৯ বছরেও জানা যায়নি সিক্স মার্ডারের নেপথ্যে কারা

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ৯ বছরেও রাজধানীর গোপীবাগে ঘটে যাওয়া ৬ খুনের কোনো কূল কিনারা করতে পারেনি। খুনের নেপথ্যে কারা কিংবা কি উদ্দেশ্য খুন, তাও তাদের অজানা। যার ফলে মামলাটি অনেকটাই থমকে আছে। বিচারের অপেক্ষা ফুরাচ্ছে না স্বজনদের।

২০১৩ সালের ২১ ডিসেম্বর গোপীবাগের বাসায় লুৎফর রহমান ফারুকসহ ছয়জন খুন হন। সেই ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্ত ৮ বছরেও শেষ হয়নি। কবে শেষ হবে তাও বলতে পারছেন না তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। এ পর্যন্ত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য প্রায় ১১৭ বার সময় নিয়েছে বিভিন্ন তদন্ত সংস্থা।

থানা পুলিশ, গোয়েন্দা পুলিশের হাত ঘুরে মামলাটি বর্তমানে তদন্ত করছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। সর্বশেষ গত ১২ ডিসেম্বর মামলাটির তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ধার্য ছিলো। কিন্তু এদিন কাউন্টার টেররিজম ইউনিট প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেনি। ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মেহেদী হাসান আগামী ১৩ জানুয়ারি প্রতিবেদন দাখিলের পরবর্তী তারিখ ধার্য করেছেন।

মামলা সম্পর্কে বাদী ও নিহত লুৎফর রহমান ফারুকের ছেলে আব্দুল্লাহ আল ফারুক বলেন, ৮ বছর হয়ে গেল পাঁচটি পরিবার ৬ জনকে হারিয়েছি। বিচার তো দূরের কথা, এখনো মামলার তদন্তই শেষ হলো না। মামলার কোনো অগ্রগতি নাই। নতুন তদন্ত কর্মকর্তা আসে আবার চেঞ্জ হয়। এভাবেই চলছে মামলাটি। কবে শেষ হবে তদন্ত আর কবে বিচার পাবো।

তিনি বলেন, বাবাকে হারিয়েছি, বড় ভাই তাকেও হারিয়েছি। জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না। কিন্তু প্রিয় মানুষদের অভাব অনুভব হয় ক্ষণে ক্ষণে। ঘটনার কম সময় পার হয়নি। বিচারের জন্য কম জায়গায় যাইনি, কম ঘুরিনি। বিচারের আশা করতে করতে শেষ হয়ে যাচ্ছি। হতাশা ছাড়া আর কিছুই পাচ্ছি না। তবু যাই হোক না কেন বিচার চাই।

আব্দুল্লাহ আল ফারুক বলেন, সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনী, উপস্থাপক মাওলানা ফারুকী হত্যাসহ অনেক আলোচিত মামলার তদন্তই শেষ হচ্ছে না। এখন দেখা যায়, দেশে কোনো কিছু ফেসবুকে ভাইরাল হলে এর বিচার হয়। অন্যথায় আমাদের মত অবস্থা হয়।

মা সালমা বেগমের প্রসঙ্গে আব্দুল্লাহ আল ফারুক বলেন, স্বামী-সন্তান হারানোর কষ্ট কেউ ভুলতে পারে না। মায়ের ক্ষেত্রেও সেটা হয়েছে। মা এখনো কাঁদেন তাদের জন্য। আশায় আছেন, হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক সাজার।

মামলাটির তদন্ত কবে শেষ হবে বলতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিটিটিসির পুলিশ পরিদর্শক (নিরস্ত্র) সোহরাব হোসেন বলেন, মামলার তদন্ত চলছে। এখনো খুনের আসল রহস্য উদঘাটন করা সম্ভব হয়নি। কোনো ক্লু নেই। কারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে, কারা খুন করেছে জানা যায়নি। আমাদের কাছে মামলাটি আসার আগে থানা পুলিশ, ডিবি পুলিশ তদন্ত করেছে। ঘটনা ঘটার পর পর জোরালো তদন্ত করলে রহস্য উদঘাটন করে এতদিন মামলার বিচার শেষ হয়ে যেতো। মাঝখানে একটা গ্যাপ পড়ে গেছে। গ্যাপ পড়ে গেলে তদন্ত করা কঠিন হয়ে যায়।’

তিনি বলেন,‘আমরা সন্দেহ করছি ঘটনাটি জেএমবি ঘটিয়েছে। কারণ এ ঘটনা যখন ঘটে তখন জেএমবির উত্থান ছিল। তারা সে সময় এরকম কয়েকটি হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। আমরা সম্প্রতি জেএমবি প্রধান জাহাঙ্গীর আলমকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করি। আদালত তার তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এখনো তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়নি। দেখি তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সে ঘটনার বিষয়ে কোনো ধারণা দিতে পারে কি না। যদি ধারণা দিতে পারে তাহলে মামলার একটা ভালো রেজাল্ট আসবে। এরপর যত দ্রুত সম্ভব তদন্ত শেষ করবো।’

পীর লুৎফর রহমান ফারুকসহ ৬ জন নির্মমভাবে খুনের ঘটনায় তার ছেলে আব্দুল্লাহ আল ফারুক ২০১৩ সালের ২১ ডিসেম্বর ওয়ারি থানায় মামলা দায়ের করেন।

মামলার এজাহারে বলা হয়, লুৎফর রহমান ফারুক পীর ছিলেন। তার অনেক মুরিদ ছিলেন, তারা বাসায় যাতায়াত করতেন। তিনি নিজেকে সবার কাছে ইমাম মাহদীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে দাবি করতেন। তার ধর্মীয় মতাদর্শের সঙ্গে প্রচলিত ধর্মীয় মতাদর্শের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে মতপার্থক্য ছিল। যার কারণে ইতিপূর্বে রাজধানীর বিবির বাগিচায় লুৎফর রহমানের ওপর হামলা চালানো হয় এবং গেন্ডারিয়া ও গোপীবাগে হামলার চেষ্টা করা হয়।

২০১৩ সালের ২১ ডিসেম্বর মাগরিবের নামাজের আগে ১০/১২ জন লোক ধর্মীয় বিষয়ে জানার জন্য এসেছে বলে জানায়। লুৎফর রহমান ফারুক সবাইকে দরবার ঘরে বসতে দিয়ে তাদের খাবারের ব্যবস্থার জন্য মুরিদ শাহিনকে বাজারে পাঠায়। এরপর সন্ধ্যা ৬টার দিকে লুৎফর রহমান ফারুক, তার বড় ছেলে সরোয়ার ইসলাম ফারুক, তার মুরিদ শাহিন, মজিবুর, মঞ্জুরুল আলম, রাসেল ভূইয়া-সবাইকে মুখে স্কটেপ দিয়ে মুখ আটকিয়ে, হাত-পা বেঁধে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়। একই সময় আসামিরা লুৎফর রহমান ফারুকের তাওই, আনোয়ার মিস্ত্রি ও অন্য একজন মুরিদকে হাত-পা-মুখ বেঁধে দরবার রুমে ফেলে রাখে। ঘটনার সময় আসামিদের একজন বলে, ওনার (লুৎফর রহমান ফারুক) আরেক ছেলে আছে আবদুল্লাহ, আবদুল্লাহ কোথায়? এরপর লুৎফর রহমান ফারুকের স্ত্রী ও তার পুত্রবধূর কাছে আসামিরা বলে যায়, ‘এই ছয়জনকে মারার অর্ডার ছিল, ৬ জনকে মারছি। তোরা যদি পুলিশ কিংবা মিডিয়ার কাছে মুখ খুলোস তাহলে তোদের অবস্থা ওদের মতো হবে।’

এদিকে আদালত সূত্র জানা গেছে, এ মামলায় এখন পর্যন্ত ১০ আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এরা হলেন- হাদিসুর রহমান সাগর, জুলফিকার বিন সাদ ওরফে আবু ওয়াক্কাস, মামুনুর রশীদ রিপন, সৈয়দ জিয়াউল ইসলাম ওরফে জিতু ওরফে নিরব ওরফে নিয়ন ওরফে হিমু, সৈয়দ আল আমিন, তরিকুল ইসলাম, আবু রায়হান ওরফে মাহমুদ ওরফে আ. হাদী, মো. আজমির অমিত ও মো. গোলাম সরোয়ার। সর্বশেষ গত ৯ ডিসেম্বর হলি আর্টিজানে জঙ্গী হামলা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি জাহাঙ্গীর হোসেনকে গ্রেপ্তার দেখানোসহ ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়। ১৯ ডিসেম্বর আদালত গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন মঞ্জুর করে তার তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

১০ আসামিই কারাগারে আছেন। এদের মধ্যে আজমির অমিত ও গোলাম সরোয়ার এ মামলায় জামিনে থাকলেও অন্য মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারেই আছেন।

 

Print Friendly

Related Posts