অধ্যাপক ডাঃ এম. এস. জহিরুল হক চৌধুরী
পার্কিনসন্স রোগ মস্তিষ্কের ক্ষয়জনিত রোগ যেখানে মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট কিছু অংশের কার্যক্ষমতা কমে যায়। এই রোগের প্রথম বর্ণনা দেন ১৮১৭ সালে ডাঃ জেমস পারকিনসন। পার্কিনসন্স কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের রোগ যার ফলে মস্তিষ্কের যে অংশ শরীরের নড়াচড়া নিয়ন্ত্রণ তা আক্রান্ত হয়ে থাকে। এই রোগের লক্ষণ শুরুর দিকে খুব একটা বোঝা যায় না। খুব ধীরে ধীরে এর লক্ষণ স্পষ্ট হতে থাকে। অনেক ক্ষেত্রেই শুরুর দিকে এক হাতে অনিয়ন্ত্রিত কাঁপুনি দেখা যায়। পরবর্তীতে হাঁটাচলা, কথা বলা, ঘুমানোর ক্ষেত্রেও প্রভাব পড়তে শুরু করে। পার্কিনসন্স রোগের নির্দিষ্ট কোন চিকিৎসা নেই, তবে ঔষধের মাধ্যমে কিছু কিছু লক্ষণ উপশমিত হতে পারে। ক্ষেত্রবিশেষে মস্তিষ্কে আক্রান্ত অংশে সার্জারির মাধ্যমে সামান্য উন্নতি করা সম্ভব। পার্কিনসন্স রোগের লক্ষণ সবার জন্য একরকম হয় না। শুরুর দিকে লক্ষণ বোঝা নাও যেতে পারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই লক্ষণ শরীরের একদিকে শুরু হয়। পরবর্তীতে শরীরের দুইপাশ-ই আক্রান্ত হতে পারে।
পার্কিনসন্সের লক্ষণের মধ্যে অন্যতম হলো:
অনিয়ন্ত্রিত কম্পন: হাত বা হাতের আঙুল অনিয়ন্ত্রিতভাবে কাঁপা পার্কিনসন্সের লক্ষণ। হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলির সাথে তর্জনী ঘষলে এই ধরণের কাঁপুনি টের পাওয়া যায়।
নড়াচড়া ধীরগতি: সময়ের সাথে সাথে পার্কিনসন্সের ফলে রোগীর নড়াচড়া করার ক্ষমতা কমে যেতে পারে। এর ফলে অনেক সহজ কাজ করা কঠিন ও সময়সাপেক্ষ হয়ে পড়ে। যেমন হাঁটার সময় রোগীর পদক্ষেপের দৈর্ঘ্য কমে যায়, চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ানো কঠিন হয়ে পড়ে – ইত্যদি।
মাংসপেশির দৃঢ়তা: শরীরের বিভিন্ন স্থানে মাংসপেশী শক্ত হয়ে যায়। এর ফলে ব্যথা অনুভব হয় এবং হাঁটাচলায় সমস্যা দেখা দেয়।
শরীরের ভারসাম্য ও ভঙ্গিতে ব্যাঘাত: পার্কিনসন্সের ফলে চলাফেরা ও বসার অঙ্গভঙ্গি পরিবর্তিত হয় এবং অনেক ক্ষেত্রে রোগী ভারসাম্যহীনতায় ভুগে থাকে।
স্বতশ্চলনে ব্যাঘাত: পার্কিনসন্সের ফলে স্বাভাবিক কিছু গতিবিধি যেমন চোখের পাতা ফেলা, হাসা এমনকি হাঁটার সময় দুই হাত নাড়ানোর ক্ষমতা হ্রাস পায়।
বাকশক্তি হ্রাস: কথা জড়িয়ে আসা, কথা বলার আগে দ্বিধায় ভোগা, কথা অনিয়ন্ত্রিতভাবে দ্রুত বলা এ রোগের লক্ষণ।
লেখার ক্ষমতা কমে যাওয়া: রোগীর জন্য লেখালেখি করা কঠিন হয়ে পড়ে। লেখা আগের তুলনায় ছোট হয়ে যায়।
এই ধরণের লক্ষণ দেখা গেলে ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করুন। পার্কিনসন্সের লক্ষণ অনেক রোগের সাথেই মিলে যেতে পারে, তাই আসলেই পার্কিনসন্স কি না তা যাচাই করার জন্য ডাক্তার দেখানো দরকার।
কারণঃ
পার্কিনসন্স রোগে মস্তিষ্কে কিছু নির্দিষ্ট স্নায়ুকোষ ধীরে ধীরে ভাঙতে থাকে অথবা মারা যায়। মস্তিষ্কের যে স্নায়ুগুলো ডোপামিন নামক তথ্যপরিবহনকারী রাসায়নিক তৈরী করে সেগুলো নষ্ট হয়ে গেলে পার্কিনসন্সের লক্ষণগুলো দেখা দিতে শুরু করে। ডোপামিনের পরিমান কমে গেলে মস্তিষ্কে অস্বাভাবিকতা দেখা দেয় যা পরবর্তীতে পার্কিনসন্সে রূপ নেয়।
পার্কিনসন্স রোগের কোন নির্দিষ্ট কারণ জানা যায়নি। তবে নিম্নোক্ত কারণগুলো কিছু ভূমিকা পালন করে থাকে –
ঝুঁকি:
পার্কিনসন্স যে কারও হতে পারে। তবে কিছু ক্ষেত্রে এই রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। যেমন –
বয়স: তরুণদের খুব কমই পার্কিনসন্স হয়ে থাকে। এই রোগ মূলত মধ্যবয়সে অথবা বার্ধক্যে হয়ে থাকে। পার্কিনসন্স রোগের ঝুঁকি বয়স বাড়ার সাথে সাথে বাড়তে থাকে।
বংশগত: নিকটাত্মীয় কারও পার্কিনসন্স রোগ থাকলে এই রোগ হওয়ার ঝুঁকি কিছুটা বেড়ে যায়। তবে আত্মীয়স্বজনের মধ্যে অনেকজন এই রোগে আক্রান্ত না থাকলে পার্কিন্সন্সন্স হওয়ার ঝুঁকি খুব একটা বেশি না।
লিঙ্গ: মহিলাদের চেয়ে সাধারণত পুরুষদের পার্কিনসন্স বেশি হয়ে থাকে।
বিষাক্ত পদার্থ: আগাছা দমনের জন্য ব্যবহৃত রাসায়নিক কিংবা কীটনাশক পার্কিনসন্স রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
জটিলতা:
পার্কিনসন্সের ফলে বেশ কিছু অতিরিক্ত জটিলতা দেখা যায়:
চিন্তাশক্তি কমে যাওয়া: পার্কিনসন্সের ফলে চিন্তা করার ক্ষমতা কমে যাওয়া, ডিমেনশিয়ার মতো জটিলতা দেখা যেতে পারে। এই ধরণের জটিলতা মূলত পার্কিনসন্সের পরবর্তী ধাপে দেখা দেয়।
অবসাদগ্রস্ততা ও আবেগ: শুরুর দিকে রোগী অবসাদগ্রস্ত হতে পারে। অবসাদের চিকিৎসা করার মাধ্যমে রোগী অন্যান্য ঝুঁকির সাথে সহজে মোকাবিলা করতে পারে। এছাড়াও কিছু আবেগের পরিবর্তন দেখা দিতে পারে, যেমন; ভয়, উদ্বিগ্নতা, কোন কাজ করার প্রেরণা না পাওয়া ইত্যাদি।
খাদ্যভক্ষনে সমস্যা: পার্কিনসন্সের পরবর্তী ধাপে মুখের অনেক মাংসপেশি আক্রান্ত হয়ে খাওয়া দাওয়ার সমস্যা তৈরী হয়।
ঘুমানোর সমস্যা: পার্কিন্সন্সর রোগীদের অনেকেই ঘুমের সমস্যায় ভুগে থাকেন। যেমন; ঘুমের মধ্যে বারবার জেগে ওঠা, খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে যাওয়া অথবা দিনের বেলা ঘুমিয়ে পড়া ইত্যাদি।
মূত্রনিয়ন্ত্রনে সমস্যা: এই রোগীদের অনেকেই মূত্রথলির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। ফলে অযাচিতভাবে মূত্রত্যাগ করে বসেন।
কোষ্ঠকাঠিন্য: পার্কিনসন্স রোগে আক্রান্ত অনেকেরই কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দেয়। এর কারণ পরিপাকতন্ত্রের ধীরগতি।
রক্তচাপ: হঠাৎ করে উঠে দাঁড়ানোর সময় রক্তচাপ কমে যাওয়ার ফলে মাথা ঘোরা বা মাথা ঝিমঝিম করতে পারে, যা অর্থোস্ট্যাটিক হাইপোটেনশন নাম পরিচিত।
ক্লান্তিভাব: পার্কিনসন্স রোগীদের খুব বেশি পরিমানে শক্তি অপচয় হয় যার ফলে তারা অতিরিক্ত ক্লান্তিতে ভুগে থাকেন, বিশেষ করে দিনের শেষের দিকে।
রোগনির্ণয়:
পার্কিনসন্স রোগ নির্ণয়ের জন্য কোন নির্দিষ্ট পদ্ধতি নেই। নিউরোলজিস্ট যিনি স্নায়ুতন্ত্রের বিভিন্ন অবস্থা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ তিনি রোগীর পূর্ববর্তী রোগ ও চিকিৎসা, রোগীর লক্ষণ, নিউরোলজিক্যাল পরীক্ষা ও শারীরিক পরীক্ষার মাধ্যমে এই রোগ নির্ণয় করে থাকেন। প্রয়োজন অনুসারে ডাক্তার ডোপামিন ট্রান্সপোর্টার টেস্ট করার জন্য বলতে পারেন। এছাড়া এমআরআই, সিটি স্ক্যান এর পাশাপাশি রক্ত পরীক্ষার প্রয়োজন হতে পারে।
পার্কিনসন্স রোগ নির্ণয়ে সময় লাগতে পারে। তাই ডাক্তার নিয়মিত ফলোআপ করার জন্য বলতে পারেন।
অধ্যাপক ডাঃ এম. এস. জহিরুল হক চৌধুরী: এমবিবিএস, বিসিএস (স্বাস্থ্য), এমএসিপি (মেডিসিন, ইউ.এস.এ), এমডি (নিউরো-মেডিসিন) ফেলো, মুভমেন্ট ডিসওর্ডার ও বোটুলিনাম টক্সিন (ভারত), মেডিসিন ও নিউরো-মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, অধ্যাপক (ক্লিনিক্যল নিউরোলজি)
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সস এন্ড হসপিটাল, শের-ই বাংলা নগর, ঢাকা।
চেম্বার: ল্যবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল
বাড়ি নং-৬, রোড নং-৪,ধানমন্ডি, ঢাকা ১২০৫
রোগী দেখার সময়: প্রতিদিন বিকাল ৬টা – রাত ৯টা পর্যন্ত (বৃহস্পতিবার – শুক্রবার বন্ধ) যোগাযোগ: ০১৮৬৫-৪৪৪৩৮৫, ০১৮৬৫-৪৪৪৩৮৬।