবর্তীতে পুরস্কার পাওয়া কবিতাটি কলকাতা থেকে প্রকাশিত সমগ্র পৃথিবীর প্রতিনিধিত্বশীল কবিদের কবিতা-সংকলনে অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্তু সব থেকে মর্মান্তিক খবর হলো- ১৯৭০ সালে এত প্রাপ্তির মাঝেও আবুল হাসানের হার্ট এনলার্জ (হৃৎপিণ্ড সম্প্রসারণ) রোগটির পজিটিভ রিপোর্ট আসে। আবুল হাসান অসুস্থ। বুকের ব্যথাটা বেড়েছে। তাকে দেখার জন্য সবাই ভিড় করছে। কিন্তু আবুল কাউকে কিছুই বলছেন না। কারণ তিনি চাপা স্বভাবের ভীষণ। সবকিছু নিজের মধ্যেই রাখতে ভালোবাসতেন।
নির্মলেন্দু গুণ কবিকে বললেন- ‘কী হয়েছে তোমার হাসান?’ তিনি আগের মতোই হাসি দিয়ে অতি স্বাভাবিকভাবেই বলেছিলেন- ‘গুণ দা, আমার নাকি হৃদয় বড় হয়েছে!’ চলতে থাকে আবুল হাসানের চিকিৎসা। সরকারি খরচে তাকে চিকিৎসার জন্য জার্মানি পাঠানো হয়েছিল। তিনি একটু সুস্থ হয়ে ওঠেন। তার সাময়িক সুস্থতা দেখে শুভাকাক্সিক্ষরা কিছুটা আশ্বস্ত হন।
তিনি জার্মানি থেকে ফিরে এসে সুরাইয়া খানমের জন্য লিখেন- ‘তুমি আমার কাছে নতজানু হও, তুমি ছাড়া আমি আর কোনো ভূগোল জানি না/আর কোনো ইতিহাস কোথাও পড়িনি/আমার একা থাকার পাশে তোমার একাকার হাহাকার নিয়ে দাঁড়াও/হে মেয়ে, ম্লান মেয়ে তুমি তোমার হাহাকার নিয়ে দাঁড়াও!’ তবে কি আবুল হৃদয় দিয়ে ভালোবাসতেন ম্যাডামকে? নাকি এটাও তার জীবনের মতোই চরম খামখেয়ালিপনা?
অসুস্থ অবস্থাতেই ১৯৭২ সালে আবুল হাসানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রাজা যায় রাজা আসে’ প্রকাশিত হয়। তার কিছু দিন পরেই বের হয় দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘যে তুমি হরণ করো’ এবং হাসপাতালের বেডে শুয়েই আবুল ‘পৃথক পালঙ্ক’ নামক তৃতীয় কাব্যগ্রন্থের পাÐুলিপি প্রস্তুত করেন। আবুল হাসান মূলত কবি হলেও বেশ কিছু ছোট গল্পেও হাত দিয়েছিলেন। যা তিনি জীবিত থাকা অবস্থায় বই আকারে প্রকাশিত হয়নি। ‘ওরা কয়েকজন’ নামক একটা কাব্যনাটকও লিখেছিলেন তিনি। তারপর কেটে যায় অনেকগুলো বছর। ধীরে ধীরে তিনি নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন।
১৯৭৪ সালের কথা। ঢাকা পিজি হাসপাতালের চিকিৎসায় যখন কোনোভাবেই আবুল হাসান সুস্থ হয়ে উঠছিলেন না, তখন ডাক্তাররা তাকে বিদেশে পাঠানোর পরামর্শ দেন। বন্ধু-বান্ধব ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় তাকে বিদেশেও নেওয়া হয়। চলতে থাকে তার চিকিৎসা। তারপর বিদেশের চিকিৎসা শেষে ফিরে এসে কিছু দিন ভালো থাকলেও ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে তিনি কঠিন অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে আবার পিজি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মুমূর্ষু অবস্থাতেও আবুল বেশ কিছু কবিতা লিখেছিলেন।
কোনো একসময় কবি লিখেছিলেন- ‘মৃত্যু আমাকে নেবে, জাতিসংঘ আমাকে নেবে না/আমি তাই নিরপেক্ষ মানুষের কাছে, কবিদের সুধী সমাবেশে!’ অবশেষে ওই বছরের ছাব্বিশে নভেম্বর কবি আবুল হাসানকে জাতিসংঘ না নিলেও, মৃত্যু ঠিকই তাকে নিয়ে গেছে সকলের অগোচরে। তিনি তার সৃষ্টিকর্মে জীবিত আজও। একজন আবুল হাসান মানে রোমান্টিকতা, একজন আবুল হাসান মানে সুরাইয়া খানমদের কাছে আত্মার প্রশান্তি!