আতাতুর্ক কামাল পাশা
ইদানিং বাংলা সাহিত্যে ঐতিহ্য নামের একটি ধারাবাহিকতা অনেকটা মুছতে শুরু করেছে। তবে কেউ কেউ এ ধারা ধরে রেখেছেন। শুধু বাংলা সাহিত্যে কেন, বাইরের দেশের বিভিন্ন ভাষার সাহিত্যে কাব্যে, উপন্যাসে ঐতিহ্যের অনুসরণ বা ঐতিহ্যকে সামান্য হলেও বরণ করে নেওয়ার ইচ্ছেগুলো হারিয়ে যাচ্ছে প্রায়।
নোবেলখ্যাত স্বয়ং নাগিব মাহফুজ ওয়েডিং সঙ নাটককে উপন্যাস হিসেবে বলেছেন। বেলারুশের স্ভেতলানা তো প্রায় সাংবাদিকতার রির্পোট দিয়েই নোবেল পেলেন। বাংলা সাহিত্যে নতুন যারা লেখা নিয়ে আসছেন, তারাও উত্তরাধুনিকের নামে নিজেদের মনগড়া ঢেউ তুলছেন সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায়। কিন্তু তা স্রোতের মতো বা কোন প্রবাহ নিয়ে বেশি দূর যেতে পারছে না। এদের মধ্যে ৯০ দশকের লেখক মিলু শামস কিছুটা ব্যতিক্রম।
ইতোমধ্যে মিলু শামস-এর সাতটি বই প্রকাশ পেয়েছে। তিনটে কবিতার বই। প্রথম প্রকাশিত ‘নিরুপায় বৃত্ত’ কাব্যগ্রন্থটি গতানুগতিকের বাইরে প্রসারিত কিছু কবিতা। শীতের সকালের উদাহরণ, প্রকৃতির বর্ণনা, জীবনযুদ্ধ নিয়ে অনেক কিছুই এক কবিতায় উঠে এসেছে। কিন্তু সচরাচর আমরা যে পরিচিত গণ্ডির মধ্যে থেকে লিখি তিনি সেই গণ্ডির সামান্য বাইরে বের হতে পেরেছেন বলে দেখা যায় এ কাব্যে।
তার অন্যান্য কবিতাও কিছুটা ভিন্নমাত্রায় প্রবহমান। তিনি উদাহরণ দেন কিন্তু এক গণ্ডিতে বেশিক্ষণ আবদ্ধ থাকেন না। এমনও অনেক সময় দেখা যায়, কবিতায় তার কবিতা যখন বলা শেষ হয়ে যায়, তখনি তিনি কবিতা লেখা শেষ করেন।
বাংলা সাহিত্যে নতুন যারা লেখা নিয়ে আসছেন, তারাও উত্তরাধুনিকের নামে নিজেদের মনগড়া ঢেউ তুলছেন সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায়। কিন্তু তা স্রোতের মতো বা কোন প্রবাহ নিয়ে বেশি দূর যেতে পারছে না। এদের মধ্যে ৯০ দশকের লেখক মিলু শামস কিছুটা ব্যতিক্রম।
বোধকরি সাহিত্যজ্ঞানে ঋদ্ধ হয়েই তিনি লেখালেখির জগতে আসেন। যদিও বিদ্যালয় জীবন থেকেই তিনি লিখে আসছেন। তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকত্তোর। তরুণ লিখিয়েদের প্রবন্ধ সাহিত্য নিয়ে মাতামাতি করতে খুব বেশি উৎসাহ দেখা যায় না। তবে নব্বইয়ের প্রতিনিধি মিলু শামস প্রবন্ধ নিয়েও কাজ করেছেন। বলতে গেলে বিষয়ের দিক দিয়ে কঠিন বিষয়কেই তিনি বেছে নিতেন।
ইতোমধ্যে তার দু’টি প্রবন্ধের বই প্রকাশ পেয়েছে। ১] আবদ্ধ সময় এবং মুক্তবুদ্ধির চর্চা, ২] আতঙ্কের পৃথিবীতে এক চক্কর। বই দু’টি তার প্রবন্ধ সাহিত্যের প্রতি নিবেদিত বুদ্ধিদীপ্ততার সদাচারণ বলেই বিবেচিত হয়। ‘আবদ্ধ সময় এবং মুক্তবুদ্ধির চর্চা’য় তিনি এতো প্রগতিশীল বুদ্ধিবাদীতার চর্চা করেছেন যা আমাদেরও প্রগতি চিন্তাকে তীক্ষ্ণ করে।
তার আর একটি স্মৃতিচারণমূলক বই ‘অতসীর স্কুল’। অনবদ্য বই এটি। শৈশবের বিভিন্ন ঘটনা সাজিয়ে, গ্রামে আত্মীয়ের বাড়ির দৃশ্য, এখানে ঝড়-বাদলের দিনের দৃশ্যগুলো, ছোটবেলার আম কুড়ানোর দিনগুলো, সে দিনের বায়োস্কোপ, গীর্জার পাদ্রীদের শিশুদের প্রতি ভালবাসা মিলিয়ে এমনভাবে অতীতের দিনগুলোকে, গ্রামের দৃশ্যগুলোকে তুলে ধরতে পেরেছেন- পড়তে পড়তে যে কোন পাঠক এ দিনগুলোকে নিজের শৈশবের দিন বলে ভাবতে থাকবেন। কারণ, এখানে যেভাবে তিনি লেখনী ধরেছেন সেখানে একধরণের নৈর্ব্যক্তিক বুদ্ধিমত্তা প্রবলভাবে কাজ করেছে। এসব লেখায়, দৃশ্যপটে প্রকৃতি, মানুষের স্বাজাত্যবোধ, আগেকার দিনের মানুষের মাঝের সদ্ভাব, অনুন্নত জনপদ এমনভাবে উঠে এসেছে, পড়লে স্বভাবতই অনেকের মনে হবে যেন তার নিজেরই ছেলেবেলার কাহিনী এসব।
আজকের দিনে খুব সহজেই এবং অল্প সময়েই বই মুদ্রণ সম্ভব। বই ছাপাতে লেখক হিসেবে বেশি পরিচিতিরও তোয়াক্কা করেন না অনেকেই। তাই প্রতি বছর বইমেলায় নতুন নতুন অনেক বেশি বই আসছে। কিন্তু প্রমিত উচ্চারণ খুব কমই হচ্ছে। এদিক দিয়ে মিলু শামস দায়িত্বহীনতার পরিচয় দেননি। তিনি যা লিখছেন, তা দায়িত্ব নিয়েই, ছাকুনিতে ছাকনি দিয়ে প্রকৃষ্ট বলে নিজের কাছে প্রতীয়মান হলেই তা পাঠকদের জন্য বারকোশে তুলে দিচ্ছেন। তবে বয়সে বেশ তরুণ। জাতীয় দৈনিক জনকণ্ঠে সহকারী সম্পাদকের পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন।
১২ নভেম্বর তার জন্মদিন। যুগসচেতন সাহিত্যিক মিলু শামসকে আমাদের অফুরন্ত শুভেচ্ছা।