টিপুকে হত্যা: ২০ সেকেন্ডের কিলিং মিশনে অংশ নেন দুজন

১২ রাউন্ড গুলি ছোড়ে খুনি, টিপুর শরীরেই লাগে ১০টি

আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপুকে চার-পাঁচদিন আগে মোবাইলে হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন। এর সপ্তাহ না পেরোতেই রাজধানীর ব্যস্তসড়কে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হলো তাকে।

বৃহস্পতিবার (২৪ মার্চ) রাতে শাহজাহানপুরে ইসলামী ব্যাংকের পাশে বাটার শো-রুমের সামনে এ কিলিং মিশনে অংশ নেন দুজন। মাথায় হেলমেট ও মুখে মাস্ক পরে তারা মোটরসাইকেলে আসেন। তাদের একজন চালক, অন্যজন পিস্তলধারী। মাত্র ২০ সেকেন্ডে কিলিং মিশন শেষে নির্বিঘ্নে পালিয়ে যান তারা।

পুলিশ বলছে, যে ব্যক্তি গুলি করেছেন, তিনি পেশাদারের চেয়েও পেশাদার। প্রকাশ্যে ব্যস্ত সড়কে এত কম সময়ে এতগুলো গুলি ছোড়া খুব সহজ ব্যাপার না। হত্যাকারীর ছোড়া ১২ রাউন্ড গুলির ১০টি জাহিদুল ইসলাম টিপুর গলা, বুক, পেট, কাঁধ, পিঠ, কোমরসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে বিদ্ধ হয়।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, টিপুকে শাহজাহানপুরে ইসলামী ব্যাংকের পাশে বাটার শো-রুমের ঠিক সামনে থেকে গুলি করা হলেও আগে থেকে তাকে নজরদারি করছিল আরও কয়েকজন। প্রাথমিকভাবে স্পষ্ট যে, এটি পরিকল্পিতভাবে হত্যাকাণ্ড। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটির নম্বর প্লেট ও মোবাইল ফোনে হত্যার হুমকি দেওয়া নম্বরের সূত্র ধরে এখন তদন্ত চলছে। এছাড়া ঘটনায় বেশকিছু ফুটপ্রিন্ট, আলামত ও সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা করা হচ্ছে।

 

সিসিটিভি ফুটেজে ২০ সেকেন্ডের কিলিং মিশন

 

ঘটনাস্থলের পাশের একটি বহুতল ভবনে বসানো সিসিটিভি ফুটেজে টিপু হত্যা মিশনের স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বৃহস্পতিবার রাত ঠিক ১০টা ২১ মিনিট ২০ সেকেন্ড। আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপুর ব্যক্তিগত সাদা রঙের নোয়াহ মাইক্রোবাসটি যানজটে আটকা পড়ে শাহজাহানপুর ইসলামী ব্যাংকের পাশে বাটার শো-রুমের ঠিক সামনে। এটি খিলগাঁও রেলগেট অভিমুখে যাওয়ার রাস্তা। এর ১০ সেকেন্ড আগে বিপরীত দিকের রাস্তা ধরে উল্টোপথে একটি মোটরসাইকেল আসে। মোটরসাইকেলটি শাহজাহানপুর রেলওয়ে হাফেজিয়া সুন্নীয়া আলিম মাদরাসা ও এতিমখানার সামনে এসে ঘুরিয়ে আবার রাজারবাগ অভিমুখে দাঁড় করান চালক। এর মধ্যে মোটরসাইকেলের পেছনে থাকা অস্ত্রধারী সড়ক বিভাজক পার হয়ে রাস্তার মাঝখানে অবস্থান নেন। এসময় রাস্তায় খুব ধীরগতিতে গাড়ি চলছিল। ১০টা ২১ মিনিট ৫০ সেকেন্ডে টিপুর গাড়ির বাম দিক দিয়ে একেবারে কাছে গিয়ে প্রথম গুলি ছোড়া হয়। আচমকা আক্রমণ দেখে টিপুর গাড়ির গতি বাড়িয়ে দেন চালক মুন্না। তবে সামনেই রিকশার জট থাকায় গাড়িটি বেশি দূর এগোতে পারেনি। গাড়ি থেকে কিছুটা পিছিয়ে পড়ায় হামলাকারী দৌড়ে সামনে এসে খুব কাছ থেকে গাড়ির সামনের আসনে বসে থাকা টিপুকে লক্ষ্য করে পরপর কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়েন। ওইসময় গাড়ির জানালার কাচ ভেদ করে গুলিবিদ্ধ হন টিপু। এসময় আশপাশের লোকজন আতঙ্কে ছোটাছুটি করতে থাকেন। ১০ সেকেন্ড টিপুকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন। এরপর আশপাশে এলোপাতাড়ি কয়েকটি গুলি ছুড়তে দেখা যায়।

গাড়ির খুব কাছ থেকে টিপুকে গুলি করা হয়। ছবি: সংগৃহীত

পরে টিপুর গাড়ির সামনে দিয়ে আবার সড়ক বিভাজক পার হয়ে রাস্তার উল্টো পাশে মাদরাসার সামনে দাঁড়ানো মোটরসাইকেলের দিকে চলে যান হত্যাকারী। রাত ১০টা ২২ মিনিট ১০ সেকেন্ডে দেখা যায়, মাইক্রোবাসের পেছনের আসনে বসে থাকা দুজন গেট খুলে বাইরে এসে মোটরসাইকেলটিকে ধাওয়া দিলে হত্যাকারীরা পালিয়ে যান। এরপর মাইক্রোবাসটি ঘিরে ধীরে ধীরে লোকজন জড়ো হতে থাকে।

 

বন্ধ ছিল এলাকার সব মার্কেট

 

হত্যাকাণ্ডের ঘটনার ঠিক উল্টোপাশে ফুটপাতের চা দোকানি হাবিবুর রহমান বলেন, ‘বৃহস্পতিবার এখানকার (শাহজাহানপুর) সব মার্কেটের সাপ্তাহিক বন্ধের দিন। রাত ৯টার দিকে আমার চা দোকান বন্ধ করে বাসায় চলে যাই। সাড়ে ১০টার দিকে মানুষের চিৎকার শুনে বাসা থেকে বের হই। রাস্তায় এসে দেখি দুজনকে গুলি করা হয়েছে। এরপর তাদেরকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘বৃহস্পতিবার ওই এলাকার মার্কেট বন্ধ থাকে। এ কারণে হয়তো হত্যাকারীরা এ জায়গাটা বেছে নেয়। যাতে আশপাশের দোকানের সিসিটিভি ফুটেজে তারা ধরা না পড়ে। এ হত্যাকাণ্ডটি পূর্বপরিকল্পিত। মোটরসাইকেলে আসা দুজন ছাড়াও এ চক্রে আরও একাধিক ব্যক্তি থাকতে পারেন। জাহিদুল ইসলাম টিপু কখন, কোথা থেকে, কোন গাড়িতে আসছিল, সেগুলো টার্গেট করেছিল।’

 

নিহত টিপুর স্ত্রী যা বলছেন

 

জাহিদুল ইসলাম টিপুর স্ত্রী ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সংরক্ষিত ১১, ১২, ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে নির্বাচিত কাউন্সিলর ফারহানা ইসলাম ডলি। তিনি বলেন, ‘রাত সাড়ে ১০টার দিকে আমার মোবাইলে কল আসে। জানানো হয়, কে বা কারা আমার স্বামীকে গুলি করে হত্যা করেছে। ওর (টিপু) সঙ্গে ছিল মেরাজ (৫৫), আবুল কালাম (৬০) ও গারিচালক মনির হোসেন মুন্না (৩৪)। গাড়িটা আমাদের । মতিঝিল এজিবি কলোনির গ্র্যান্ড সুলতান রেস্টুরেন্টের কাজ শেষ করে বাড়িতে ফিরছিল সবাই।’ টিপুর স্ত্রী জানান, তার স্বামী গত ১০ বছর ধরে বৃহত্তর মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। সাধারণ সম্পাদক থাকাকালে দলীয় কোন্দল ছিল। পাশাপাশি গত ৫ বছর ধরে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের গর্ভানিং বডির সদস্য ছিলেন টিপু। মতিঝিল কাঁচাবাজারে গ্র্যান্ড সুলতান নামে তাদের একটি রেস্টুরেন্ট আছে। তার স্বামী ওই রেস্টুরেন্ট দেখাশোনা করতেন। চার-পাঁচদিন আগে টিপুকে মুঠোফোনে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়।

 

খুনিদের শনাক্তে কাজ করছে র‌্যাব

 

র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘খিলগাঁও রেলগেটের আগে জাহিদুল ইসলাম টিপুকে বহনকারী মাইক্রোবাসটি সিগন্যালে ছিল। সেই মুহূর্তে একজন দুষ্কৃতকারী হেলমেট ও মাস্ক পরা অবস্থায় মাইক্রোবাসটির বাম পাশ দিয়ে গুলি চালান। এতে জাহিদুল ইসলাম টিপু ও তার গাড়িচালক গুলিবিদ্ধ হন। এসময় মাইক্রোবাসের ডান পাশে রিকশায় প্রীতি নামে এক শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হন। স্থানীয়রা তাদের আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক টিপু ও ওই শিক্ষার্থীকে মৃত ঘোষণা করেন।’

খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বেশকিছু ফুটপ্রিন্ট, আলামত ও সিসিটিভি ফুটেজ পেয়েছি। এছাড়া বেশকিছু মোটিভ র‌্যাবের কাছে এসেছে। সেগুলো পর্যালোচনা করছি। যিনি গুলি করেছেন, তাকেও সিসিটিভি ফুটেজের মাধ্যমে শনাক্ত করার চেষ্টা করছি। র‌্যাব ছাড়াও পুলিশের একাধিক ইউনিট কাজ করছে।’

ডিসি আ. আহাদ বলেন, ‘মোটরসাইকেলে ছিলেন দুজন। একজন চালক, অন্যজন পিস্তলধারী। তিনি মূলত গুলি করেছেন। দুজনের মাথায় হেলমেট ও মুখে মাস্ক ছিল। এছাড়া আরও কয়েকজন তাদের সহযোগী আশপাশে থাকতে পারেন। যারা টিপুর গাড়ির গতিবিধির ওপর হয়তো নজর রাখছিল। ঘটনাস্থল থেকে ১২ রাউন্ড গুলির খোসা উদ্ধার করা হয়েছে। খুব কাছ থেকে গুলি করা হয়। যিনি গুলি করেছেন তিনি পেশাদারের চেয়েও পেশাদার।’

তিনি আরও বলেন, ‘চার-পাঁচদিন আগে নিহত আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপুকে একটি নম্বর থেকে ফোন করে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। কিন্তু টিপু কিংবা তার স্ত্রী ডলি পুলিশকে হুমকির বিষয়টি তখন জানাননি। তবে ওই নম্বরের সূত্র ধরে আমরা তদন্ত করে যাচ্ছি।’

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts