পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার কিলার মাসুম মোহাম্মদ আকাশ টেলিভিশনের খবর দেখে জানতে পারেন তার ছোড়া গুলিতেই প্রাণ হারিয়েছেন কলেজছাত্রী সামিয়া আফরান প্রীতি। বগুড়ায় মাসুমকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশকে তিনি এ কথা বলেছিলেন। গ্রেপ্তার অভিযানে অংশ নেওয়া বগুড়া সদর পুলিশ ফাঁড়ির উপ-পরিদর্শক (এসআই) খোরশেদ আলম এ তথ্য জানান।
সোমবার তিনি আরও জানান, গ্রেপ্তার হওয়ার পরই মাসুম আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপুকে গুলি করে হত্যার কথা স্বীকার করেন। আর কলেজছাত্রী সামিয়া নিহত হওয়ার বিষয়টি খুনের পরের দিন টিভিতে খবর দেখার পর জানতে পারেন এবং তার গুলিতেই নিহত হয়েছেন বলেও স্বীকার করেন।
তার উদ্দেশ্য ছিল বগুড়া হয়ে জয়পুরহাট দিয়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতে পালিয়ে যাওয়া। গ্রেপ্তারের আগের দিন রাতে চেষ্টা করেছিলেন ভারতে পালাতে কিন্তু বর্ডারে সমস্যার কারণে ওইদিন টপকাতে পারেননি। যে কারণে জয়পুরহাট সীমান্ত এলাকা থেকে আবার বগুড়ায় ফিরে আবাসিক হোটেলে আশ্রয় নেন। হোটেলে গ্রেপ্তার অভিযান চালাতে আর আধাঘণ্টা দেরি হলেই তাকে আটক করা যেত না বলে জানিয়েছে বগুড়া সদর থানা পুলিশ।
বগুড়ায় চারমাথা এলাকায় খাজা হাইওয়ে নামে হোটেলের রেজিস্টারে নাম-পরিচয় অ্যান্ট্রি না করেই রাত্রীযাপন করা মাসুম সকাল ৯টায় কক্ষ ছেড়ে চলে যেতেন। কিন্তু তার আধাঘণ্টা আগেই সকাল সাড়ে ৮টায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
আবাসিক হোটেলে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করতে গেলে নিজেকে মামুন বলে পরিচয় দেন। কিন্তু সদর থানা পুলিশের কাছে থাকা মাসুমের ছবির সঙ্গে চেহারার মিল থাকায় পুলিশ তাকে আটক করে। পরে পুলিশের সঙ্গে তর্কে না জড়িয়ে নিজের নাম-পরিচয় প্রকাশ করেন এবং ঠান্ডা মাথায় পুলিশের সঙ্গে হোটেল থেকে বের হয়ে আসেন।
সোমবার (২৮ মার্চ) বগুড়া সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সেলিম রেজা এ তথ্য জানিয়েছেন।
খাজা হাইওয়ে হোটেলের ম্যানেজার আইয়ুব আলী জানান, মোবাইল ফোন কোম্পানিতে চাকরি করেন রাজন নামে এক যুবক। তিনি মাঝেমধ্যেই হোটেলে থাকতেন। সেই সুবাদে রাজন হোটেলে সবার পরিচিত। শনিবার (২৬ মার্চ) হোটেলের ১১১ নম্বর কক্ষ ভাড়া নিয়ে অবস্থান করেন রাজন। তখন রাজন হোটেল কর্তৃপক্ষকে জানান ঢাকা থেকে তার এক বন্ধু আসবেন। তার জন্য একটি কক্ষ রাখতে বলেন। রাজনের কথায় হোটেল কর্তৃপক্ষ ৪০০ টাকা ভাড়ায় ১০১নং কক্ষটি ফাঁকা রেখে দেন। রাত সাড়ে ১২টায় রাজনের বন্ধু পরিচয়ে হোটেলে আসা যুবককে ১০১নং কক্ষের চাবি দেওয়া হয়। নাম-ঠিকানা পরে অ্যান্ট্রি করবেন এবং নিজের নাম মামুন শুধু এ কথা বলে তিনি রুমে চলে যান। আর রাজন রোববার সকাল ৭টার দিকে কক্ষ ছেড়ে দিয়ে রাজশাহী চলে যান।
খাজা হাইওয়ে হোটেলের এক কর্মচারী বলেন, শনিবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে একটি প্রাইভেট কারে করে হোটেলে আসেন মাসুম। প্রাইভেট কারে আরও দুইজন থাকলেও তারা মাসুমকে নামিয়ে দিয়ে চলে যান।
গত বৃহস্পতিবার (২৪ মার্চ) রাত ১০টার দিকে ঢাকার উত্তর শাজাহানপুর এলাকায় সন্ত্রাসীদের এলোপাতাড়ি গুলিতে নিহত হন আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু ও কলেজছাত্রী সামিয়া আফরান প্রীতি। এই জোড়া খুনের পর থেকেই পুলিশ শুটারকে ধরতে দেশব্যাপী অভিযান শুরু করে।
মাসুম সাত দিনের রিমান্ডে
রাজধানীর শাহজাহানপুরে আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম ওরফে টিপু ও রিকশারোহী কলেজছাত্রী সামিয়া আফরান প্রীতি হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে আটক মো. মাসুমকে সোমবার (২৮ মার্চ) সাত দিনের রিমান্ডে নিয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের মতিঝিল বিভাগের ডিসি রিফাত রহমান শামীম বলেন, আমরা আদালতে ১০ দিনের রিমান্ড চেয়েছিলাম। আদালত সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন।
কে এই শুটার মাসুম
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) একাধিক কর্মকর্তার কাছে জানা গেছে শুটার মাসুমের চমকপ্রদ কিছু তথ্য।
জানা গেছে, ছেলেবেলায় দারুণ মেধাবী ছিলেন তিনি। মাসুমের বাবা ছিলেন রাজধানীর সেগুনবাগিচা এলাকার একটি স্কুলের শিক্ষক। মা গৃহিনী। তিন-ভাইবোনের মধ্যে মাসুম দ্বিতীয়। রাজধানীর পশ্চিম মাদারটেক এলাকায় তাদের পরিবারকে সবাই শিক্ষিত ও ভদ্র বলেই জানে।
মাসুমের একাধিক পরিবেশীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রায় ১৫ বছর আগে হঠাৎ মাসুমকে বাসা থেকে বের করে দেন তার বাবা।
মাসুমের মা জানান, মাসুম তখন ছাত্রলীগে যোগ দিয়েছিলেন। রাতদিন বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতেন। এ নিয়ে বাবার সঙ্গে শুরু হয় মনোমালিন্য। শাসন-বারণ, অনুনয় সব যখন ব্যর্থ হলো তখন মনের কষ্টে মাসুমকে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বলেন তার বাবা।
সেই যে মাসুম বাড়ি থেকে বের হলেন আর ফিরে আসেননি। এরপর কেটে গেছে একে একে প্রায় ১৫ বছর। এরমধ্যে তিনি আর বাবা-মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেননি। বিয়ে করেছেন, সংসারে এসেছে সন্তান।
মাসুমের মা বলেন, মাসুমের বিয়ের খবর আমরা জেনেছি লোকমুখে। তার ছেলে না মেয়ে হয়েছে সেটাও আমরা জানি না।
পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর মাসুম হতাশায় ভুগছিলেন বলে ধারণা করছেন তার পরিবারের লোকেরা। কিন্তু মাসুম যে টাকার বিনিময়ে কাউকে গুলি করে হত্যা করার মতো মানসিক অবস্থায় চলে যেতে পারেন তা ভাবতে পারছেন না তারা।
এদিকে মাসুমের স্ত্রী দীনা পুলিশকে জানিয়েছেন, স্বামীর সঙ্গে তিন মাস ধরে তার বনিবনা কম ছিল। তাই বাসা ছেড়ে গোড়ানে বাড়িতে এসে থাকছেন।
ঢাকা মহানগর ডিবি সূত্রে জানা গেছে, শাহজাহানপুরে জোড়া খুনের আগে আকাশের নামে ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন থানায় মোট ৪টি মামলা ছিল। শুধুই আর্থিক সুবিধার জন্য নয়, মাসুমকে সেসব মামলা থেকে অব্যাহতি পাইয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে তাকে এই হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ত করা হয়। তবে কারা তাকে ভাড়া করেছিল তদন্তের স্বার্থে তা জানায়নি ডিবি।
ডিবি জানিয়েছে, হত্যার ঘটনার তিনদিন আগে অপরিচিত একজন এসে মাসুম ও তার সহযোগীকে মোটরসাইকেল ও অস্ত্র দিয়ে যায়। ২৩ মার্চ মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপুকে হত্যার পরিকল্পনা করেন মাসুম। তবে তা ব্যর্থ হয়।
পরেরদিন জাহিদুলকে তার রেস্টুরেন্টে হত্যা করতে যান। সেখানে ভিড় থাকায় জাহিদুলের গাড়ি অনুসরণ করে শাহজাহানপুরের আমতলা এলাকায় পৌঁছান মাসুম ও তার সহযোগী।
শাহজানপুর থানা সূত্রে জানা যায়, ২৪ মার্চ রাত ১০টার দিকে জাহিদুল মাইক্রোবাসে করে শাহজাহানপুর আমতলা কাঁচাবাজার হয়ে বাসায় ফিরছিলেন। শাহজাহানপুর ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের সামনে পৌঁছালে হেলমেট পরা দুর্বৃত্তরা তাকে লক্ষ্য করে ১২ রাউন্ড গুলি করেন। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান জাহিদুল। তার গাড়িচালক মনির হোসেন গুলিবিদ্ধ হন। এ সময় জাহিদুলের গাড়ির পাশ দিয়ে রিকশায় যাচ্ছিলেন বদরুন্নেসা কলেজের ছাত্রী সামিয়া আফরান প্রীতি। তিনিও গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।
টিপু হত্যা মামলার তদন্তের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত একাধিক কর্মকর্তা জানান, হত্যার পর ডিবির ছয় কর্মকর্তা ঘটনাস্থলে যান। তারা শুরুতেই একাধিক সিসিটিভি ফুটেজ দেখেন। কথা বলেন যারা ওই এলাকা সম্পর্কে খোঁজখবর রাখেন এমন বাসিন্দা ও পুলিশের সোর্সদের সঙ্গে। পাশাপাশি সিসিটিভি ফুটেজ ধরে চলে বিশ্নেষণ। এতে তারা প্রথমে একমাত্র শুটারের দৈহিক গড়ন ও উচ্চতা সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা নেন। গোয়েন্দারা দেখেন, শুটারের গড়ন, উচ্চতাও ৫ ফুট ৬ ইঞ্চির বেশি হবে। ফুটেজ বিশ্নেষণের পাশাপাশি প্রযুক্তিগত তদন্তও শুরু করেন তারা। এরপর ঘটনার প্রথম রাতেই ওই এলাকার এক ব্যক্তির খোঁজ পান। তথ্য জানতে তাকে ডেকে আনা হয় গোয়েন্দা হেফাজতে। ওই ব্যক্তি মাসুমের দীর্ঘদিনের পরিচিত। ওই রাতে গোড়ান ক্লাবে মাসুমের অস্বাভাবিক আচরণের কিছু বর্ণনা গোয়েন্দাদের দেন তিনি। এরপরই মাসুমের নামটি সামনে আসে। তার বাসায় ওই রাতে খোঁজ নেওয়া হয়। এরপর দেখা যায়, মাসুম বাসায় নেই। কোথায় রয়েছে তাও পরিবারের সদস্যরা জানেন না।
তখন তাকে ঘিরে সন্দেহ বাড়তে থাকে। এর পরই মাসুমের স্ত্রী দীনাকে গোয়েন্দারা জিজ্ঞাসাবাদ করেন। স্বামীর অবস্থান সম্পর্কে তিনিও কোনো তথ্য দিতে পারেননি। এরপরই গোয়েন্দারা প্রযুক্তিগত ও সোর্সনির্ভর তদন্ত করে জানতে পারেন, ওই রাতেই ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুর এলিয়ন গাড়ি নিয়ে জয়পুরহাটের উদ্দেশে ঢাকা ছেড়েছেন মাসুম। আর তার সহযোগীরা ভিন্ন রুট ধরে। এর পরই গোয়েন্দারা মাসুমকে ধরতে কাজ শুরু করেন। ঢাকা থেকে টিম চলে যায় জয়পুরহাট। সীমান্ত হয়ে পালাতে ব্যর্থ হয়ে মাসুম চলে যায় বগুড়া। রেজিস্ট্রারে নাম-পরিচয় না লিখেই সেখানের একটি অখ্যাত হোটেলে ওঠেন। এক বন্ধু তাকে এতে সহায়তা করেন। পরে বগুড়া পুলিশের সহায়তায় ঢাকার গোয়েন্দারা তাকে গ্রেপ্তার করেন। এ সময় খুব ধীরস্থির ও স্বাভাবিক ছিলেন তিনি।
বগুড়া সদর পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক তাজমিলুর রহমান জানান, ঢাকার ডিবির দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে রোববার সকালে অভিযান পরিচালনা করা হয়। এ সময় হোটেলের দ্বিতীয় তলার ১ নম্বর কক্ষে অবস্থান করছিলেন শুটার মাসুম। তার ছবি আগে থেকেই পাঠানো হয়েছিল। সেই ছবি দেখে মাসুমকে শনাক্ত করা হয়। ধরা পড়ার পর অকপটে তিনি আওয়ামী লীগ নেতা টিপুকে গুলি করে হত্যার কথা স্বীকার করেন।
জানা যায়, হত্যা মিশন সফল করে দ্রুত শাহজাহানপুর ও মতিঝিল এলাকা ত্যাগ করার কৌশল নেন মাসুম। আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুলকে হত্যা করে শাহজাহানপুর থেকে মোটরসাইকেল নিয়ে মাসুম রাজারবাগ মোড়ে চলে যান। এরপর মালিবাগ উড়াল সড়ক হয়ে বাংলামোটরে এসে নামেন। সেখান থেকে মগবাজার হয়ে হাতিরঝিলে ঢুকে পড়ে্ন। বাড্ডার ইউলুপ হয়ে ইস্ট-ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির সামনে দিয়ে বনশ্রী হয়ে গোড়ানে প্রবেশ করেন। এরপর সেখানকার ছাপরা মসজিদের কাছে গিয়ে অস্ত্র ও মোটরসাইকেল একজনকে হস্তান্তর করে ক্লাবে ঢোকেন। মিনিট দশেকের মতো গোড়ান ক্লাবে ছিলেন মাসুম।
শুটারকে শনাক্ত করতে তার বন্ধুসহ অন্তত ১৫ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পুলিশ জানিয়েছে, সিসি ক্যামেরার ফুটেজ ও তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে জাহিদুল ইসলাম টিপু ও সামিয়াকে হত্যায় মাসুমের অংশ নেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।