ডা. মোহাম্মদ ইয়াকুব আলী
এখন হাড়-মাংস না কেটে ঘাড় ও কোমর ব্যথাসহ মেরুদণ্ডের সমস্যার চিকিৎসা করা যায়।এই বিষয়ে বিস্তারিত জানাচ্ছেন রাজধানীর ইস্কাটনে অবস্থিত ইনস্টিটিউট অফ লেজার সার্জারি অ্যান্ড হসপিটালের পরিচালক এবং লেজার সার্জারি বিশেষজ্ঞ ডা. মোহাম্মদ ইয়াকুব আলী।
তিনি বলেন, মানবদেহের ভেতরের কাঠামোর বড় অংশ জুড়ে রয়েছে মেরুদণ্ড। এটি মানুষের শরীরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। ছোট ছোট অনেকগুলো হাড়ের সমন্বয়ে গঠিত হয় মেরম্নদণ্ড। এই ছোট হাড়গুলোর প্রতিটিকে আলাদা আলদাভাবে কশেরুকা (ভাটিব্রা) বলা হয়।
প্রতি দুটি কশেরুকার মাঝে চাপ শোষণকারী ডিস্ক থাকে, যা মেরুদণ্ডের এক হাড় থেকে অন্য হাড়কে আলাদা রাখে ও নড়াচড়া করতে সাহায্য করে। মানুষের মেরুদণ্ডে শক্ত হাড় ছাড়াও দুই হাড়ের মাঝখানে নরম হাড় (ইন্টারভার্টেব্রাল ডিস্ক) থাকে, যা গাড়ির স্প্রিং বা শক এবজরবারের মতো কাজ করে। এসব হাড় কিংবা ডিস্কে কোনো ধরনের সমস্যা দেখা দিলে শরীরে বিভিন্ন ধরনের, বিশেষ করে কোমর ও ঘাঁড়ে ব্যথা দেখা দিতে পারে।
>ঘাড় ও কোমর ব্যথার কারণঃ
সাধারণত ভারি জিনিস উঠানো, আঘাত, শরীরের বিশেষ অবস্থা ঝাকি খাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে ডিস্কের স্থানচ্যুতির (প্রোলাপ্স) কারণে সংলগ্ন মেরুরজ্জু (স্পাইনাল কর্ড) অথবা স্নায়ুমূল (নার্ভরুট) অথবা দুটোর উপরেই চাপ পড়তে পারে। কোমড়ের (লাম্বার) ডিস্ক প্রোল্যাপ্সে রোগী কোমর বা মাজায় তীব্র ব্যথা অনুভব করে। ফলে রোগী বসতে বা দাঁড়াতে পারে না।
কোমরে উৎপন্ন স্নায়ুসমূহ (নার্ভ) কোমর থেকে পা পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকে। তাই প্রাথমিক পর্যায়ে মাজা ব্যথার পাশাপাশি একপাশ বা উভয় পাশের রান, হাঁটু, হাঁটুর নিচের গোছা, গোড়ালি বা পায়ের আঙুল পর্যন্ত যে কোন জায়গায় ব্যথা অনুভূত হতে পারে। এ ছাড়াও শরীরের এসব জায়গায় ঝিন-ঝিন, শিন-শিন করে, পায়ের বোধ শক্তি কমে যায়, পর্যায়ক্রমে পা দুর্বল হয়ে যেতে থাকে এবং এক পর্যায়ে রোগী হাঁটতে, দাঁড়াতে এমনকি বসতেও পারে না।
অন্যদিকে মানুষের ঘাড়ে (সারভাইকাল) উৎপন্ন স্নায়ুগুলো ঘাড় থেকে হাত পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকে। কাজেই ঘাড়ের ডিস্ক প্রোল্যাপ্সে প্রাথমিক পর্যায়ে ঘাড়ের ব্যথার পাশাপাশি ডান বা বাম হাত বা উভয় হাতে ব্যথা অনুভূত হতে পারে। লাম্বার ডিস্ক প্রোল্যাপ্সের মতো এখানেও হাত ঝিন-ঝিন, শিন-শিন করে, হাতের বোধ শক্তি কমে যায়। এক পর্যায়ে হাত দুর্বল হয়ে যেতে পারে- এমনকি হাত-পা উভয়ই দুর্বল হয়ে যেতে পারে।
মেরুদণ্ডের নরম হাড় বা ইন্টারভার্টেব্রাল ডিস্ক গঠনগতভাবে নিউক্লিয়াস প্যালপোসাস (কেন্দ্রমধ্যস্থিত জেলির মতো পদার্থ) এবং অ্যানিউলাস ফাইব্র্যোসাস (চারপাশের শক্ত ফাইবার বা আঁশ ও ছোট ছোট রক্তানালী) দিয়ে তৈরি। মানুষের দাঁড়ানো অবস্থায় বা ওজন বহনকালে কেন্দ্রে থাকা জেলির উপর চাপ পড়ে। আর শক্ত অ্যানিউলাস ফাইব্র্যোসাস সেই চাপ নিয়ন্ত্রণ করে ডিস্কের গঠন ঠিক রাখে।
তবে বেশি ওজন বহনে বা অনিয়ন্ত্রিত নড়াচড়ায় নিউক্লিয়াস প্যালপোসাসের উপর মাত্রাতিরিক্ত বা অসম চাপ পড়লে সেই অতিরিক্ত চাপ অ্যানিউলাস ফাইব্র্যোসাস আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। ফলে নিউক্লিয়াস প্যালপোসাস অ্যানিউলাস ফাইব্র্যোসাস এবং কখনও কখনও অ্যানিউলাস ফাইব্র্যোসাস ছিড়ে কোন একদিকে বের হয়ে আসে। ফলে মেরুরজ্জু (স্পাইনাল কর্ড) অথবা স্নায়ুমূল (নার্ভরুট) অথবা উভয়ের উপরেই চাপ পড়ে।
>ঘাড় ও কোমর ব্যথার চিকিৎসাঃ
১৯৩৪ সাল থেকে আজ পর্যন্ত প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতিতে পিঠের চামড়া, মাংস ও হাড়ের মাঝখান দিয়ে কেটে বেরিয়ে আসা বা প্রোল্যাপসড নিউক্লিয়াস প্যালপোস্যাসের অংশটুকু তুলে এনে স্নায়ূ বা স্নায়ূ রজ্জুর চাপকে প্রশমিত করা হয়। এছাড়া নিয়মিত ফিজিওথেরাপি গ্রহণের মাধ্যমে ব্যথা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
গবেষণা বা ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষায় প্রমানিত হয়েছে যে, পারকিউটেনিয়াস লেজার ডিস্ক ডিকমেপ্রশনের (পিএলডিডি) মাধ্যমে নির্দিষ্ট মাত্রার ও নির্দিষ্ট ধরনের লেজার রশ্মি প্রয়োগ করে অতি সহজেই নিউক্লিয়াস প্যালপোসাসের অংশবিশেষ বাষ্পায়িত করে এর অতিরিক্ত চাপ কমানো সম্ভব। ফলে স্থানচ্যুত (প্রোলাপ্সড) ডিস্ক পূর্বাবস্থায় ফিরে আসে এবং স্পাইনাল কর্ড ও নার্ভরুটের উপর থেকে চাপ কমে রোগী স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে।
এছাড়া লেজারের অপটো-থারমো মেকানিকল স্টিমুলেশনের মাধ্যমে ছিড়ে যাওয়া অ্যানিউলাস ফাইব্র্রোসাসের পুরো ক্ষমতা রিপেয়ার বা পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এই পদ্ধতিতে হাড়, মাংস ও চামড়া কাটার যেমন প্রয়োজন হয় না, তেমনি রোগীকে অজ্ঞান করারও প্রয়োজন হয় না। ফলে, ডায়াবেটিস বা হৃদরোগীর ক্ষেত্রেও লেজার সার্জারিতে তেমন কোন সমস্যা দেখা দেয় না।
আর হাড়-মাংস না কাটার ফলে লেজার প্রয়োগের স্থানও দুর্বল হয় না এবং কোন ক্ষতচিহ্নও (স্কার) থাকে না। ফলে ভবিষ্যতে এই অংশে স্কারের টানের কোন ব্যথা অনুভূত হয় না।
উন্নত বিশ্বে ডিস্ক প্রোল্যাপ্সের বেশিরভাগ রোগীরই এখন আর কেটে অপারেশন করা হয় না। সারভাইক্যাল/লাম্বার ডিস্ক প্রোলাপ্সের বেশিরভাগ রোগীই পারকিউটেনিয়াস লেজার ডিস্ক ডিকমেপ্রশনের (পিএলডিডি) মাধ্যমে সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করে থাকে।
এখানে উল্লেখ্য, এই চিকিৎসায় যে ধরনের বা যে মাত্রার লেজার রশ্মি ব্যবহার করা হয়ে থাকে, তাতে কোনো রকম পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা থাকে না বললেই চলে। আমেরিকার ফেডারেল ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এরইমধ্যে পিএলডিডিকে নিরাপদ চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে স্বীকৃতিও দিয়েছে।
ডা. মোহাম্মদ ইয়াকুব আলী আরো বলেন, বাংলাদেশেও এখন হাড় ও মাংস না কেটে ঘাড় ও কোমর ব্যথাসহ মেরুদণ্ডের সমস্যার চিকিৎসা অত্যন্ত সফলভাবে করা হচ্ছে।খরচাপাতিও কম।মধ্যবিত্ত ও সাধারণ রোগীদের কথা বিবেচ্য করা হয়।তবে কোমর ও ঘাড়ের ব্যথার খরচ একটু আলাদা হয়। কোমরের চিকিৎসার জন্য সাধারণত সাতদিন হাসপাতালে থাকতে হয়। এক্ষেত্রে খরচ ৫৫ থেকে ৫৯ হাজার হয়। আর ঘাড়ের ব্যথার জন্য থাকতে হয় তিনদিন। এক্ষেত্রে তাই খরচ আরো একটু কমে আসে।
এছাড়া সমস্যা জটিল হলে পরীক্ষার মাধ্যমে চিকিৎসার পরিসর বাড়লে খরচ বেশি হতে পারে। তবে দেশেই বিদেশের মতো মানুষের উন্নত সেবাধানে আমরা বদ্ধপরিকর।
–ডা: মােহাম্মদ ইয়াকুব আলী, ব্যবস্থাপনা পরিচালক: বিএলসিএস ইনস্টিটিউট আ্যন্ড হসপিটাল। রোড-২,সেক্টর ২,ব্লক-ডি,আফতাব নগর,ঢাকা।
web:www.blcsbd.com প্রয়োজনে -০১৭৫১৯৩১৫৩০, +৮৮০২৫৫০৪৬৭১৫