রাজকুমার শেখ
মাজেদ পাত বিলটার দিকে তাকিয়ে আছে। কোথাও জল নেই। এক সময় এই বিলে কত মাছ হতো। কত মানুষের জীবন – সংসার চলতো মাছ ধরে। এখানকার মাছের স্বাদই আলাদা। মাজেদের মুখে সে স্বাদ এখনো লেগে আছে। তার চোখের সামনেই সব বদলে গেল। ধীরে ধীরে পাতবিল শুকিয়ে এলো। পরিযায়ী পাখি গুলো উড়ে পালাল অন্য দেশে। এখানে শীতে কত পাখি এসে থাকত। মাছ খেতো। বালি হাঁস ধরে মাজেদ শীতের সকালে রান্না করে ধুকি দিয়ে তার ঝোল খেতো। বালি হাঁসের মাংস বড়ই সুস্বাদু। এই বিলে তারা ভেসে বেড়াতো। টলটলে জলে তাদের ডানা ভিজে থাকত। কখনো কখনো উড়ে গেলে তাদের ডানার জলে ভিজে যেত মাজেদ। শয়ে শয়ে বালি হাঁসের ডানার ঝাঁপটা। মাজেদ মাছ ধরতে ধরতে দেখতো ওদের ওড়া। সে মধুর দৃশ্য এখনো চোখে লেগে আছে তার। বুধি হালদার সে দৃশ্য দেখে মাজেদকে বলতো, ওরে মাজেদ, বালি হাঁস খেতি খুব ভালো নারে? তু তো ধুকি দিয়ে খাস। আমাদের ঘরে ও সব হয়না। তু একদিন করে আনিস। জান ভরি খাবরে মাজেদ।
মানুষটি এখন বেঁচে নেই। কথা গুলো তার বুকের তারে এখনো রিনরিন করে বাজে। বুধি হালদার খেতে ভালো বাসতো। মাজেদ পাত বিলে মাছ ধরতে এলে ওর জন্য কিছু না কিছু আনতো। তারও অভাবের সংসার। দুটো বাল -বাচ্চা নিয়ে কোনো রকমে দিন গুজরান করে। মাজেদের দুবেলা খাবার জোটে না। তবু তাদের বাঁচার ভরসা পাত বিলটা। এর বুকের গভীরে কত রুপোলী মাছ খেলা করে।সেই মাছ ধরে ওদের সংসার চলে। কাপাসডাঙ্গা, বেগুনবাড়ি, ওদিকে চলে গেছে ডুমনি নদী। এই ডুমনি নদীর দুপারে হিন্দু- মুসলিম এর বাস। পরব লেগেই থাকে। এখানে দুপারের মানুষ মিলে মিশে বাস করে। এক সময় বেগমবাটি ছিল বড় বন্দর। রেশম চাষ হতো এক সময়। ডাচ, ফরাসি, ইংরেজ আরও বহু বণিক আসতো এখানে। বিরাট জনপদ ছিল বেগুনবাড়ি অঞ্চল। যার এক সময় নাম ছিল বেগমবাটি।
মানুষের সুখ বেশি দিন থাকে না। কবে যেন সে চুপটি করে পালিয়ে যায়। তা কেউ বুঝতে পারে না। ভাবে মাজেদ।
তার বুকের গভীর থেকে একটা গরম দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। পাতবিলটা দেখে তার চোখে জল চলে আসে। কোথায় সব হারিয়ে গেল! মানুষের জীবন থেকে যা চলে যায় তা আর ফিরে আসে না। শুধু মনে করে ব্যথা পাওয়া। যতই সে ভুলে যাক। কোনো না কোনো সময় মনে পড়বেই পুরোনোকে। মাজেদের তাই আজ হয়েছে। যে বিলের জল কখনো শুখাইনি।আর আজ সেই বিল শুখিয়ে কাঠ। জমির পর জমিতে পাট দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টি নেই। কোথায় পাট জাগ দেবে? পাট জল না পেলে এক সময় জমিতেই শুকিয়ে নষ্ট হয়ে যাবে। খাল বিলে জমি থেকে কেটে এনে ফেলে। তারপর সাজিয়ে জলে ডুবিয়ে রাখে। পাটের ওপর মাটি দিয়ে ডুবাতে হয়। পাটের কদর আছে। তবে যে চাষি ভালো দাম পায় তা নয় কিন্তু।কখনো কখনো চাষির লোকসানও হয়।
মাজেদ এখন চাষে খাটে। বৃষ্টি না হলে পাট কাটা শুরু হবে না। কবে যে বৃষ্টি হবে কে জানে। মাজেদের কোনো কাজ নেই। সংসার আর চলছে না। বড়ই অভাবে আছে সে।
মাজেদের বুকটা কেমন টনটন করে ওঠে। বিলটাও কি তার মতো দুঃখী। সেও তো হারিয়েছে তার বুকের নীলজল। পাখি।মাছ। কচুরিপানা। কলমিলতা। আরও কতকিছু। কান্না শুধু তার একার না। কান্না পাত বিলেরও। তার বুকের ঢেউ হারিয়ে গেছে। মরা বিলের আর কি দাম আছে? তার বুকে সন্তানরা নেই। তার কান্না কি মাজেদ শুনতে পাচ্ছে? ডিঙি গুলো কবেই নষ্ট হয়ে গেছে। মাজেদের বাড়িতে এখনো ডিঙিটা রাখা আছে। পাতবিলে জল হলেই সে তার ডিঙি ভাসাবে। খুঁজে বেড়াবে বুধি হালদার কে। বালি হাঁসের ঝাঁক গুলোকে। পাতবিলের নীল জল ছুঁয়ে দেখবে। নেবে তার শীতল স্পর্শ। মন জুড়িয়ে যাবে। তার খরা মনে জল ঢুকবে একটু একটু করে। জীবনের মানেটা সে খুঁজে পাবে।
মাজেদ আরও কিছুক্ষণ বসে থাকে পাতবিলের পাড়ে। বেলা মরে আসে। খোদার আকাশে কোথাও একফোঁটা মেঘ নেই। মাটি জল চায়। পাতবিলে কবে যে জলের ধারা নামবে কে জানে।
মাজেদ একসময় বাড়ির দিকে পা বাড়ায়।
দুই–
ওগো– শুনছো কালুর বাপ!
মাজেদ বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। ওর বউ নাছেরার ডাকে ও বাড়ির দিকে যায়।
কি হল নাছেরা? আমি পতেন মোড়লের জন্য দাঁড়িয়ে ছিলাম। যদি ওর জমিতে কাজ থাকে।
এ দিকি যে কালুর গা জ্বরে পুড়ি যাচ্ছি। তুমি একটা কিছু করো।
নাছেরা ব্যাকুল হয়ে বলে। কালু বেশ কদিন ধরে জ্বরে ভুগছে। গাঁয়ের ডাক্তারের কাছ থেকে ওষুধ এনে দেয়। কিন্তু তাতে কিছুই হয়নি। মাজেদ নাছেরার কথায় ও দিশেহারা। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। ও আবার ছুটে যায় গাঁয়ের ডাক্তারের কাছে। ধার করে ওষুধ এনে দেয়। ঘরেও খাবার কিছু নেই। ছেলেটাকে খালি পেটেই ওষুধ খাইয়ে দেয়। নাছেরা এক সময় পাশের বাড়ি থেকে চাল ধার করে আনে। দুটো ফুটিয়ে নিয়ে কালুকে খেতে দেয়। মাজেদ মাটির দাওয়ায় চুপ করে বসে থাকে। পাত বিলের মতো তারও সংসার শুকিয়ে গেছে। কি করবে ভেবে পায়না। পতেন মোড়ল একবার দেখা করতে বলেছিল। এবার নাকি পতেন মোড়ল ভোটে দাঁড়াবে। গাঁয়ের মানুষ বলা বলি করছে। সে কথা মাজেদের কানেও গেছে।
মাজেদ আর বসে থাকে না। নাছেরাকে বলে ও বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসে। পতেন মোড়লের বাড়ির কাছাকাছি এসে থামে ও। ওর বাড়ির সামনে বেশ কিছু লোকজন দাঁড়িয়ে আছে। মাজেদ ভাবে সামনে ভোট বলে হয়তো এরা এসেছে। অনেকেই ও চেনে। এ গাঁয়ে পতেন মোড়লকে সবাই মান্য করে। পতেন মোড়লই শেষ কথা। তবে ভোট হল মানুষের আপন মত।সে যাকে চায়বে ভোট দেবে। তবে পতেন যে দলের হয়ে দাঁড়াচ্ছে তা অনেকেই পছন্দ করে না। নানান রকম কানা ঘুষো চলছে। মাজেদ একটু দূরেই দাঁড়িয়ে থাকল। পতেন মোড়ল কে দেখা যাচ্ছে না। ওর বেশ বিড়ির নেশা পেয়েছে। কিন্তু তার কাছে তো বিড়ি নেই। মাজেদ এক পা এক পা করে গিয়ে দাঁড়ায় পতেন মোড়লের বাড়ির সামনে। ও যেতেই একজন বলল, আরে মাজিদ না? পতেন চাচা ডেকেছে বুঝি?
মাজেদ মাথা হেলায়। ছেলেটি একটি বিড়ি এগিয়ে দেয়। মাজেদ বিড়িটা ধরিয়ে একটা সুখটান দেয়। বড়ই আরাম বোধ করে। পেটে খিদে থাকলেও বিড়িটা এই মূহুর্তে ভালো লাগছে।
এমন সময় পতেন মোড়ল এক এক করে তার ঘরে ডাকলেন। সকলে দেখা করে চলে যায়। মাজেদ অপেক্ষা করতে থাকে। ওর ডাক এলেই ও গিয়ে বলবে কাজের কথাটা। যদি একটা কাজ পাওয়া যায়। সবাই চলে গেল।কিন্তু ওকে ডাকে না।
ও দাঁড়িয়ে থাকে। এমন সময় হঠাৎ ওর নাম ধরে পতেন মোড়ল ডাকে। মাজেদ চমকে যায় ওর নাম শুনে।
জী হুজুর, আসছি।
মাজেদ বলে কথাটা।
মাজু, আমি তুকে ডাকার কারনটা হল, গাঁয়ের খবর গুলো গোপনে আমাকে দিবি। জানিস তো আমি ভোটে দাঁড়াবো।
জী হুজুর।
শুধু শুধু জী হুজুর করলি হবে না। কাজ করতি হবি।
আপনি যে কাজ করতি দিবেন।
পতেন মোড়ল আর কথা না বাড়িয়ে একতারা নোটের বান্ডিল ওর সামনে রাখে। মাজেদের চোখ দুটো চকচক করে ওঠে। এক সঙ্গে এত টাকা কখনো সে দেখেনি। তার কালুর মুখটা মনে পড়ে। ছেলেটাকে সারিয়ে তুলতে হবে। পতেন মোড়ল ওকে টাকা গুলো দেয়। কাজের কথাও ওকে মনে করিয়ে দেয়।
তার আজ দুমুঠোতে টাকা। একবার যেতে যেতে টাকার গন্ধটা নেয়। কেউ দেখে ফেলবে বলে সে অন্য রাস্তা ধরে। কাজটা তার খুব সোজা মনে হয়ছে। পতেন মোড়ল এমন কিছু কঠিন কাজ দেয়নি।শুধু তাকে খবর জোগাড় করে দিতে হবে। বসিরের লোকজন অবশ্য জানতে পারবে না। ওরাই তো অনেক দিন পঞ্চায়েত দখল করে আছে। তার জন্য ভোটে কম জল ঘোলা হয়না। সে কথা জানে মাজেদ। মাজেদ অবশ্য সাতেপাঁচে থাকে না। তার মতো একজন ছাপোষা মানুষের কজন খোঁজ রাখে। যার জীবন সঙ্গী বলতে একটা ভাঙা ডিঙি। কতকাল তাকে আগলে রেখেছে। পাত বিল আবার যৌবনা হবে। তার বুকে মীন সন্তানরা ফিরে আসবে। সেই তো ভালো ছিল। ও কী সব কাজে জড়িয়ে পড়ছে! ওর রাস্তা আজ যেন শেষ হচ্ছে না। টাকার বান্ডিলটা লুঙ্গির মধ্যে জড়িয়ে ধরে সে হাঁটতে থাকে।
বেলা অনেক হল। তার খিদেটা এবার মোচড় দিয়ে ওঠে।
তিন–
বসিরের লোকজন মাজেদকে খুঁজছে। যত খবর পতেন মোড়ল কে সেই- ই দেয়। পতেন মোড়লের ভোটের বাজার বেশ ভালো। মানুষ তাকেই এবার আনতে চায়। মাজেদ ভয়ে লুকিয়ে থাকে। রাতে বাড়িতে থাকে না। নাছেরা আর তার অসুস্থ ছেলে কালু বাড়িতে থাকে। ওর বাড়িতে নজর রাখছে বসিরের লোকজন। মাজেদ পতেন মোড়লের বাড়িতে থাকছে।৷ প্রতি রাতেই বোম পড়ছে। গাঁয়ের লোক ভয়ে ভয়ে আছে। কার কপালে যে কি আছে কেউ জানেনা। বুথ দখল করে বসিরের লোকজন। মানুষ সরে যায় সেখান থেকে। কিন্তু এবার পতেন মোড়ল ওদের বলেছে শান্তি পূর্ণ ভোট করতে। ওরও লোকজন তৈরি। বসির প্রধান এবার চাপে আছে। ওদের ভেতরের খবর পতেন মোড়ল জেনে যাচ্ছে কি করে? বসির প্রধান মাজেদের নাম জেনে যাওয়ায় ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।
মাজেদ তার অসুস্থ ছেলেটাকে দেখতেও যেতে পারছে না।
ও আজ ভেবেছে রাতের অন্ধকারে গিয়ে দেখে আসবে।
রাত নামতেই ও বেরিয়ে পরে। বেশ অন্ধকার। আজ আকাশে চাঁদ নেই। পতেন মোড়ল ওকে যেতে বাড়ন করে। কিন্তু তার কথা শোনে না। মাজেদ এক সময় অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। বাড়ির কাছে আসতেই দেখছে হঠাৎ বোমের বিকট শব্দ। মাজেদের ঘরে আগুন জ্বলছে। নাছেরার চিৎকার শোনা যায়।
বাপ কালুরে —
মাজেদ ঝাঁপিয়ে পড়ে আগুনের ওপর। রাতের অন্ধকারে ডুবে গেল ভোরের আলো।
(মুশিদাবাদ, পশ্চিম বংগ)